%E0%A6%AE%E0%A6%A4%E0%A6%BE%E0%A6%AE%E0%A6%A4
স্বাধীন দেশের প্রথম শীতের স্মৃতি
স্বাধীনতার পর প্রথম নববর্ষের কথা মনে পড়ে কিন্তু তাতে অনেক অস্পষ্টতা। যেন দিনগুলো একসঙ্গে মিশে গেছে। একে অপরের সঙ্গে এতটাই এক যে আজকের এবং গতকালের মধ্যে তফাৎ বোঝা কঠিন। সেই সময়ের দিনগুলো, কাদের ও কী ছিল নিশ্চিত হওয়া যায় না। ১৬ ডিসেম্বর যে আনন্দ ও উচ্ছ্বাস নিয়ে এসেছিল তা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি কারণ নিহত ও নিখোঁজ বুদ্ধিজীবীদের খবর আসতে থাকে।
লোকেরা অবাক হয়ে ভাবল কারা এই ভেতরের শত্রু। যারা আত্মসমর্পণ করেছিল তারা ছিল সরকারি বাহিনী। কিন্তু ঘরের ভেতর, নিজেদের যারা, খুনি ও হত্যাকারীরা, তারা তো জীবিত ছিল। যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরেও তাই অনেকে নিজেদের বন্দুক হাতছাড়া করতে চায়নি। বুলেটের বিস্ফোরণের আওয়াজ যে কোনো রাতে বেজে উঠত, তখন বোঝা যেত সেগুলো কেবল "বীরত্ব" দেখানোর চেষ্টা ছিল না, একটা ফ্যান্টম ভয়ের বিরুদ্ধে আওয়াজ, কারণ খুনিরা এখনও চারপাশে লুকিয়ে আছে। তাদের জানান দিচ্ছে আমরা আছি, রাইফেল আছে সঙ্গে।
২
কিছু মানুষ অপরাধের সঙ্গেও জড়িয়ে পড়ে। আজকাল লোকে যখন ভাবে যে এই তো গতকাল পর্যন্ত আমি খারাপ ছিলাম না, আমি আশ্চর্য হই, নিজেকে জিজ্ঞাসা করি, ‘তারা কি ভেবেছে যে আমরা এইমাত্র পাপ ও লুটপাট, ঘৃণা ও চুরি আবিষ্কার করেছি? তারা কি মনে করে যে আমাদের অপরাধ প্রবণতা একটি সাম্প্রতিক উদ্ভাবন? আমরা বিশ্বাস করি যে আমরা সবাই ১৯৭১ সালে সাধু ছিলাম এবং সম্প্রতি পাপী হয়েছি?’ আমি জানি এটি এমন নয়। আমাদের গৌরব ও বিশ্বাসঘাতকতা উভয়ের সঙ্গে মিশ্রিত একটি দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে।
৩
স্বাধীনতার পরপরই, সর্বত্র গোলাগুলি হচ্ছিল এবং কেউই জানত না কী ঘটছে। ঢাকা শহর প্রকৃতপক্ষে কারো নিয়ন্ত্রণে ছিল না যদিও ভারতীয় সেনাবাহিনী বিপুল সংখ্যক সৈন্য নিয়ে শহরে প্রবেশ করে। চারদিক থেকে বাংলাদেশি সৈন্যরাও প্রবেশ করছিল। বেশিরভাগই বেসামরিক এফএফ ছিল যারা হেঁটে ফিরছে শহরে।
তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ছিল টাঙ্গাইলের কাদের সিদ্দিকীর সৈন্য, যাদের স্বাগতম জানায় সবাই। কিন্তু কয়েকদিন পর পল্টন ময়দানে সবার সামনে বিহারি রাজাকারদের হত্যা করে বিশ্ব গণমাধ্যমে প্রচুর নিন্দা কুড়ায় সে। কেউই এই ধরনের কাজ সমর্থন করেনি।
৪
আগে শীতকালে শীত পড়ত কিন্তু সে বছর সবাই কোনো না কোনো কারণে খুব শীত অনুভব করেছিল। মিরাজ আলী তার গ্রামে ফিরতে আগ্রহী হলেও থেকে যান। তিনি একজন ছোট দোকানদার কিন্তু দোকান বন্ধ করেননি। বলেন যে তার কাছে এক মাসের মালের স্টক রয়েছে এবং আশেপাশে ইতোমধ্যে জিনিসপত্রের অভাব দেখা দিয়েছে। যতদিন মাল আছে তিনি অপেক্ষা করবেন। তার বাবা-মা অসুস্থ, তার ভাই যুদ্ধে গেছেন। বাড়িতে কেউ নেই, তাই ফেরার দরকার ছিল কিন্তু তিনি যাননি। কয়েক মাস পরে তার সঙ্গে দেখা হয়। তখন শেষবার তার দোকানটি বিক্রি করে বন্ধ করে চলে যাচ্ছিলেন দেশে। তার বাবা মারা গেছেন আর তার ভাই ফিরে আসেননি। আমার ভাই বোনদের জন্য কিছু চকলেট লজেন্স দিয়ে চলে যান।
৫
আমার কিছু এফএফ বন্ধুরা একটি পার্টির আয়োজন করেছিল। সবাই আগের চেয়ে বেশি জোরে হাসছিল, কৌতুক করেছিল। প্রায় এক বছর নীরবতার পরে, কণ্ঠস্বর মুক্ত হতে পেরেছে। মুক্তি শুধু পাকিস্তানিদের কাছ থেকে নয়, নীরবতার কাছ থেকেও। মদও ছিল টেবিলে কিন্তু সবাই পান করেনি। আমার মনে আছে সবার গল্পগুজব, যুদ্ধের অভিজ্ঞতা শেয়ার করা। কিন্তু সব গল্প পুরা সত্য ছিল না। এটা ঠিক, ভয় থেকে মুক্তি কল্পনাকেও মুক্ত করে। আমার খুব অদ্ভুত দুজন অতিথির সঙ্গে দেখা হয়। উভয়ই ভারত থেকে এসেছে। একজন ব্যবসায়ী যিনি স্বাধীনতার এক দিন পরেই পৌঁছে যান, এরই মধ্যে বন্ধুত্ব করেছেন অনেকের সঙ্গে, কথা বার্তা হচ্ছে। অন্যজন ছিল বেশ হাসি খুশি এক তরুণ। পরে জানলাম কলকাতা থেকে আশা নকশাল পাতি নেতা, এতদিন খুলনায় ছিল এবং ঢাকায় এসে যোগাযোগ শুরু করে। ১৯৭৫ এর পর আর দেখা হয়নি তাদের সঙ্গে।
৬
রাতে আমি সামাদের পরিবার সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। নভেম্বরে তাকে হত্যা করা হয়, লাশ দাফন করা হয় ভারতে। বাড়িতে সবার মন খারাপ ছিল। তার বোন আমাকে জানায় যে, তার মা জায়নামাজ থেকে ওঠেননি। ছোট্ট বসার ঘরে বাবা শুধু স্তব্ধ হয়ে বসে থাকেন। আমি তার কাছে গিয়ে বসলাম, তিনি তাকালেন, আমাকে দেখে আবার নিজের স্তব্ধতার কাছে ফেরত গেলেন। কিছুক্ষণ পর সালাম দিয়ে চলে এলাম। তিনি সাড়া দেননি।
আমি বাড়ির দিকে হাঁটতে লাগলাম। দুই পাশে নীরব ও সরব বাড়িগুলার দিকে তাকিয়ে ভাবছিলাম কে বাস করে সেখানে। কেবল হাঁটতে থাকলাম যতক্ষণ না আমি শুনতে পেলাম আমাদের বাড়ির কাছে বিপিন বাবু মাতাল হয়ে কিছু ভুলে যাওয়া গান গাইছেন আগামীর বছরগুলোকে স্বাগত জানিয়ে।
যুক্তরাজ্যে মামলা এবং ১৯৭১-এর ইতিহাসের ভবিষ্যৎ
শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। সকাল থেকে বিভিন্ন টিভি চ্যানেল আর ফেসবুকের আলোচনাগুলো লক্ষ্য করছি। গুরুত্বপূর্ণ মতামত আর আবেগ উঠে এসেছে সেসব আলোচনায়। অনেকে আবার এই সুযোগে শহীদ দিবসের উত্তপ্ত তাওয়ায় গণতন্ত্র, নির্বাচন, মত প্রকাশের স্বাধীনতা ইত্যাদিও ভেজে নিচ্ছেন একটু করে।
এতে সমস্যা নেই। এসব বিষয় অবশ্যই গুরুত্বের দাবিদার এবং আলোচনাগুলো সবসময়ই প্রাসঙ্গিক। কিন্তু নির্দিষ্ট যে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা অন্তত আজকের এই দিনে ‘সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ’ ও সময়োপযোগী ছিল বলে মনে করছিলাম; সেটি কোথাওই আর উত্থাপিত হতে দেখলাম না। তাই এই পোস্টটি লেখার তাগিদ অনুভব করছি। ধৈর্য্য ধরে যদি পড়েন (কারণ এটি একটি দীর্ঘ পোস্ট হতে যাচ্ছে) তাহলে কৃতজ্ঞ হব।
এই যে উপরে লিখলাম ‘সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ’, কথাটা কিন্তু এতটুকু বাড়িয়ে বলিনি। এই পোস্টটি পড়লে আপনার কাছেও হয়তো সেটি স্পষ্ট হবে এবং আপনিও একমত হবেন।
আমার মতে, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ১৯৭১ এর যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরু হওয়া থেকে গত ১৫ বছরে এ সংক্রান্ত সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ তিনটি ঘটনাকে যদি চিহ্নিত করি আমরা, তাহলে সম্ভবত এই পোস্টে যে বিষয়টি তুলে ধরার চেষ্টা করছি সেটি হতে যাচ্ছে তার একটি।
একটু ধারণা দিই, এমনকি হয়তো শাহবাগ আন্দোলনও এই তিন প্রধান ঘটনার তালিকার মধ্যে পড়বে বলে আমার মনে হয় না!
