বাংলাদেশকে বলা হয় ষড়ঋতুর দেশ। ছয়টি ঋতুর সংমিশ্রণে প্রকৃতি ছয়বার সাজে নবরূপে। ঋতুচক্রের ঋতুরানী শরতের পর আসে হেমন্তের প্রাণপ্রবাহ। হিমের ঘন ঘোমটায় সুখ ডেকে এসে উপস্থিত হয় হেমন্ত। হেমন্তের প্রকৃতি যেন সদ্যস্নাত তরুণীর মূর্তি পরিগ্রহ করে। দেখা দেয় অপরূপ মহিমায়।
হেমন্তের রূপগ্রহে নিহীত রয়েছে একটি পরিতৃপ্তির হাসি। ঋতুনাট্যের চতুর্থ কুশীলব হল হেমন্তকাল। হেমন্তে আছে সুদূর ব্যাপ্ত এক বৈরাগের বিষন্নতা। সে যেন ফসল ফলাবার সাধনায় থাকে নিমগ্ন । মাঠে মাঠে, রাশি রাশি সোনালী ফসল কাটার গান। চারিদিকে কৃষকদের ফসল নিয়ে কর্মব্যস্ততা। ঘরে ঘরে চলে নবান্ন উৎসব। নতুন চালের পিঠা পুলিতে চারিদিকে মুখরিত হয় আনন্দ-উৎসব। চলে আত্মীয় স্বজনকে পিঠাপুলি খাওয়ানোর নিমন্ত্রণ। বাংলার হেমন্তে সে এক বিচিত্র উৎসব। আকাশ জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে এক অপরূপ লাবণ্য।
হেমন্তকে নিয়ে সুফিয়া কামাল লিখেছিলেন, সবুজ পাতার খামের ভেতর হলুদ গাঁদা চিঠি লেখে/কোন পাথারের ওপার থেকে/আনল ডেকে হেমন্তকে/আনল ডেকে মটরশুঁটি,খেসারি আর কলাই ফুলে/ আনল ডেকে কুয়াশাকে/সাঁঝ সকালে নদীর কূলে।
ধূসরতাই হেমন্তের বর্ণ, কিন্তু সে ধূসরতায় রিক্ততা নেই- আছে স্নিগ্ধতা। হেমন্তের পরিপূর্ণতায় মানুষের প্রাণে জাগে এক অজানা আনন্দের আবাস, জাগে এক অজানা আনন্দের শিহরণ। হেমন্তের দূর্বাঘাসের ওপরে শিশির বিন্দুগুলো মুক্তোর মত উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। হেমন্তের জীবন ত্যাগের মহিমায় প্রজ্জ্বল। ঘরে ঘরে ফসলের সওগাত বিলিয়ে দেয়ার জন্য তার আগমন। নিজেকে উজার করে দেয়াই যেন তার ব্রত। নিজেকে নিঃশেষ করে দেয়াই তার স্বার্থকতা।
হেমন্ত নতুন শাকসবজির পসরাও বহন করে আনে মানুষের দুয়ারে। এসময়টা গ্রামের প্রকৃতি সাজে নবরূপে। ফসলের মাঠে মুহুমুহু গন্ধ। কৃষাণী বধু ঘরে ধান তোলার যত আয়োজন আছে সব সেরে ফেলে। তবে গ্রামের মাঠগুলোতে এখনো দেখা মেলে সবুজের মাঝে সোনা রোদের খেলা। এসময়টাতে ক্ষেতে দেখা মেলে বিভিন্ন শাক সবজির। বিশেষ করে ফুলকপি, বাঁধাকপি আরো কত কী।
হেমন্তের গল্প মায়ের মায়ের মুখে খুব শুনেছি। তখন নাকি নববধূরা সারাটি বছর অপেক্ষায় থাকতেন কবে হেমন্ত আসবে, কবে নতুন ধান আসবে, কবে নোলক কিনা হবে। আরো কত কী!
যদি রবীন্দ্রনাথের কবিতার মতো বলি, তবে বলতে হয়, ‘আজ ধানের ক্ষেতে রোদ্রছায়ার লুকোচুরি/খেলা রে ভাই ,লুকোচুরি খেলা /নীল আকাশে কে ভাসালো সাদা মেঘের ভেলা রে ভাই, লুকোচুরি খেলা।
বাংলাদেশের হেমন্তকাল রুপে-লাবণ্যে বরাবরই অনন্য। বাংলা সাহিত্য , সংস্কৃতি, চিন্তা-চেতনা, জীবন-যাপনে হেমন্তের উপস্থিতি আলোকময়। তবে ইদানীংকালে মহাকালের হেমন্ত, বাংলার হেমন্তকাল, নবান্ন গ্রাম ছাড়িয়ে শহুরে রুপ নিয়েছে। প্রতিবছর এখন শহরেও নবান্ন উৎসব হয়। এখন অনেকেই আছেন শহরে, যারা গ্রাম থেকে বেড়ে উঠে শহরে ঘাটি গড়েছেন। তাদের সেই চিরচেনা গ্রামে এখন আর তেমন যাওয়া না হলেও গ্রামকে স্মরণ করতে, অতীতকে মনে করিয়ে দেয়ার জন্য শহরে বেশ জানান দিয়েই নবান্ন উৎসব করা হয়।
বাংলার এ লোকজ সংস্কৃতিতে বেশ টানা-পোড়ন দেখা যাচ্ছে ইদানীং কালে। শহুরে মানুষেরা নবান্ন উৎসব পালন করলেও যেন গ্রামের লোকেদের মধ্যে থেকে চিরায়িত এ উৎসব অনেকটা ম্লান হতে বসেছে। অনেকেই জানেন ই না এখন চলছে হেমন্ত। তবু বলতে হয়, জানাতে হয়, এসেছে হেমন্ত, জাগিয়াছে প্রকৃতি, অরোণ্য।
মরিয়ম আক্তার, শিক্ষার্থী- কড়ৈতলী উচ্চ বিদ্যালয়।
নবম শ্রেণি।