
এদিকে, আশাশুনি উপজেলার প্রতাপনগর, শ্রিউলা ও আশাশুনি সদর ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকা বেড়িবাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয়েছে। দুর্গত এলাকার পাঁচ শতাধিক ঘরবাড়ি পানিতে নিমজ্জিত হওয়া ছাড়াও লক্ষাধিক একর জমির চিংড়ি ঘের তলিয়ে গেছে পানিতে। এছাড়া কয়েক’শ পুকুর জোয়ারের লবনাক্ত পানিতে একাকার হয়ে গেছে। অর্ধ লক্ষাধিক মানুষ তাৎক্ষণিকভাবে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। পাশাপাশি এইসব এলাকায় খাদ্যদ্রব্যসহ পানীয় জলের সংকট দেখা দিয়েছে।
বুধবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে মূলত ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাব শুরু হয়। প্রবল বেগে ঝড় না হলেও নদীর পানি অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পাওয়ায় বিভিন্ন এলাকায় বেড়িবাঁধ ভেঙে ও উপচে লোকালয়ের দিকে নদীর পানি ধেয়ে আসতে থাকে। দুপুরের আগেই উপকূলবর্তী শ্যামনগর উপজেলার সত্তরটিরও বেশি গ্রাম প্লাবিত হয়।
এদিকে দুপুরের পরে ভাটা শুরু হওয়ার পরও নদীতে সেভাবে পানির টান না থাকায় বা নদীর পানি না কমায় রাতের জোয়ার নিয়ে এ জনপদের মানুষের মধ্যে নতুন করে শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
আগে থেকে সাইক্লোন শেল্টারগুলোতে আশ্রয় না নেয়ায় প্লাবিত হওয়ার পর চারপাশে পানিবেষ্টিত মানুষজন উদ্ধার কর্মীদের সহায়তার জন্য অপেক্ষা করছে। ক্ষয়ক্ষতি নিরূপনসহ করণীয় নির্ধারণের জন্য উপজেলা প্রশাসন ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটি দুপুরের পরপরই জরুরি সভা আহ্বান করে।
জানা গেছে, বুধবার সকাল থেকে পরিস্থিতি শান্ত থাকলেও সকাল থেকে নদ-নদীসমূহে পানি বাড়তে থাকে। এক পর্যায়ে অতি জোয়ারের চাপে বেলা সাড়ে ১০টার পর থেকে শ্যামনগরকে ঘিরে থাকা ৫, ১৫ ও ৭ নং পোল্ডারের বিভিন্ন অংশে বাঁধ উপচে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করতে শুরু করে। দ্বীপ ইউনিয়ন গাবুরার নাপিতকালী, জেলেখালী, গাগড়ামারী, চাঁদনীমুখা এলাকার বাঁধ ছাপিয়ে পানি লোকালয়ে প্রবেশ করে।
এসময় প্রায় চার শতাধিক গ্রামবাসী একাধিক গ্রুপে বিভক্ত হয়ে বিভিন্ন পয়েন্টে বাঁধের উপর আইল দিয়ে পানির প্রবেশ ঠেকানোর চেষ্টা করে। কিন্তু প্রবল জোয়ারের তোড়ে সে চেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে এসব অংশ দিয়ে পানি ঢুকতে শুরু করে। মুহূর্তের মধ্যে সুন্দরবনের কোলঘেষা দ্বীপ ইউনিয়ন গাবুরার ১৫টি গ্রামের প্রায় ৩০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়ে। সীমান্তবর্তী কালিন্দি নদী সংলগ্ন অংশের বাঁধ ভেঙে ও পাশ্ববর্তী একাধিক অংশে বাঁধ উপচে মাদার নদীর পানি লোকালয়ে প্রবেশ করলে দুপুরের মধ্যে ইউনিয়নের ২২টি গ্রামের সবগুলোই প্লাবিত হয়।
সুন্দরবনের মধ্যে গড়ে ওঠা একমাত্র জনবসতি রজজাননগর ইউনিয়নের গোলাখালী গ্রামের বাঁধ ভেঙে যাওয়ায় সেখানকার ৮৮টি পরিবারের সবার ঘরবাড়ি ও অর্ধশত চিংড়ি ঘের সাগরের সাথে মিশে একাকার হয়ে যায়। গ্রামবাসীরা তাৎক্ষণিকভাবে নিজেদের নৌকায় আশ্রয় নিলেও তাদের বসতঘর ও ব্যবহার উপযোগী সর্বস্ব সাগরের পানিতে ভেসে যায় বলে জানান ওই গ্রামের আইমান বেগম (৬০) ও আসলাম হোসেন (৫৫) সহ স্থানীয়রা।
আরও পড়ুন: ভোলায় ইয়াসের প্রভাবে চরাঞ্চল প্লাবিত, ৫০ হাজার মানুষ পানিবন্দি
বুড়িগোয়ালিনী গ্রামের রমজান আলী (৭৬) বলেন, 'আমার বয়েসে নদীতে এতো পানি বৃদ্ধি পেতে দেখিনি। আইলা, আম্পানের সময় নদীতে যে পরিমাণ পানিবৃদ্ধি পেয়েছিলো তার চেয়ে ইয়াসে ৩ থেকে ৪ ফুট পানি বৃদ্ধি পেয়েছে।'