তাহলে একটু মন দিয়ে পড়ুন।
আপনারা জানেন, ১৯৭১ এর বুদ্ধিজীবীদের হত্যাকারীদের একজন হিসেবে চৌধুরী মুঈনউদ্দিন নামে একজনের বিচার হয়েছিল বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে (আইসিটি)। আসামির অবর্তমানে তার বিচারের রায়ে তাকে সন্দেহাতীতভাবে দোষী সাব্যস্ত করে আইসিটি এবং তাকে ফাঁসির দণ্ড দেওয়া হয় ২০১৩ সালে।
আরও পড়ুন: বেদনায় ভরা দিন: শেখ হাসিনা
দণ্ডপ্রাপ্ত মুঈনউদ্দিন যুক্তরাজ্যে বসবাস করায় সেই সাজা কখনোই বাস্তবায়িত হয়নি। কেন হয়নি বা কি কি করা সম্ভব ছিল বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে, তা নিয়ে আরেকদিন আলোচনা করা যাবে; এখন সে কথা থাক। মুঈনউদ্দিনের পুরো ঘটনা যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণভাবে নতুন মোড় নিয়েছে, সেটি মনে হয় আপনাদের সবার আগে জানা থাকা দরকার।
২০১৯ সালে যুক্তরাজ্যের স্বরাষ্ট্র দপ্তর জঙ্গীবাদ ও ইসলামিজম বিষয়ে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে, মূলত অনলাইনে। সেখানকার একটি ‘ফুটনোটে’ চৌধুরী মুঈনউদ্দিনের নাম উল্লেখ করে বলা হয় তার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের আইসিটির একটি রায়ও রয়েছে।
যুক্তরাজ্যে মুঈনউদ্দিনের নিযুক্ত আইনজীবীরা দাবি করেন, রিপোর্টে তার রায়ের এই বিষয়টির এমনকি উল্লেখও নাকি তার বিরুদ্ধে মানহানির শামিল এবং এই মর্মে তারা স্বরাষ্ট্র দপ্তরকে আইনি নোটিশ পাঠায়। স্বরাষ্ট্র দপ্তর এই লিগ্যাল নোটিশের পরিপ্রেক্ষিতে সেই ফুটনোটটি সরিয়েও নেয় অনলাইন থেকে। তারপরও মুঈনউদ্দিন যুক্তরাজ্য স্বরাষ্ট্র দপ্তরের বিরুদ্ধে যুক্তরাজ্যের হাইকোর্টে মানহানির মামলা করেন।
আদালতে মুঈনউদ্দিনের বক্তব্য ছিল বাংলাদেশের আদালতের রায়কে সূত্র হিসেবে ব্যবহার করার বিষয়টিই তার জন্য মানহানিকর, কারণ বাংলাদেশের আইসিটির নাকি কোনো ধরনেরই গ্রহণযোগ্যতা নেই।
সুতরাং, আইসিটির মাধ্যমে ১৯৭১ এর যে ধরনের ইতিহাস প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা হয়েছে আর যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ এবং রায় দেওয়া হয়েছে তার সবই ভিত্তিহীন। এসবের ফলে নাকি যুক্তরাজ্যের একজন সম্মানিত নাগরিক হিসেবে মুঈনউদ্দিনের মানবাধিকার ও সম্মান ক্ষুণ্ন হয়েছে।
বিপরীত পক্ষ (অর্থাৎ, যুক্তরাজ্য স্বরাষ্ট্র দপ্তরের আইনজীবীরা) পাল্টা অভিযোগ আনে এই বলে, অন্য একটি দেশের আদালতে ইতোমধ্যে চূড়ান্তভাবে নিষ্পত্তিকৃত একটি বিষয় পুনরায় উত্থাপন করে মুঈনউদ্দিন যেটা করার চেষ্টা করছে তা হলো মূলত যুক্তরাজ্যের আইনব্যবস্থার অপব্যবহার। সুতরাং, মুঈনউদ্দিনের মামলাটি খারিজ করে দেওয়া হোক।
হয়তো বুঝতে পারছেন, পরোক্ষভাবে এই মামলাটির অন্যতম বিচার্য বিষয়ই হয়ে দাঁড়িয়েছে যুক্তরাজ্যের আদালতে আইসিটি আর বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থার গ্রহণযোগ্যতা যাচাই।
যুক্তরাজ্য হাইকোর্ট মুঈনউদ্দিনের মামলাটি খারিজের নির্দেশ দেন। সেই নির্দেশের বিরুদ্ধে মুঈনউদ্দিন আপিল করেন যুক্তরাজ্যের উচ্চতর আপিল আদালতে।আপিল আদালতের তিনজন বিচারকের মধ্যে দুইজন হাইকোর্টের নির্দেশের সঙ্গে একমত হন, কিন্তু একজন বিচারক মুঈনউদ্দিনের পক্ষে (অর্থাৎ মামলা খারিজের বিপক্ষে) রায় দেন। এই এক বিচারকের রায়ের ভিত্তিতে মুঈনউদ্দিন আবার আপিল করেন, এবার যুক্তরাজ্যের সুপ্রিম কোর্টে। এটাই যুক্তরাজ্যের সর্বোচ্চ আদালত।
গত ১ ও ২ নভেম্বর যুক্তরাজ্যের সুপ্রিম কোর্টে মামলার বিষয়টির চূড়ান্ত শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। প্রধান বিচারপতিসহ পাঁচ বিচারকের সামনে সেই শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। মুঈনউদ্দিন ও স্বরাষ্ট্র দপ্তরের পক্ষ থেকে দেশের প্রধান দু'টি ল'ফার্মের আইনজীবীরা সেখানে পাল্টাপাল্টি অংশ নেন।
গত চার বছর ধরে এবং বিশেষ করে গত ন'মাস ধরে আমি এই মামলার পুরো বিষয়টি নিবিড়ভাবে অনুসরণ করেছি। সরাসরি মামলার পক্ষ না হতে পারার সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও, নিজের সীমিত সাধ্য আর সামর্থ্যের মধ্যে যতটুকু সম্ভব তার শতভাগ দিয়ে চেষ্টা করে গেছি পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে এই মামলায় ১৯৭১ এর ভিকটিমদের ও আইসিটির মূল দিকগুলো সামনে নিয়ে আসার।
উদ্দেশ্য ছিল যুক্তরাজ্যের মামলার আইনজীবীদের দু’পক্ষের সাবমিশনে যে মৌলিক বিষয়গুলো একেবারেই উঠে আসেনি সেগুলোর পাশাপাশি তাদের এবং যুক্তরাজ্যের বিচারকদের করা জ্বলজ্যান্ত ভুলগুলো তুলে ধরা।
আরও পড়ুন: স্বাধীনতার ইতিহাসে তাদের স্থান কি হবে?
চূড়ান্ত বিচারে কতটুকু সফল হয়েছি তা এখনি বলা মুশকিল, কারণ যুক্তরাজ্য সুপ্রিম কোর্টে বিষয়টি এখনও চূড়ান্ত রায়ের জন্য অপেক্ষাধীন। তবে এটুকু উল্লেখ না করলেই না।
যুক্তরাজ্য সুপ্রিম কোর্টে দু'পক্ষের শুনানি শেষ হওয়া পর্যন্ত আমার অন্তত যা মনে হয়েছে, তা হলো পুরো মামলাটির শুনানি আইসিটির জন্য ইতিবাচক হয়েছে তা বলা যাবে না। যুক্তরাজ্য সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের দৃষ্টিভঙ্গী হয়তো (ধরে নিচ্ছি যদিও) অনেকাংশেই নির্ভর করেছে মুঈনউদ্দিন ও যুক্তরাজ্য স্বরাষ্ট্র দপ্তরের দুই পক্ষের আইনজীবীদের কাছ থেকে তারা এ পর্যন্ত যা শুনেছেন বা যা শুনেননি শুধু তার উপরই।
যে কোনো দিনই রায় হতে পারে। জানি না যুক্তরাজ্যের বিচারকরা কি রায় দেবেন শেষ পর্যন্ত, এবং তা কিভাবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে উদ্ধৃত ও (অপ)ব্যবহৃত হতে পারে ১৯৭১, বিচার, আর ভিকটিমদের বিরুদ্ধে!
যুক্তরাজ্য সুপ্রিম কোর্টের এই রায়টি কেন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে, সেটি জানিয়ে রাখাটা প্রয়োজন মনে করছি, যে কারণে মূলত এই লেখাটি লেখা।
চৌধুরী মুঈনউদ্দিনের এই মানহানি মামলাটিকে যুক্তরাজ্য সুপ্রিম কোর্ট যদি সর্বতোভাবে ও সর্বসম্মতিক্রমে খারিজ করে দেন তাহলে তো কিছুই বলার নেই। সেই সম্ভাবনা এখনও আছে। তেমনটি হলে এই মামলাটি হয়তো ইতিহাসের বা আইনের বইয়ের কোনো একটি ছোট ফুটনোট হয়ে থেকে যাবে।
কিন্তু রায়ে যদি এর বিপরীতটি ঘটে, অর্থাৎ, মুঈনউদ্দিনের মানহানির দাবি যদি টিকে যায়, তাহলে নিচের আশঙ্কাগুলো বাস্তব হয়ে উঠার এক ভিন্ন বাস্তবতা তৈরি হবে আমাদের সবার জন্য। অনেকগুলো সম্ভাব্য ফলাফল আর আশঙ্কার মধ্যে শুধু চারটি উল্লেখ করছি নিচে:
প্রথমত:
যুক্তরাজ্য সুপ্রিম কোর্ট মুঈনউদ্দিনের পক্ষে (অর্থাৎ আইসিটির প্রক্রিয়ার বিপক্ষে) রায় দিলে সেই রায়টি দেশে-বিদেশে যুদ্ধাপরাধী আসামিপক্ষ উদ্ধৃত করবে আইসিটির পুরো প্রক্রিয়া এবং এর প্রতিটি বিচারের রায়কে চূড়ান্তভাবে প্রশ্নবিদ্ধভাবে করার কাজে। অবশ্যই, আইনি বিচারে যুক্তরাজ্যের রায় বাংলাদেশের আইসিটির রায়ের ব্যাপারে কোনো ধরনের বাধ্যবাধকতা তৈরি করে না, তবে প্রচার/অপ-প্রচারের বিভ্রান্তিকর রাজনীতিতে এবং ১৯৭১ এর ইতিহাসকে ঘোলা করার কাজে যুক্তরাজ্যের আদালতের রায় শক্তিশালী এক হাতিয়ার হয়ে উঠবে ১৯৭১ বিরোধীপক্ষের হাতে। এই যে প্রথম সম্ভাবনার কথাটি লিখলাম, তা হলো আমার লেখা চারটি সম্ভাবনার মধ্যে সবচেয়ে কম ক্ষতিকর, কারণ বাকিগুলো আরও সুদূরপ্রসারী!
দ্বিতীয়ত:
যদি যুক্তরাজ্যের আদালতে বাংলাদেশের আইসিটির বিরুদ্ধে করা সমালোচনাগুলো ধোপে টিকে যায়, তাহলে এর প্রভাব হবে মুঈদনউদ্দিনের মামলা ছাড়িয়েও আরও বিস্তৃত। কারণ, তখন সমালোচনাগুলো পশ্চিমের এক গুরুত্বপূর্ণ আদালতের বদৌলতে এক ধরনের আইনি বৈধতার সিল পেয়ে যাবে। এই বিষয়টিকে তখন আইসিটির বিচারে দণ্ডপ্রাপ্ত সব আসামিই ব্যবহার করতে পারবে এ জাতীয় কৌশলগত মানহানি মামলায়। তাদের উদ্দেশ্য হবে ১৯৭১ ইস্যুতে নিজেদের কৃতকর্মের ইতিহাস চাপা দেওয়া। বর্তমানে যুক্তরাজ্যের আইনব্যবস্থা ও আদালত এমনিতেই এ জাতীয় মানহানি মামলার ক্ষেত্রে আকর্ষণীয় ফোরাম হয়ে উঠেছে সারাবিশ্বের অন্য সব ব্যবস্থার তুলনায়। এই সুযোগটি ঢালাওভাবে নেওয়ার সুযোগ তৈরি হবে তখন যুদ্ধাপরাধী পক্ষের দিক থেকে। এভাবে ১৯৭১ এর প্রতিষ্ঠিত ইতিহাস একটু একটু করে বিকৃত হতে থাকবে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে।
আরও পড়ুন: মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি-৩
তৃতীয়ত:
আইসিটির রায়ের পরও যদি দণ্ডিত একজন অপরাধী এই রায়কে মানহানিকর বলে যুক্তরাজ্যের আদালতে উতরে যেতে পারে, তাহলে ১৯৭১ এ সংঘটিত অপরাধগুলো (যেমন: গণহত্যা, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ, যুদ্ধাপরাধ) নিয়ে বর্তমান ও ভবিষ্যতের সব ধরনের গবেষণা আর লেখালিখির কাজ আর উদ্যোগগুলো এক বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হবে। লেখক ও গবেষকদের তখন তাদের কাজগুলো করতে হবে প্রতি পদে মানহানি মামলার খড়গ মাথায় নিয়ে। আইন বিষয়ে যাদের কিছুমাত্র ধারণা আছে তারা জানবেন কাউকে হয়রানি করতে বা আর্থিকভাবে সর্বস্বান্ত করতে মানহানি মামলার কোনো জুড়ি নেই।
চতুর্থত:
বাংলাদেশের গণহত্যার বৈশ্বিক সার্বজনীন স্বীকৃতি অর্জনের যে প্রজন্মব্যাপী আন্দোলন মাত্র শুরু হয়েছে, তার পুরোটাই এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের সম্মুখীন হবে।
আশা করি এই লেখাটি পরিস্থিতির সম্ভাব্য গুরুত্ব অনুধাবনের পাশাপাশি, সংশ্লিষ্ট সবাইকে পরবর্তী পদক্ষেপ নির্ধারণে কিছুটা হলেও সাহায্য করবে।
(প্রকাশিত মতামতের দায় লেখকের, ইউএনবির নয়)
ভোটার উপস্থিতি কতটা জরুরি?
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন যাত্রারেখায় দাঁড়িয়ে আছে। দাপ্তরিক কাজ শেষ। এখন প্রার্থীদের রিং এ ফেলে বক্স অন বলার অপেক্ষা।
নিরাপত্তার চাদরে আবৃত হয়ে নির্বাচন কমিশন কমান্ড পোস্ট থেকে দিক নির্দেশনা দিচ্ছে। তারা তৃপ্তির ঢেকুর তুলছেন যে আঁটঘাট বেঁধে সবার অংশগ্রহণে নির্বাচন করেই ছাড়বেন। তারা বলেছিল, কে এল না এল তাতে কিছু আসে যায় না। নির্বাচন হবেই।
নির্বাচন কমিশন আবার আমেরিকার কথার তোয়াক্কা করবে না বলে মাঝে মাঝে জানান দেয়। আবার ভয় যে পায় তা মাঝে মাঝে সিইসির বক্তব্যে বেফাঁস বেরিয়ে আসে। রাজনৈতিক দলগুলো তৈরি। উৎসবমুখর না হলেও বিরস মুখে ক্ষুদ্র দলগুলো সরকারি দল থেকে দুয়েকটা আসন প্রাপ্তির সুযোগ খুঁজছে। সরকারি দলের বিদ্রোহী প্রার্থীরা সংশয়ে আছে। মাঠ পর্যায়ে জনপ্রিয়তা থাকলেও তাদের নির্বাচনী ফসল ঘরে তুলে আনার সম্ভাবনা কতটুকু? সরকার ও সরকারি দল কতটুকু ক্ষমতাশালী তা বিদ্রোহী প্রার্থীরা নিজেরাই ভালো জানেন কারণ বিগত ভোটারবিহীন নির্বাচনগুলোর কুশীলব তারাই ছিলেন।
আরও পড়ুন: ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড’ উদ্যোগ প্রসঙ্গে চীনের বাংলাভাষী প্রতিভা প্রশিক্ষণের কৌশল সম্পর্কিত গবেষণা
তাহলে ভোটের মাঠে থাকছে সত্তরোর্ধ্ব একটা রাজনৈতিক দল, কিছু নামসর্বস্ব দল, কিছু নেতা সর্বস্ব লোভী ও সরকারি দলের বিদ্রোহীরা। তাহলে একটা বৃহৎ দল কার সঙ্গে নির্বাচন লড়তে যাচ্ছে? এ লড়াই কি তাদের জন্য সন্মানজনক? মর্যাদাপূর্ণ? দেশের গণতন্ত্রের জন্য মঙ্গলজনক?
এ বৃহৎ দলের একটাই প্রতিদ্বন্দ্বী দল বিএনপিকে হামলা-মামলা ও রাজনৈতিক কৌশলে নির্বাচনের বাইরে রাখা হয়েছে। ইসলামী কিছু দল এমনকি বাম দলগুলোও নির্বাচনে যাচ্ছে না। ফাঁকা মাঠে গোল দেওয়া কোনো সাহসিকতার কাজ নয়। দেশ-বিদেশে গ্রহণযোগ্যতাও পাবে না। তার কি কোনো বিকল্প নেই?
ধরে নিলাম সব ঠিক চলছে। ভালোমন্দ মিলিয়ে নির্বাচন অনুষ্ঠানের সাজসজ্জা তৈরি। দল আছে, প্রার্থী আছে, পরিচালনাকরিরাও প্রস্তুত। তারপরও ভোটার উপস্থিতির শঙ্কা। ভোটাররা ভোটকেন্দ্রে যাবেন এটাই আশা। কিন্তু ভোটাররা কাকে ভোট দিতে যাবেন।
একটা দলেরই যোগ্য প্রার্থী আছে, বিপরীতে যারা আছে তারা কি গণতন্ত্রের সংজ্ঞায় রাজনৈতিক দল? তাহলে একমাত্র বৃহৎ দলের যোগ্য প্রার্থীরাই জিতবেন। তাদের মাঝে মন্ত্রী, এমপি সবাই সিংহাসনে আসীন। এসব যোগ্যদের জেতানোর জন্য সবাই একাট্টা। নির্বাচনটা গ্রহণযোগ্য হতে হবে।
ভোটার হাজির করার দায়িত্ব কারোই নয়। ভোটারের নিজের দায়িত্ব এটা। দেশের সুনাগরিক এ দায়িত্ব পালন করতে বাধ্য। সবাই সুনাগরিক নয়। তাহলে ভোটারদের কষ্ট করে ভোট কেন্দ্রে যাওয়ার দরকার আছে? এর চেয়ে নিজের জীবন জীবিকার জন্য দিনটি ব্যয় করা উত্তম।
নির্বাচনে প্রার্থীরা নিজেদের সাফল্য জাহির ও প্রতিদ্বন্দ্বীদের নেতিবাচক দিক তুলে ধরেন। ক্ষমতায় বহাল সরকার, এমপি-মন্ত্রীদের কোনো সমালোচনা বা নেতিবাচক কথা বললেই সাইবার আইনে ফেঁসে যাওয়ার সমুহ সম্ভাবনা। তাহলে নির্বাচনটা সেভাবে প্রভাবিত হবে না বলে নিশ্চয়তা কেউ দেবে? এটা ধরে নেওয়া যায় যে ভোটাররা ভোটকেন্দ্রে যেতে দ্বিধান্বিত হবেন।
নির্বাচন অনুষ্ঠানের সব প্রস্তুতি সম্পন্ন। উৎসব মুখর ভোট হবে, এমপি-মন্ত্রীদের সুযোগ-সুবিধা ও সম্পদ বৃদ্ধি ঘটবে। জিন্দাবাদ মূর্দাবাদ করে কর্মীরা ক্লান্ত হয়ে খালি হাতে ঘরে ফিরবে। কোনো কিছু কি জনগণের ভাগ্যে যাবে?
(বি.দ্র. ইউএনবির সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামত নাও মিলতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো দায়ভার ইউএনবি নেবে না।)
আরও পড়ুন: চীনে আঞ্চলিক ও দেশীয় অধ্যয়নের উন্নয়ন
ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বাংলাদেশের জরুরি জলবায়ু তহবিল প্রয়োজন: প্রধানমন্ত্রী
চীনে আঞ্চলিক ও দেশীয় অধ্যয়নের উন্নয়ন
সারসংক্ষেপ
আঞ্চলিক ও দেশীয় অধ্যয়ন একটি গুরুত্বপূর্ণ শৃঙ্খলা। অনেক বড় দেশ আঞ্চলিক ও দেশীয় অধ্যয়নকে অত্যন্ত গুরুত্ব দেয়। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে, চীনের স্টেট কাউন্সিলের একাডেমিক ডিগ্রি কমিটি “পিএইচডি, মাস্টার্স ডিগ্রি প্রদানের পেশাদার ক্যাটালগ” জারি করে। “ট্যালেন্ট ট্রেনিং ডিসিপ্লিনস (মন্তব্যের জন্য খসড়া)”, এর ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি, আঞ্চলিক ও দেশীয় অধ্যয়ন আন্তঃবিভাগীয় বিভাগের অধীনে প্রথম স্তরের শৃঙ্খলা হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়। একই সঙ্গে চীনের আঞ্চলিক ও দেশীয় অধ্যয়ন উন্নয়নের একটি নতুন পর্যায়ে প্রবেশ করে।
মূল শব্দ: আঞ্চলিক ও দেশীয়, চীন, শৃঙ্খলা নির্মাণ
১ . আঞ্চলিক ও দেশীয় অধ্যয়নের উন্নয়নের প্রেক্ষাপট
১.১ আঞ্চলিক ও দেশীয় গবেষণার উৎস
আরও পড়ুন: দক্ষিণ এশিয়ার জ্বালানি বিকাশে নবদিগন্তের হাতছানি
আঞ্চলিক ও দেশীয় অধ্যয়ন মূলত ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে ফ্রান্স, রাশিয়া, জার্মানি ও হ্যাবসবার্গ সাম্রাজ্যে "প্রাচ্যবাদ" এর একটি শাখা হিসেবে আবির্ভূত হয়। পাশ্চাত্যের বণিক বা ধর্মপ্রচারক যারা প্রাচ্যে ভ্রমণ করেছিলেন তারা তাদের নিজস্ব উপলব্ধির সঙ্গে জ্ঞান, কিংবদন্তি ও কল্পনার মতো অনেক কারণকে একত্রিত করেছিলেন। তারা প্রাচ্যের সাংস্কৃতিক রীতিনীতি, আইন, প্রথা ইত্যাদিকে পাশ্চাত্য দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেছিলেন। তারা সত্য ও মিথ্যা তথ্য নিয়ে পাশ্চাত্যে ফিরে যান। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রিটেন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নির্দিষ্ট আঞ্চলিক ও দেশীয় অধ্যয়ন স্কুলের প্রতিষ্ঠা শুরু হয়। তারা প্রধানত মানবিক বিষয়ে ফোকাস করে এবং ভাষা, ইতিহাস, রীতিনীতি, আইন ও সাহিত্য শেখায়(জরান,২০১৯)।
১.২ আধুনিক আঞ্চলিক ও দেশীয় অধ্যয়ন
আধুনিক এলাকা অধ্যয়নের উৎস দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং যুদ্ধ পরবর্তী সময়কাল থেকে খুঁজে পাওয়া যায়। মার্কিন সরকারের গোয়েন্দা তথ্য এবং সামরিক প্রয়োজনের কারণে, প্রাথমিক এলাকা অধ্যয়ন কেন্দ্রটি অফিস অব স্ট্র্যাটেজিক সার্ভিসেসের অফিসে অবস্থিত ছিল।
প্রারম্ভিক বিশ্ববিদ্যালয়ের এলাকা অধ্যয়ন কোর্সের সঙ্গে সরকারি গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল (হুসাইন,২০১১)৷ মার্কিন সরকার রুথ বেনেডিক্টকে কমিশন দিয়েছে, রুথ জাপানের সংস্কৃতি ও সমাজ অধ্যয়ন করেছে, যার ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জাপান দখলের জন্য পরবর্তী নীতি প্রণয়ন করতে এবং জাপানি অধ্যয়নের প্রবণতা চালু করতে সহায়তা করে(লুস,২০০৮)।
১৯৬০-এর দশকে, আঞ্চলিক ও দেশীয় অধ্যয়ন তুলনামূলক রাজনীতির সঙ্গে একত্রে বিকশিত হয় এবং কিছু আঞ্চলিক তুলনামূলক অধ্যয়ন শুরু হয়। ১৯৬০ সালে অ্যালমন্ড ও অন্যদের দ্বারা সম্পাদিত "দ্য পলিটিক্স অব ডেভেলপিং রিজিয়ন" ছিল প্রারম্ভিক আঞ্চলিক গবেষণায় একটি বিশ্বকোষ, যা প্রতিটি অঞ্চলের ইতিহাস, প্রক্রিয়া, গঠন ও কার্য বিশ্লেষণ করে(বালিন্দুন,২০১৩)।
১.৩ নতুন যুগে আঞ্চলিক গবেষণার উন্নয়ন
১৮৭০ থেকে ১৮৯০ এর দশক পর্যন্ত, আঞ্চলিক গবেষণা পদ্ধতি মানবিক ও সামাজিক বিজ্ঞানের মধ্যে পরিপূরকতা দেখাতে শুরু করে। এই সময়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো তুলনামূলক রাজনীতি বিজ্ঞানসম্মত হতে শুরু করে। বিপুল সংখ্যক পণ্ডিত প্রকৃত স্থানীয় পরিস্থিতি বোঝার জন্য দীর্ঘমেয়াদি পর্যবেক্ষণ ও মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে কার্যকারণ প্রক্রিয়া আবিষ্কার করতে শুরু করেন। সবচেয়ে বিখ্যাত কেস হলো দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার উপর জেমস স্কটের গবেষণা। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় কৃষকদের আচরণ পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে, তিনি স্থানীয় কৃষকদের প্রতিরোধের কারণ এবং কীভাবে তারা "দুর্বলদের অস্ত্র" ব্যবহার করেছিলেন তা পর্যবেক্ষণ করেছিলেন(জেমস,২০১১)।