মুন্সিগঞ্জ ইউনিয়নের সিংহড়তলী এলাকার উপকূল রক্ষা বাঁধ এর প্রায় একফুট উপর দিয়ে পাশের চুনকুড়ি নদীর পানি তীব্র বেগে লোকালয়ে প্রবেশ করলে পাশ্ববর্তী তিনটি গ্রাম তাৎক্ষণিকভাবে পানিতে তলিয়ে যায়। এ সময় আটকেপড়া স্থানীয়দের উদ্ধার করতে গিয়ে আব্দুস সামাদ নামের এক সিপিপি এর স্বেচ্ছাসেবী স্রোতের টানে ভেসে গিয়ে আহত হয়েছে।
বুড়িগোয়ালীনি ইউপি চেয়ারম্যান ভবতোষ মন্ডল জানান দুর্গাবাটি, মাদিয়া, ভামিয়া, পোড়াকাটলা ও দাতিনাখালীসহ পানখালী এলাকার বাঁধ উপটে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করায় ছয়টি গ্রামের পাঁচ হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। এছাড়া বাঁধের উপর দিয়ে পানি লোকালয়ে প্রবেশের সুযোগে পশ্চিম দুর্গাবাটি এলাকার উপকূল রক্ষা বাঁধের অন্তত ৩০ মিটার ভেঙে গেছে বলে জানায় স্থানীয়রা।
পদ্মপুকুরের পাতাখালী বাজার সংলগ্ন উপকূল রক্ষা বাঁধের তিনটি পয়েন্ট ভেঙে যাওয়ার পাশাপাশি তদসংলগ্ন প্রায় এক কিলোমিটার এলাকার বাঁধের উপর দিয়ে জোয়ারের পানি ঢুকে পশ্চিম পাতাখালী ও ঝাপাসহ তিনটি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। দুপুরের জোয়ারের পর সৃষ্ট ভাটার সময়ে নদীতে তেমনভাবে পানির টান না থাকায় রাতের জোয়ারে নুতন নতুন এলাকাসহ ইউনিয়নের সিংহভাগ প্লাবিত হতে পারে বলে জানান স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান আতাউর রহমান।
মঙ্গলবার রাত কিংবা বুধবার সকালে নিকটস্থ সাইক্লোন শেল্টারগুলোতে আশ্রয় না নেয়ায় লোকালয়ে পানি প্রবেশের পরপরই এসব এলাকার হাজার হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়ে। অনেকে তাৎক্ষণিকভাবে স্বেচ্ছাসেবীদের সহায়তায় আশ্রয় কেন্দ্রে ছুটলেও অনেকে আবার ভাটার সময়ের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। শ্যামনগর ও আশাশুনির বিভিন্ন আশ্রয় কেন্দ্রে পাঁচ শতাধিক মানুষ আশ্রয় নিয়েছে বলে জানা গেছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের শ্যামনগরের শাখা কর্মকর্তা মাসুদ রানা জানান, সিংহড়তলী এলাকায মঙ্গলাবার রাতেই ২১০ গ্রামবাসি কাজ করে লোকালয়ে পানি ঢুকা বন্ধ করেছে। আজ সকাল থেকে তারা আবার কাজ করবে দুর্বল বাঁধে মাটি দেয়ার জন্য।
গাবুরার দায়িত্বরত পানি উন্নয়ন বোর্ডের শাখা কর্মকর্তা শাহাদাৎ হোসেন বলেন, 'এলাকার পরিস্থিতি খুবই খারাপ। পানি বাড়ছে হুহু করে। এখনও বাঁধ না ভাঙ্গলেও কখন কি হয় কে জানে'।
শ্যামনগর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আতাউল হক বলেন, ঝড় কিংবা নদীতের পানি বৃদ্ধির কারণে বুধবার সকাল পর্যন্ত বড় ধরণের সমস্যা হয়নি। সকাল ১০টার দিক থেকে ঝড়ের গতির সঙ্গে সঙ্গে পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে গাবুরা, বুড়িগোয়ালিনী, মুন্সিগঞ্জ, কৈখালি, রমজাননগর, কাশিমাড়ি ও পগ্মপুকুর ইউনিয়নের পানি উন্নয়ন বোর্ডের বেঁড়িবাধের ৪৩টি স্থান ঝূঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। এসব স্থানে মাটি দিয়ে বাঁধ মজবুত করার চেষ্টা করা হচ্ছে।
আরও পড়ুন: ঘূর্ণিঝড় ইয়াস: বাগেরহাটে ৫ হাজার পরিবার পানিবন্দি
শ্যামনগর উপেজলা নির্বাহী অফিসার আ ন ম আবুজর গিফারী জানান ক্ষয়ক্ষতি নিরুপনসহ পরবর্তী করনীয় নির্ধারনে ইতোমধ্যে সভা করা হয়েছে। শ্যামনগরের বিস্তিন্ন এলাকা পানিতে তলিয়ে গেছে। ঝড়ের তেমন তীব্রতা ছিল না। কিন্তু নদীর পানি অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে মানুষজন পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। তাদের উদ্ধারের ব্যাপারে ইতোমধ্যে