১৯৯০ এরপর, বিশ্বায়নের বিকাশ ও স্নায়ুযুদ্ধের অবসানের প্রেক্ষাপটে, কিছু গবেষক "প্রথাগত আঞ্চলিক দেশ অধ্যয়ন" ও "অঞ্চলভিত্তিক জ্ঞান" এর মধ্যে পার্থক্য করার প্রয়োজনীয়তার প্রস্তাব করেন। আঞ্চলিক জ্ঞান থেকে বিকশিত সাধারণ তত্ত্বের চাহিদা পরিবর্তিত হওয়ার সঙ্গে আঞ্চলিক ও দেশীয় গবেষণা পদ্ধতি আরও বৈজ্ঞানিক হয়ে উঠেছে। অবশ্যই, সেই সময়কালে পদ্ধতিগত বিবাদে জড়িত হওয়া অনিবার্য ছিল।
আরও পড়ুন: ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড’ উদ্যোগ প্রসঙ্গে চীনের বাংলাভাষী প্রতিভা প্রশিক্ষণের কৌশল সম্পর্কিত গবেষণা
২. চীনে আঞ্চলিক ও দেশীয় গবেষণার উন্নয়ন
২.১ চীনে আঞ্চলিক ও দেশীয় অধ্যয়নের ঐতিহ্য
একটি দীর্ঘ ইতিহাসযুক্ত প্রাচীন সভ্যতা হিসেবে চীনের আঞ্চলিক ও দেশীয় গবেষণার একটি গভীর ঐতিহ্য রয়েছে। "ঐতিহাসিক রেকর্ড"-এ কোরিয়া ও দাওয়ানের(উজবেকিস্তান) ঐতিহাসিক নথিগুলোকে প্রতিবেশী দেশগুলোর দেশভিত্তিক গবেষণা হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে। কেন্দ্রীয় রাজবংশের পরবর্তী সরকারি "ঐতিহাসিক রেকর্ড"র ঐতিহ্য অনুসরণ করে এবং আশেপাশের অঞ্চলের জাতিগত গোষ্ঠী, জাতি ও দেশগুলোকে নথিভুক্ত করে, প্রাসঙ্গিক গবেষণার ঐতিহাসিক উত্তরাধিকার প্রদর্শন করে।
কিং রাজবংশের শেষের দিকে, পশ্চিমা দেশগুলো চীনের দরজা খুলতে শক্তি প্রয়োগ করে এবং চীনের মূলধারার বুদ্ধিজীবীরা "বিশ্বকে দেখার জন্য তাদের চোখ খুলতে" শুরু করে। এই সময়কালে বাহ্যিক বিশ্বের অবস্থার উপর অনেকগুলো মনোগ্রাফ তৈরি হয়েছিল, যার মধ্যে সবচেয়ে প্রতিনিধিত্বকারী ছিল "ইং হুয়ান ঝি লু"।
চীন প্রজাতন্ত্রের সময়, ড. সান ইয়াত-সেনের সচিব দাই জিতাও-এর "অন জাপান" লিখেছেন (১৯২৮)। সাধারণভাবে বলতে গেলে, একটি দীর্ঘ গবেষণার ঐতিহ্য থাকা সত্ত্বেও, নতুন চীন প্রতিষ্ঠার আগে চীনা বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের বহির্বিশ্ব সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন ও সঞ্চয়ন ছিল স্বতঃস্ফূর্ত, আদিম, বিক্ষিপ্ত ও সরল গবেষণার পর্যায়। তখন কোনো নিয়মতান্ত্রিক জ্ঞান ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়নি এবং কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাও ছিল না।
২.২ চীনের আধুনিক আঞ্চলিক ও দেশীয় অধ্যয়ন
চীনের আধুনিক আঞ্চলিক ও দেশীয় অধ্যয়ন শুরু হয়েছিল নতুন চীন প্রতিষ্ঠার প্রথম দিকে। ১৯৫৪ সালের এপ্রিল থেকে জুলাই পর্যন্ত, প্রধানমন্ত্রী ঝৌ এনলাই জেনেভা সম্মেলনে যোগদানের জন্য একটি প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন।
নতুন চীন প্রথমবারের মতো পাঁচটি প্রধান শক্তির মধ্যে একটি হিসেবে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রবেশ করে। একই বছরের ৭ জুলাই, চীনের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিসি) কেন্দ্রীয় কমিটির রাজনৈতিক ব্যুরোর বর্ধিত সভায় ঝৌ এনলাইয়ের প্রতিবেদন শোনা যায়। নতুন চীনে পদ্ধতিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক আঞ্চলিক ও দেশীয় অধ্যয়ন শুরু হয়।
১৯৫৬ সালে, চীনের একাডেমি অব সায়েন্সেসের ইন্টারন্যাশনাল রিলেশনস ইনস্টিটিউট এবং জিয়ামেন ইউনিভার্সিটির নানিয়াং ইনস্টিটিউট ধারাবাহিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। পরবর্তীকালে, অনেকে ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ প্রতিষ্ঠা করে। পরবর্তীকালে, পিকিং ইউনিভার্সিটি, চীনের রেনমিন ইউনিভার্সিটি এবং ফুদান ইউনিভার্সিটি যথাক্রমে ১৯৬৪ সালে আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিভাগ স্থাপন করে। চীনের বিশ্ববিদ্যালয় বিদেশি গবেষণা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার চূড়ান্ত পর্যায়েরও সূচনা করে।
২.৩ সমসাময়িক চীনের আঞ্চলিক ও দেশীয় গবেষণা
সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময় সংক্ষিপ্ত বিপর্যয়ের সম্মুখীন হওয়ার পর, চীনে আঞ্চলিক ও দেশীয় অধ্যয়নের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ সংস্কার ও উন্মুক্তকরণের পর থেকে ব্যাপক অগ্রগতি লাভ করে। ১৯৮০ সালে, চায়না ইনস্টিটিউট অব কনটেম্পোরারি ইন্টারন্যাশনাল রিলেশনস প্রতিষ্ঠিত হয়। পরে বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও বিশ্ববিদ্যালয় আঞ্চলিক ও দেশীয় গবেষণা ইউনিট প্রতিষ্ঠা করতে থাকে। একবিংশ শতাব্দীতে, যখন চীন দেশের গবেষণার প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ গভীরতর হচ্ছে, তখন আঞ্চলিক ও দেশীয় অধ্যয়নও তাদের শৃঙ্খলাবদ্ধকরণকে ত্বরান্বিত করতে শুরু করেছে।
আরও পড়ুন: ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বাংলাদেশের জরুরি জলবায়ু তহবিল প্রয়োজন: প্রধানমন্ত্রী
১৯৯৯ সালে, চীনের শিক্ষা মন্ত্রণালয় মানবিক ও সামাজিক বিজ্ঞানের নয়টি মূল গবেষণা ভিত্তি স্থাপন করে যাতে আন্তর্জাতিক বিষয় জড়িত থাকে এবং উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে আঞ্চলিক ও দেশীয় অধ্যয়ন সম্পূর্ণ মনোযোগ পায়। পরবর্তীকালে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ২০১১ সালে "জাতীয় ও আঞ্চলিক গবেষণা চর্চা ফাউন্ডেশন" প্রকল্প চালু করে এবং ২০১৫ সালে প্রশিক্ষণ ও নির্মাণ পদ্ধতি জারি করে।
৩. চীনের আঞ্চলিক ও দেশীয় গবেষণার বৈশিষ্ট্য
৩.১ নিয়মানুবর্তিতা: শৃঙ্খলা ব্যবস্থা নির্মিত হচ্ছে
ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বাংলাদেশের জরুরি জলবায়ু তহবিল প্রয়োজন: প্রধানমন্ত্রী
জলবায়ু সংকটের প্রভাব প্রমত্তা পদ্মা নদীর পানিতে প্রতিফলিত হয়েছে। তবুও এই জরুরি পরিস্থিতিতে বিশেষত প্রশমন, অর্থ এবং অভিযোজনের ক্ষেত্রে প্রতিক্রিয়া ধীর রয়ে গেছে। থমসন রয়টার্স ফাউন্ডেশনের মিডিয়া প্লাটফর্ম কনটেক্সট ফর কনটেক্সটে এক মতামত নিবন্ধে এ মন্তব্য করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কপ-২৮ সম্মেলনে এসব ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতির ওপর গুরুত্বারোপ করেন। মূল লক্ষ্যগুলোর মধ্যে রয়েছে ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস উষ্ণতার সীমা বজায় রাখা, গ্লোবাল স্টকটেকের ফলে উচ্চাকাঙ্ক্ষা বৃদ্ধি নিশ্চিত করা এবং বিশেষত বাংলাদেশের মতো ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর জন্য জরুরিভাবে অর্থ সংগ্রহ করার বিষয়টি নিয়েও তিনি লিখেছেন।
আরও পড়ুন: কপ-২৮ সম্মেলন : শুক্রবার শুরু হচ্ছে মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠক
বৈশ্বিক কার্বন নিঃসরণের জন্য বাংলাদেশ মাত্র শূন্য দশমিক ৪৭ শতাংশ দায়ী হলেও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সপ্তম ঝুঁকিপূর্ণ দেশ। প্রধানমন্ত্রীর মতে, বাংলাদেশ কয়েক দশক ধরে ক্রমবর্ধমান নির্গমনের পরিণতি সহ্য করেছে। যার প্রমাণ ৪০ ডিগ্রির ওপরে তাপমাত্রা, তীব্র তাপপ্রবাহ, বিদ্যুৎ বিভ্রাট, স্কুল বন্ধ এবং বিধ্বংসী বন্যা, যা কেবল আগস্টেই ৫৫ জনের মৃত্যু এবং হাজার হাজার মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে।
তিনি লিখেছেন, বাংলাদেশ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের সময় জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে সক্রিয়ভাবে বিনিয়োগ করেছে। মুজিব জলবায়ু সমৃদ্ধি পরিকল্পনায় ২০৩০ সালের মধ্যে নবায়নযোগ্য জ্বালানি সক্ষমতা ৩০ শতাংশে উন্নীত করা, টেকসই কৃষি রক্ষণাবেক্ষণ এবং বিদ্যুৎ গ্রিডের আধুনিকায়নসহ জলবায়ু সহনশীলতার জন্য একটি রূপান্তরমূলক কৌশলের রূপরেখা দেওয়া হয়েছে।
বন্যা প্রতিরোধ, সমুদ্রপ্রাচীর, ম্যানগ্রোভ বন নির্মাণ এবং স্যাটেলাইট আবহাওয়া ট্র্যাকিং সিস্টেম বাস্তবায়নে বাংলাদেশের প্রচেষ্টা বিস্তৃত রয়েছে। এই উদ্যোগগুলো দেশের জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনার অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং বেঁচে থাকার জন্য অপরিহার্য।
এছাড়া, অভিযোজন আন্তঃসংযুক্ত অর্থনীতি এবং খাতগুলোতে প্রবৃদ্ধি অন্তর্ভুক্ত করার জন্য পরিবেশগত ব্যবস্থার বাইরেও প্রসারিত। এর জন্যও উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগ প্রয়োজন। এরমধ্যে রয়েছে সৌর প্রযুক্তিকে আরও সাশ্রয়ী মূল্যের করা, ইনভার্টারের উপর কর সংশোধন করা এবং আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা।
কপ-২৮-এর নেতারা অভিযোজন তহবিলে ১৬৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলারির প্রতিশ্রুতি দিলেও, এটি বার্ষিক ৩০০ মিলিয়ন ডলারের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কম। ধনী দেশগুলোকে তাদের দায়িত্ব পালনের আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
আরও পড়ুন: গোপালগঞ্জ সফরে নির্বাচনী আচরণবিধি রক্ষা করেছেন প্রধানমন্ত্রী
কপ-২৮-এ সীমিত সময় বাকি থাকায় তিনি কার্বন নিঃসরণকারী বৃহত্তম দেশগুলোকে ন্যাশনালি ডিটারমাইন্ড কন্ট্রিবিউশন (এনডিসি) এবং উন্নত দেশগুলোকে প্রতি বছর ১০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অর্থায়নের লক্ষ্যমাত্রা পূরণের আহ্বান জানান।
শেখ হাসিনার মতে, জলবায়ু অর্থায়নকে অবশ্যই তিনটি মানদণ্ড পূরণ করতে হবে: বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর জন্য সামনের ঝুঁকিপূর্ণ বছরগুলো বিবেচনা করে পর্যাপ্ততা, ধারাবাহিকতা এবং ব্যবহার যোগ্যতা। তিনি আন্তর্জাতিক অংশীদারদের অভিন্ন লক্ষ্য, সিদ্ধান্তমূলক পদক্ষেপ এবং আরও বিলম্বের ব্যয় স্বীকার করার জন্য গভীরভাবে চিন্তা ভাবনা করার আহ্বান জানান। চলমান প্রচেষ্টার প্রশংসা করার পাশাপাশি তিনি সর্বশেষ বিজ্ঞানের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সংহতিরও আহ্বান জানান।
জলবায়ু ঝুকিঁ তীব্র হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্মিলিতভাবে এবং সিদ্ধান্তমূলকভাবে তাদের মোকাবিলা এবং তুলে ধরার গুরুত্বের উপর জোর দেন।
আরও পড়ুন: বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়ন বেগম রোকেয়ার স্বপ্ন পূরণ করেছে: প্রধানমন্ত্রী
‘বেল্ট অ্যান্ড রোড’ উদ্যোগ প্রসঙ্গে চীনের বাংলাভাষী প্রতিভা প্রশিক্ষণের কৌশল সম্পর্কিত গবেষণা
সারসংক্ষেপ
‘বেল্ট অ্যান্ড রোড’ উদ্যোগ চীনের শিক্ষার ক্ষেত্রে ‘নন-কমন ল্যাঙ্গুয়েজ’র প্রতিভা প্রশিক্ষণের জন্য নতুন প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। এই নিবন্ধে চীনের বাংলাভাষী প্রতিভার (চীনের বাংলা ভাষার শিক্ষার্থী) বর্তমান পরিস্থিতি আলোচনা করা হয়েছে। সেই সঙ্গে বাংলাভাষী প্রতিভা প্রশিক্ষণের কৌশলগত তাৎপর্য তুলে ধরে চীনে বাংলাভাষী প্রতিভা প্রশিক্ষণের কৌশল সম্পর্কে কিছু পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
আরও পড়ুন: কোন দেশে বেশি স্মার্টফোন ব্যবহার, বেশি মানসিক রোগ?
মূল শব্দ: ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড’, বাংলাভাষী প্রতিভা
ভূমিকা
প্রাচীনকাল থেকেই চীন ও বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চলগুলোর মধ্যে যোগাযোগ ছিল। নিউ তাং রাজবংশের দ্বিতীয় খণ্ডের ২২১(পর্ব) প্রাচীন ভারতীয় মগধ রেকর্ড করেছে। মিং ইতিহাসের ৩২৬ খণ্ডেও ‘বাংলা’র কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ১৯৭৫ সালে চীন ও বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের পর উভয়পক্ষ রাজনীতি, অর্থনীতি, সামরিক ও সংস্কৃতিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে কার্যকর সহযোগিতা করেছে। দুই দেশের উচ্চ পর্যায়ের নেতারা দুই দেশ সফর করেছেন। এছাড়া বিভিন্ন বিষয় নিয়ে মতবিনিময় বাড়ছে এবং সহযোগিতার ক্ষেত্র প্রসারিত হচ্ছে।
(১) নন-কমন ল্যাঙ্গুয়েজ নির্মাণের কৌশলগত তাৎপর্য
নেলসন ম্যান্ডেলা বলেছিলেন, "আপনি যদি কোনো লোকের সঙ্গে এমন ভাষায় কথা বলেন যা তিনি বোঝেন, এটি তার মনে থাকবে। আপনি যদি তার নিজের ভাষায় তার সঙ্গে কথা বলেন, তিনি স্মরণ করবেন।” ভাষা ও চিন্তার সম্পর্ক নিয়ে অনুমানকে সামনে রেখেছিলেন আমেরিকান সাপির ও তার শিষ্য ওল্ফ। তারা বিশ্বাস করেন, সমস্ত উচ্চ পর্যায়ের চিন্তাভাবনা ভাষার উপর নির্ভর করে। (সাপির, ১৯২১), ভাষার কাঠামো একটি নির্দিষ্ট সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর সদস্যদের আচরণ ও চিন্তাভাবনা নির্ধারণ করে অনুমানটি স্পষ্ট করেন সাপির-ওল্ফ। সুতরাং, অন্যান্য দেশের সংস্কৃতি ও চিন্তাভাবনা বোঝার জন্য, আরও ভালো আন্তর্জাতিক যোগাযোগ ও মিডিয়া বিষয়ক যোগাযোগ বাড়াতে নন-কমন ল্যাঙ্গুয়েজের নির্মাণ গুরুত্বপূর্ণ।
বৈশ্বিক কৌশলগত বিন্যাস ও সম্প্রসারণে, অনেক দেশ নন-কমন ল্যাঙ্গুয়েজ নির্মাণকে জাতীয় কৌশলের উচ্চ পর্যায়ে উন্নীত করেছে। চীনের নন-কমন ল্যাঙ্গুয়েজ কৌশল নির্মাণকাজ একবিংশ শতাব্দীতে একটি নতুন পর্যায়ে প্রবেশ করেছে। চীনের শিক্ষা মন্ত্রণালয় ‘জাতীয় নন-কমন ল্যাঙ্গুয়েজ আন্ডারগ্রাজুয়েট ট্যালেন্ট ট্রেনিং বেস’ ও ‘স্পেশালিটি কনস্ট্রাকশন সাইটস’ সহায়তা পরিকল্পনা তৈরি করেছে। চীন তার নিজ দেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্কযুক্ত দেশগুলোর সরকারি ভাষা (৮৮টি নন-কমন ল্যাঙ্গুয়েজ) পড়াতে বিশ্ববিদ্যালয়কে সহায়তা দেবে।
‘বেল্ট অ্যান্ড রোড’ উদ্যোগ নির্মাণের মূল চাবিকাঠি হলো আন্তঃসংযোগ। আর ভাষার আন্তঃযোগিতা হলো আন্তঃসংযোগ অর্জনের ভিত্তি। ভাষা পরিকল্পনার কৌশলগুলো প্রচারের ফলে নন-কমন ল্যাঙ্গুয়েজের প্রতিভা প্রশিক্ষণের পরিমাণ, গুণমান ও কার্যকারিতা বৃদ্ধির উচ্চতর প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে।
(২) চীনের বাংলাভাষী প্রতিভা প্রশিক্ষণের কৌশলগত তাৎপর্য
বাংলা ভাষা বাঙালি জাতির মাতৃভাষা, জাতিগত সংস্কৃতি, ধারণার বাহক ও জাতীয় আত্মবিশ্বাসের প্রতীক। নোবেল পুরস্কার বিজয়ী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার সাহিত্য সৃষ্টির জন্য বাংলা ভাষা ব্যবহার করেন। ১৯৫২ সালে পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমানে বাংলাদেশ) মাতৃভাষার অধিকার রক্ষার জন্য ‘ভাষা আন্দোলন’ হয়। এই আন্দোলন বাংলাদেশের জনগণের জাতিগত ভাবনা জাগিয়ে তোলে এবং শেষ পর্যন্ত স্বাধীনতা যুদ্ধে রূপান্তরিত হয়। বাংলাদেশিদের কাছে বাংলা ভাষা হয়ে উঠেছে সাংস্কৃতিক প্রতীক, জাতীয় গর্ব ও জাতীয় পরিচয়ের প্রতীক। ‘বাংলাদেশি সংস্কৃতি একটি সম্মিলিত সংস্থান; যা শ্রেণি, অঞ্চল ও ধর্মীয় সীমানা জুড়ে বাংলাদেশিদের ঘনিষ্ঠ ইউনিটে আলোকিত করতে পারে।’ (উইলিয়াম ভন শ্যান্ডেল, ২০১১)
‘বেল্ট অ্যান্ড রোড’র অন্তর্ভুক্ত একটি দেশ হিসাবে, বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক বিষয়গুলোতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে এবং মূলত কয়েকটি বড় আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক ইস্যুতে চীনের সঙ্গে একমত হয়। আন্তর্জাতিক বিষয়ে চীন ও বাংলাদেশের নেতারা নিবিড়ভাবে সহযোগিতা করেন এবং বিভিন্ন বিষয়ে মতবিনিময় করেন। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীন-বাংলাদেশ অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সহযোগিতা জোরালোভাবে বিকাশ লাভ করেছে। চীন বাংলাদেশের বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার হয়ে উঠেছে। চীনের দক্ষিণ এশিয়ায় তৃতীয় বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার বাংলাদেশ এবং তৃতীয় বৃহত্তম ইঞ্জিনিয়ারিং চুক্তি বাজার। বাংলাভাষী প্রতিভা প্রশিক্ষণ চীন ও বাংলাদেশের মধ্যে সাংস্কৃতিক আদান-প্রদান এবং পারস্পরিক বিশ্বাসের সঙ্গে সম্পর্কিত। এটি ভালো প্রতিবেশী ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়তে এবং আন্তঃসংযোগ বাড়ানোর নিশ্চয়তা দিতে পারে।
আরও পড়ুন: দক্ষিণ এশিয়ার জ্বালানি বিকাশে নবদিগন্তের হাতছানি
২. ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ প্রসঙ্গে চীনের বাংলাভাষী প্রতিভা প্রশিক্ষণের বর্তমান পরিস্থিতি
(১) পেশাদার প্রতিষ্ঠানের তালিকাভুক্তির পরিমাণ কম
চীনের মূল ভূখণ্ডে বর্তমানে শুধু পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা বিষয়ে চার বছর মেয়াদি স্নাতক পর্যায়ের কোর্স চালু রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হলো চীন যোগাযোগ বিশ্ববিদ্যালয়, ইউনান ন্যাশনালিটিস বিশ্ববিদ্যালয়, গুয়াংডং ইউনিভার্সিটি অব ফরেন স্টাডিজ, বেইজিং ফরেন স্টাডিজ ও ইউনান বিশ্ববিদ্যালয়। এ ছাড়াও, পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ে মাইনর কোর্স হিসেবে বাংলা ভাষা চালু রয়েছে।
নিবন্ধনের বছর অনুযায়ী, চীন যোগাযোগ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। এখানে বাংলা বিভাগ ১৯৬৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং এ পর্যন্ত মাত্র সাতটি ব্যাচ এখান থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেছে। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা মেজর ২০১৬ সালের পরে নামভুক্ত হয়। ইউনান ন্যাশনালিটিস ইউনিভার্সিটি ২০১৬ সালে, গুয়াংডং ইউনিভার্সিটি অব ফরেন স্টাডিজ ২০১৭ সালে, বেইজিং ফরেন স্টাডিজ ২০১৮ সালে এবং ইউনান বিশ্ববিদ্যালয় ২০২০ সালে।
তালিকাভুক্তির পরিমাণের ক্ষেত্রে, চীন যোগাযোগ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় ২০ জন, গুয়াংডং ইউনিভার্সিটি অব ফরেন স্টাডিজে প্রায় ১২ জন, ইউনান ন্যাশনালিটিস ইউনিভার্সিটিতে প্রায় ১৫ জন, বেইজিং ফরেন স্টাডিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় ১০ জন এবং ইউনান বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০ জন শিক্ষার্থী রয়েছেন। সামগ্রিক অর্থে শিক্ষার্থী ভর্তির পরিসর ছোট এবং প্রতি বছর শিক্ষার্থী ভর্তির পরিকল্পনাও নেই। ২-৪ বছরের মধ্যে শুধু একবার শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়।
তবে গুয়াংডং ইউনিভার্সিটি অব ফরেন স্টাডিজ প্রতি বছর বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী ভর্তি করে। চীনা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে এত ঘন ঘন শিক্ষার্থী ভর্তির স্কুল আর নেই। বর্তমানে গুয়াংডং ইউনিভার্সিটি অব ফরেন স্টাডিজের প্রথম বাংলা ভাষা স্নাতক কোর্সের দুটি ব্যাচ রয়েছে।
(২) শিক্ষকদের দক্ষতা অপর্যাপ্ত
শিক্ষকদের দৃষ্টিকোণ থেকে, চীনের বাংলা ভাষা বিষয়ে চীনা শিক্ষকদের শিক্ষাগত যোগ্যতা স্বল্প, পেশাগত ডিগ্রি কম এবং শিক্ষণ অভিজ্ঞতাও অপর্যাপ্ত। যে কয়েকজন অভিজ্ঞ প্রবীণ শিক্ষক ছিলেন তারা অবসর নিয়েছেন, কেবলমাত্র একজন শিক্ষক আছেন যিনি ১০ বছরের বেশি সময় ধরে বাংলা ভাষা পড়াচ্ছেন। এ ছাড়া বর্তমানে যেসব শিক্ষক আছেন তাদের বেশিরভাগই সবেমাত্র স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেছেন।
চীন যোগাযোগ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে দুজন চীনা শিক্ষক আছেন। ইউনান ন্যাশনালিটিস ইউনিভার্সিটির বাংলা বিভাগে তিনজন চীনা শিক্ষক আছেন। বেইজিং ফরেন স্টাডিজের বাংলা বিভাগে শুধু একজন চীনা শিক্ষক আছেন এবং ইউনান বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে তিনজন চীনা শিক্ষক আছেন। গুয়াংডং ইউনিভার্সিটি অব ফরেন স্টাডিজের বাংলা ভাষা বিভাগে মোট ৬ জন শিক্ষক রয়েছেন। তাদের মধ্যে ৪ জন চীনা শিক্ষক ও ২ জন বাংলাদেশি শিক্ষক। মোট শিক্ষকের সংখ্যায় এখানে চীনের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বাংলা ভাষা বিষয়ে সর্বাধিক। তবে শিক্ষকদের একাডেমিক স্তর ও পাঠদানের অভিজ্ঞতাও উন্নত করা দরকার।
(৩) উচ্চ পর্যায়ের বাংলাভাষী প্রতিভার ঘাটতি
চীনে বাংলাভাষী প্রতিভার কাঠামোগত ঘাটতি রয়েছে। প্রশিক্ষণ এখনও স্নাতক ডিগ্রি পর্যায়ে রয়েছে। চীনের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বাংলা ভাষা বিষয়ে এখনও স্নাতকোত্তর পর্যায়ের কোনো কোর্স চালু হয়নি। অনেক শিক্ষার্থী অন্যান্য বিষয়ে স্নাতকোত্তর পড়েন বা সরাসরি চাকরি করেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তাদের চাকরির সঙ্গে বাংলা ভাষার কোনো সম্পর্ক নেই।
‘বেল্ট অ্যান্ড রোড’ উদ্যোগের প্রেক্ষাপটে, বাজারে এমন উচ্চ-পেশাদার প্রতিভার প্রয়োজন আছে; যারা দেশের ভাষা, সংস্কৃতি ও জাতীয় পরিস্থিতি জানে এবং অর্থায়নে পেশাদার জ্ঞান অর্জন করে, যেমন- আইন, অর্থনীতি, বাণিজ্য ইত্যাদি। যে দেশে বিনিয়োগ করছেন, সে দেশের জাতীয় পরিস্থিতি ও সংস্কৃতি না বোঝার কারণে ইঞ্জিনিয়ারিং প্রকল্পের ব্যর্থতা ও বিনিয়োগের ক্ষতির অনেক ঘটনা ঘটেছে।
আরও পড়ুন: বেদনায় ভরা দিন: শেখ হাসিনা
দক্ষিণ এশিয়ার জ্বালানি বিকাশে নবদিগন্তের হাতছানি
যুগান্তকারী একটি জ্বালানি জোট শিগগিরই বদলে দিতে যাচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ার বিদ্যুতের প্রেক্ষাপট। সম্প্রতি ভারত, বাংলাদেশ ও নেপালের মধ্যে একটি ত্রিপক্ষীয় চুক্তি সই হয়েছে। এর বৌদলতে নবদিগন্তের হাতছানি দেখা যাচ্ছে এ অঞ্চলের বিদ্যুতের বিকাশে। চলতি বছরের জুনে নেপালের প্রধানমন্ত্রী পুষ্প কমল দাহাল ভারত সফরে এলে সই হয় এ চুক্তি।
এটি ভারতের শক্তিশালী ট্রান্সমিশন অবকাঠামোর মাধ্যমে নেপাল থেকে বাংলাদেশে জলবিদ্যুৎ প্রবাহের নতুন এক দ্বার উন্মোচন করেছে। এতে একদিকে যেমন জ্বালানি সংকটের কারণে বাংলাদেশের ফের ব্ল্যাকআউট হওয়ার শঙ্কা দূর হলো, তেমনি অন্যদিকে ৯৭ শতাংশ জলবিদ্যুতে আশীর্বাদপুষ্ট নেপালের উদ্বৃত্ত বিদ্যুৎ একটি কাঙ্ক্ষিত বাজারও খুঁজে পেল।
সেইসঙ্গে আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে ৫০০ গিগাওয়াট অজীবাশ্ম জ্বালানি সক্ষমতা অর্জনের যে উচ্চাকাঙ্ক্ষা সে যাত্রায় ভারত সহযোগী হিসেবে কাজ করছে। এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের অর্থায়নে হাই-ভোল্টেজ ট্রান্সমিশন লাইন বাংলাদেশের ভেড়ামারাকে সংযুক্ত করবে ভারতের বহরমপুরের সঙ্গে।
ত্রিদেশীয় এ চুক্তির মাধ্যমে আন্তঃসীমান্ত বিদ্যুৎ বিনিময়ের দিকে অগ্রসর হচ্ছে ভারত, বাংলাদেশ ও নেপাল। এর ফলে আঞ্চলিক জ্বালানি-নিরাপত্তা আরও জোরদার হবে এ জোনে। বিশেষ করে আজকের জ্বালানি-অনিরাপদ বিশ্বে এটি খুবই প্রাসঙ্গিক। তাই পারস্পরিক বোঝাপড়া এবং প্রতিবেশী সহযোগিতার প্রতীক হিসেবে ধরাই যায় যৌথ এ উদ্যোগকে। আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা এবং উচ্চতর সমৃদ্ধির জন্য ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে বিরামহীন আন্তঃসীমান্ত শক্তি সঞ্চালনের যুগের ইঙ্গিত দিচ্ছে এ উদ্যোগ।
চুক্তিটি ফলপ্রসূ হয়েছিল যখন নেপালের প্রধানমন্ত্রী পুষ্প কমল দাহাল শেষবার ভারত সফর করেছিলেন চলতি বছরের জুনে। আর দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের মধ্যে শক্তি সংযোগ বাড়াতে ভারতীয় ট্রান্সমিশন লাইন ব্যবহারের অনুমতি দেওয়ার জন্য নেপালের সঙ্গে সঙ্গে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে ধন্যবাদ দিতেই পারে বাংলাদেশ।
সাম্প্রতিককালে ঘন ঘন লোডশেডিংয়ের সম্মুখীন হচ্ছে বাংলাদেশ। একদিকে প্রাকৃতিক গ্যাস সংকট, আরেকদিকে হ্রাস পাচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। দ্বিতীয় কারণটি কঠিন করে তুলছে দেশের জ্বালানি আমদানির সক্ষমতা। অন্যদিকে, নেপাল ভেজা মৌসুমে তার অভ্যন্তরীণ প্রয়োজনের তুলনায় প্রায় ৩০ শতাংশ বেশি উদ্বৃত্ত জলবিদ্যুতের আশীর্বাদপ্রাপ্ত। তাই বাংলাদেশের কাছে তারা অতিরিক্ত এ বিদ্যুৎ বিক্রি করতে চাইছে। কিন্তু দুপক্ষের এ চাহিদা পূরণে প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছিল দুদেশের মধ্যে গ্রিড সংযোগের অনুপস্থিতি।
উভয়দেশই এ সমস্যা সমাধানে তাই সাহায্য চেয়েছিল মধ্যবর্তী অবস্থানে থাকা ভারতের। আর দুটি দেশেরই ভালো বন্ধু ও প্রতিবেশী হিসেবে ওই প্রস্তাবে সম্মতও হয়েছে ভারত। বহরমপুর-ভেড়ামারা হাই ভোল্টেজ লাইন ব্যবহার করে আন্তঃসীমান্ত বিদ্যুৎ ব্যবসার জন্য আন্তঃসহযোগীতামূলক এক চুক্তিতে প্রবেশ করেছে বাংলাদেশ পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ড, নেপাল ইলেকট্রিসিটি অথরিটি এবং এনটিপিসি বিদ্যুৎ ব্যবসা নিগম (এনভিভিএন)- তিন দেশের এ তিন বিদ্যুৎ কোম্পানি।
বহরমপুর-ভেড়ামারা হাই ভোল্টেজ লাইন। ভেড়ামারায় বাংলাদেশের পশ্চিম বৈদ্যুতিক গ্রিডকে বহরমপুরে ভারতের পূর্ব গ্রিডের সঙ্গে সংযুক্ত করছে উচ্চ ভোল্টেজের এ ট্রান্সমিশন লাইনটি। ত্রিপক্ষীয় চুক্তিটি সম্পাদনের ফলে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের অর্থায়নে ১৯৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের এ উচ্চ ভোল্টেজ লাইনের মাধ্যমে প্রশস্ত হবে আন্তঃসীমান্ত বিদ্যুৎ বাণিজ্যের পথ।
এই লাইনটি ছাড়াও বাংলাদেশ ও নেপাল এরই মধ্যে ভারতের মধ্য দিয়ে আরও একটি ট্রান্সমিশন লাইন বিবেচনা করছে, যা শুধুমাত্র নেপাল ও বাংলাদেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বিদ্যুৎ বাণিজ্যের জন্য নিবেদিত হবে।
অপচয় রোধ করতে কিংবা কমাতে নিজেদের উদ্বৃত্ত বিদ্যুৎ স্থানান্তরের সক্ষমতা গুরুত্বপূর্ণ ছিল নেপালের জন্য। ২৬০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসহ নেপাল তার ৯৭ শতাংশের বেশি উৎপাদন করে জলবিদ্যুৎ। বর্তমানে নেপাল প্রায় ৪৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ ভারতে রপ্তানি করছে। কিন্তু শুষ্ক মৌসুমে বিদ্যুতের চাহিদা মেটাতে নিজেদের জলবিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়িয়েছে দেশটি।
এই বর্ধিত আউটপুট আর্দ্র মৌসুমে উদ্বৃত্ত শক্তিতে পরিণত হয় যা নেপালকে রপ্তানি করতে হবে এবং এর জন্য বাজারের সন্ধানে ছিল দেশটি। ইতোমধ্যে ভারতের সঙ্গে ক্ষমতা ভাগাভাগি চুক্তির ফলে নেপাল কিছু অতিরিক্ত বিদ্যুৎ বাংলাদেশে রপ্তানি করতে চেয়েছিল।
অন্যদিকে নিজস্ব বিদ্যুৎ উৎপাদনের ঘাটতি মেটাতে এবং দেশের বিদ্যুতের চাহিদা মেটাতে বিদ্যুৎ চাইছে বাংলাদেশও।
এ ছাড়া একটি নির্বিঘ্ন বিদ্যুৎ ব্যবস্থার জন্য অদূর ভবিষ্যতে শক্তির প্রচলিত উৎস থেকে নবায়নযোগ্য শক্তির উৎসের দিকে ধাবিত হতে হবে বাংলাদেশকে। এটি কেবল দেশের শক্তি সুরক্ষা নিশ্চিত করতে নয়, দীর্ঘমেয়াদি স্থায়িত্বের জন্যও প্রয়োজনীয়।
রাশিয়া-ইউক্রেন সংকট শুরু হওয়ার পর থেকে জ্বালানি নিরাপত্তাহীনতার হুমকির মুখে পড়েছে উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত দেশগুলো। যুদ্ধের এ প্রেক্ষাপটে বিদ্যুৎ সংকট প্রশমনের নিমিত্তে আন্তঃসীমান্ত জ্বালানি সহযোগিতা এবং পাওয়ার করিডোরের ধারণাকে পুনরুজ্জীবিত করা সময়ের দাবি হয়ে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশের জন্য।
এদিকে নেপাল যেহেতু একটি স্থলবেষ্টিত দেশ, তাই বাংলাদেশে তার উদ্বৃত্ত বিদ্যুৎ রপ্তানি করতে ভারতের সাহায্য ও সমর্থন প্রয়োজন। প্রাথমিক পর্যায়ে বাংলাদেশ ও নেপাল ভারতের সহায়তায় আন্তঃসীমান্ত পাওয়ার ট্রান্সমিশন লিংক ব্যবহার করে প্রায় ৪০ থেকে ৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ বাণিজ্যের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
ভারতের সেন্ট্রাল ইলেক্ট্রিসিটি রেগুলেটরি কমিশন (সিইআরসি) অনুসারে, ভারতের সম্পৃক্ততার ভিত্তিতে এ আন্তঃসীমান্ত বাণিজ্য করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে।
তা ছাড়া ভারত নিজেই নবায়নযোগ্য শক্তি উৎপাদনের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে একটি সবুজ ভারতে রূপান্তরিত হতে চাইছে। যার লক্ষ্য অজীবাশ্ম উৎস থেকে ৫০০ গিগাওয়াট উৎপাদন করা এবং ২০৩০ সালের মধ্যে ৫০ শতাংশ নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহার করা। তাই ভারতেরও এই আন্তঃসীমান্ত চুক্তিতে দারুণ আগ্রহ আছে। কারণ বাংলাদেশের এ পাওয়ার করিডোর ব্যবহার করে তারাও নিজেদের বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ উল্লেখযোগ্যভাবে কমাতে সক্ষম হবে। আর বাংলাদেশ সরকার নিজেও ২০৫০ সালের মধ্যে নবায়নযোগ্য উৎস থেকে ৪০ শতাংশ শক্তির মিশ্রণ পেতে চাইছে, যেখানে এই মুহূর্তে তারা মাত্র তিন শতাংশ বিদ্যুৎ পাচ্ছে নবায়নযোগ্য উৎস থেকে।
মোটকথা, এ ত্রিপক্ষীয় চুক্তিটি নিরবচ্ছিন্ন উপায়ে আন্তঃসীমান্ত বিদ্যুৎ সঞ্চালনের নতুন এক যুগের সূচনা করতে চলেছে, যা দক্ষিণ এশীয়ায় ভারত, বাংলাদেশ ও নেপালের জ্বালানি নিরাপত্তা জোরদার করবে। সবার পারস্পরিক সুবিধার জন্য প্রতিবেশীদের মধ্যে সহযোগিতার প্রমাণ হিসেবে এই যৌথ উদ্যোগ সমগ্র অঞ্চলের জন্যই শুভ। দক্ষিণ এশিয়ার শক্তির দৃশ্যপটকে পুনর্নির্মাণে একটি যুগান্তকারী এক মাইলফলক হতে পারে ত্রিদেশীয় এ শক্তি-বণ্টন চুক্তি।
লেখক: পররাষ্ট্র নীতি বিশ্লেষক এবং সফট পাওয়ার কূটনীতি সম্পর্কিত জাতীয় প্রকল্পের প্রধান তদন্ত কর্মকর্তা, ভারত।
বেদনায় ভরা দিন: শেখ হাসিনা
তখনো ভোরের আলো ফোটেনি। দূরের মসজিদ থেকে আজানের ধ্বনি ভেসে আসছে। এমন সময় প্রচণ্ড গোলাগুলির আওয়াজ। এ গোলাগুলির আওয়াজ ঢাকার ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কের একটি বাড়ি ঘিরে, যে বাড়িতে বসবাস করেন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এক বিঘা জমির উপর খুবই সাধারণ মানের ছোট্ট একটা বাড়ি। মধ্যবিত্ত মানুষের মতোই সেখানে বসবাস করেন দেশের রাষ্ট্রপ্রধান। তিনি সবসময়ই সাধারণ জীবনযাপন করতেন। এই বাড়ি থেকেই ১৯৭১ সালের ২৬-এ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের যে আন্দোলন-সংগ্রাম - এই বাড়িটি তার নীরব সাক্ষী। সেই বাড়িটিই হলো আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু। গোলাগুলির আওয়াজের মধ্যে আজানের ধ্বনি হারিয়ে যায়।
রাষ্ট্রপতির বাসভবনের নিরাপত্তায় সাধারণত সেনাবাহিনীর ইনফেন্ট্রি ডিভিশনকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু মাত্র ১০-১২ দিন পূর্বে বেঙ্গল ল্যাঞ্চারের অফিসার ও সৈনিকদের এ দায়িত্বে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। আমার মা, বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, লক্ষ্য করলেন কালো পোশাকধারী সৈনিকেরা বাড়ির পাহারায় নিয়োজিত। তিনি প্রশ্নটা তুলেছিলেনও। কিন্তু কোনো সদুত্তর পাননি।
আমার বাবা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ছিল দেশের মানুষের প্রতি অঢেল ভালোবাসা। তিনি সকলকেই অন্ধের মতো বিশ্বাস করতেন। তিনি কখনো এটা ভাবতেও পারেননি যে, কোনো বাঙালি তাঁর ওপর গুলি চালাতে পারে বা তাঁকে হত্যা করতে পারে। তাঁকে বাঙালি কখনো মারবে না, ক্ষতি করবে না - এই বিশ্বাস নিয়েই তিনি চলতেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, সেই বিশ্বাসের কি মূল্য তিনি পেয়েছিলেন?
চারদিকে মুহুর্মুহু গুলির আওয়াজ। বিকট শব্দে মেশিনগান হতে গুলি করতে করতে মিলিটারি গাড়ি এসে দাঁড়ালো ৩২ নম্বর রোডের বাড়ির সামনে। গুলির আওয়াজে ততক্ষণে বাড়ির সকলেই জেগে উঠেছে। আমার ভাই শেখ কামাল দ্রুত নিচে নেমে গেল রিসেপশন রুমে - কারা আক্রমণ করলো, কী ঘটনা জানতে। বাবার ব্যক্তিগত সহকারী মহিতুল ইসলাম বিভিন্ন জায়গায় ফোন করার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু কোনো সাড়া পাচ্ছিলেন না।
সেখানে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর কামাল বেরিয়ে বারান্দায় এসে দেখে বাড়ির গেট দিয়ে মেজর নূর ও ক্যাপ্টেন হুদা এগিয়ে আসছে। কামাল তাদের দেখেই বলতে শুরু করলো: আপনারা এসে গেছেন, দেখেন তো কারা বাড়ি আক্রমণ করলো?
ওর কথা শেষ হতে পারলো না। তাদের হাতের অস্ত্র গর্জে উঠলো। কামাল সেখানেই লুটিয়ে পড়লো। অথচ মুক্তিযুদ্ধের সময় মেজর নূর আর কামাল একইসঙ্গে কর্নেল ওসমানীর এডিসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছে। আর সেই কারণে ওরা একে অপরকে ভালোভাবে চিনতো। কিন্তু কী দুর্ভাগ্য! সে চেনা মানুষগুলি কেমন অচেনা ঘাতকের চেহারায় আবির্ভূত হলো। নিজ হাতে গুলি করে হত্যা করলো সহযোদ্ধা কামালকে। কামাল তো মুক্তিযোদ্ধা। দেরাদুন থেকে ট্রেনিং নিয়ে দেশের অভ্যন্তরে যায় যুদ্ধ করতে। এরপর বাংলাদেশ সরকার ক্যাপ্টেন শেখ কামালকে নিয়োগ দেয় বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী প্রধান কর্নেল ওসমানীর এডিসি হিসেবে।
মেজর সৈয়দ ফারুক ট্যাঙ্ক নিয়ে আমাদের বাড়ি লক্ষ্য করে গুলি চালাচ্ছিল। আব্বা সবার আগে ঘর থেকে সেনাবাহিনী প্রধান সফিউল্লাহ সাহেবকে ফোন করেন। তাঁকে জানান বাড়ি আক্রান্ত। তিনি জবাব দেন: আমি দেখছি। আপনি পারলে বাইরে কোথাও চলে যান।
আরও পড়ুন: জাতীয় শোক দিবস: বঙ্গবন্ধুর প্রতি প্রধানমন্ত্রীর শ্রদ্ধা
এর মধ্যে ফোন বেজে ওঠে। কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রব সেরিয়াবাত, আমার সেজ ফুফা, ফোনে জানান যে তাঁর বাড়ি কারা যেন আক্রমণ করেছে। আব্বা জবাব দেন তাঁর বাড়িও আক্রান্ত। আব্বা আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুর রাজ্জাক ও তোফায়েল আহমেদকে ফোন করেন। আব্দুর রাজ্জাক বলেন: লিডার দেখি কী করা যায়। আব্দুর রাজ্জাক স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর দায়িত্বে ছিলেন। তোফায়েল আহমেদ ফোনে বলেন: আমি দেখছি। রিসিভার নামিয়ে রাখতে রাখতে বলতে থাকেন: আমি কী করবো? তোফায়েল আহমেদ রক্ষী বাহিনীর দায়িত্বে ছিলেন। আব্বা নিচে যাওয়ার জন্য ঘর থেকে বের হন। মা পাঞ্জাবিটা পরিয়ে দেন। আব্বা যেতে যেতে - কামাল কোথায় - জিজ্ঞেস করতে থাকেন। কথা বলতে বলতে তিনি সিঁড়ির কাছে পৌঁছান।
এ সময় সিড়ির মাঝের প্ল্যাটফর্মে যারা দাঁড়িয়েছিল তারাও দোতালায় উঠে আসছিল। এদের মধ্যে হুদাকে চিনতে পারেন আব্বা। আব্বা তার বাবার নাম ধরে বলেন: তুমি রিয়াজের ছেলে না? কী চাস তোরা? কথা শেষ করতে না করতেই গর্জে উঠে ওদের হাতের অস্ত্র। তাদের সঙ্গে ইতোমধ্যেই যোগ দিয়েছিল রিসালদার মোসলেউদ্দিন।
ঘাতকদের নির্মম বুলেটের আঘাতে সিঁড়ির উপর লুকিয়ে পড়লেন আব্বা। আমার মা সিঁড়ির দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। ঘাতকের দল ততক্ষণে ওপরে উঠে এসেছে। আমার মাকে তারা বাধা দিল এবং বললো যে আপনি আমাদের সঙ্গে চলেন। মা বললেন: আমি এক পা-ও নড়বো না, কোথাও যাবো না। তোমরা উনাকে মারলে কেন? আমাকেও মেরে ফেলো। ঘাতকদের হাতের অস্ত্র গর্জে উঠলো। আমার মা লুটিয়ে পড়লেন মাটিতে।
কামালের স্ত্রী সুলতানা কামাল ও জামালের স্ত্রী রোজী জামাল মা’র ঘরে ছিল। সেখানেই তাঁদের গুলি করে হত্যা করে ঘাতকেরা। রাসেলকে রমা জড়িয়ে ধরে এক কোণে দাঁড়িয়েছিল। ছোট্ট রাসেল কিছুই বুঝতে পারছে না। একজন সৈনিক রাসেল আর রমাকে ধরে নিচের তলায় নিয়ে যায়। একইসঙ্গে বাড়িতে আরও যারা ছিল তাদেরও নিচে নিয়ে দাঁড় করায়।
গৃহকর্মী আব্দুল গুলিবিদ্ধ হয়েছিল। তাকেও নিয়ে যায়। বাড়ির সামনে আম গাছতলায় সকলকে দাঁড় করিয়ে একে একে পরিচয় জিজ্ঞেস করে। আমার একমাত্র চাচা মুক্তিযোদ্ধা শেখ আবু নাসের পঙ্গু ছিলেন। তিনি বার বার মিনতি করছিলেন: আমার স্ত্রী অন্তঃসত্ত্বা; আমি মুক্তিযোদ্ধা। আমাকে মেরো না। ছোট ছোট বাচ্চারা আমার, ওদের কী হবে? কিন্তু খুনিরা কোনো কথাই কানে নেয় না। তাঁর পরিচয় পেয়ে তাঁকে অফিস ঘরের বাথরুমে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করে।
রমার হাত ধরে রাসেল “মা’র কাছে যাব, মা’র কাছে যাব” বলে কান্নাকাটি করছিল। রমা বারবার ওকে বোঝাচ্ছিল: তুমি কেঁদো না ভাই। ওরা তোমাকে মেরে ফেলবে। কিন্তু অবুঝ শিশু মায়ের কাছে যাব বলে কেঁদেই চলছে। এ সময় একজন পরিচয় জানতে চায়। পরিচয় পেয়ে বলে: চলো, তোমাকে মায়ের কাছে দিয়ে আসি।
ভাইয়ের লাশ, বাবার লাশ মাড়িয়ে রাসেলকে টানতে টানতে দোতলায় নিয়ে মায়ের লাশের পাশেই গুলি করে হত্যা করে। দশ বছরের ছোট্ট শিশুটাকে ঘাতকের দল বাঁচতে দিল না।
যে বাড়ি থেকে একদিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন, সেই বাড়িটি রক্তে ভেসে গেল। সেই রক্তের ধারা ওই সিঁড়ি বেয়ে বাংলার মাটিতে মিশে গেছে- যে মাটির মানুষকে তিনি গভীরভাবে ভালোবাসতেন।
৪৬ ব্রিগেডের দায়িত্বে ছিলেন সাফায়েত জামিল। সেনাপ্রধান তাঁকে ফোন করে পায়নি। সিজিএস খালেদ মোশাররফও কোনো দায়িত্ব পালন করেনি। সেনাবাহিনীর ডেপুটি চিফ জিয়াউর রহমান কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার চেষ্টা করেনি বরং সে পুরো ষড়যন্ত্রের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল। খুনি রশিদ ও ফারুক বিবিসি-তে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জিয়াউর রহমানের জড়িত থাকার কথা বলেছে। খুনি মোস্তাক জিয়াকে সেনাপ্রধান হিসেবে নিয়োগ দেয়। ঢাকার তৎকালীন এসপি মাহবুবকেও ফোন করে পাওয়া যায়নি।
মেজ ফুপুর বাসা
ঘাতকেরা ধানমন্ডির মেজ ফুফুর বাড়ি আক্রমণ করে রিসালদার মোসলেউদ্দিনের নেতৃত্বে। তাদের একটি দল সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে উঠতে গালি দিতে থাকে। বুটের আওয়াজ আর চিৎকার-চেঁচামেচি শুনে মুক্তিযোদ্ধা যুবনেতা এবং বাংলার বাণীর সম্পাদক শেখ ফজলুল হক মনি ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন। বন্দুক তাক করে তাঁকে অকথ্য ভাষায় গালি দিতে থাকে ঘাতকের দল। এ সময় তাঁর অন্তঃসত্তা স্ত্রী আরজু ছুটে এসে স্বামীকে জড়িয়ে ধরে ঘাতকদের বুলেট থেকে বাঁচাতে। কিন্তু ঘাতকের দল তাঁদের লক্ষ্য করে গুলি করে। বুলেটের আঘাতে দুজনের শরীর ঝাঁঝরা হয়ে যায়। মাটিতে লুটিয়ে পড়ে নিথর দেহ দুটি। ছোট দুই ছেলে, তিন বছরের তাপস আর বছর পাঁচেকের পরশ, মা-বাবার লাশের পাশে এসে চিৎকার করতে থাকে আর বলতে থাকে: মা ওঠো, বাবা ওঠো। ওই শিশুদের কান্না মা-বাবা কি শুনতে পেয়েছিল? ততক্ষণে তাঁরা তো না-ফেরার দেশে চলে গেছে। শিশুদের চোখের পানি মা-বাবার রক্তের সঙ্গে মিশে একাকার হয়ে যায়।
সেজ ফুপুর বাড়ি
গুলি করতে করতে মেজর সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান ও মেজর এ এম রাশেদ চৌধুরী মিন্টু রোডে সেজ ফুফার সরকারি বাড়ির সিঁড়ি বেয়ে দোতালায় উঠে যায়। পরিবারের সকল সদস্যকে তাঁদের ঘর থেকে বের করে নিচতলায় বসার ঘরে নিয়ে আসে। এর পর তাদের উপর ব্রাশ ফায়ার করে। গুলির আঘাতে লুটিয়ে পড়েন আবার ফুপু আমিনা সেরনিয়াবাত, আমার ফুফা কৃষিমন্ত্রী মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রব সেরিয়াবাত, তাঁর মেয়ে বিউটি, বেবি, রিনা, ছেলে খোকন, আরিফ, বড় ছেলে আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহর স্ত্রী শাহানা, নাতি সুকান্ত, ভাইয়ের ছেলে মুক্তিযোদ্ধা শহীদ, ভাগ্নে রেন্টু। আট বছরের নাতনি কান্তা গুলিবিদ্ধ লাশের নিচে চাপা পড়ে যাওয়ায় বেঁচে যায়। দেড় বছরের নাতি সাদেক গুলিবিদ্ধ মায়ের বুকে পড়ে কাঁদতে থাকে। আট বছরের কান্তা নিজের ফুফু বেবির লাশের নিচে চাপা পড়েছিল। সেখান থেকে কোন মতে বের হয়ে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে। সারি সারি গুলিবিদ্ধ আপনজন পড়ে আছে। কারও নিথর দেহ, কেউ বা যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন। ঘরের কোণায় রাখা অ্যাকুরিয়াম গুলি লেগে ভেঙে যায়। অ্যাকুরিয়ামের পানির সঙ্গে মাছগুলি মাটিতে পড়ে যায়। রক্ত ভেজা পানিতে মাছগুলিও ছটফট করে লাফাতে থাকে। কিছুক্ষণ আগে যে আপনজন মা, বাবা, দাদা-দাদি, চাচা, ফুফুসহ সকলকে নিয়ে এই শিশুরা ছিল, আর এখন গুলিবিদ্ধ রক্তে ভেজা আপনজন। লাশের নিচ থেকে নিজেকে বের করে ঘরের কোণে দাঁড়িয়ে ৮ বছরের শিশুটি অবাক বিস্ময়ে ভীত-সন্ত্রস্ত চোখে তাকিয়ে থাকে।
আরও পড়ুন: ১৫ আগস্ট: শোক দিবসে জাতির পিতাকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করা হবে
মেজর ফারুক ট্যাঙ্ক নিয়ে লেকের ওপার থেকে ৩২ নম্বরের বঙ্গবন্ধু ভবন লক্ষ্য করে গুলি চালাচ্ছিল। সেই গুলি মোহাম্মদপুরে এক বাড়িতে পড়ে। সেখানে ১১ জন মানুষ নিহত হয় আরও অনেকেই আহত হয়। মেজর ডালিম রেডিও স্টেশন দখলের দায়িত্বে ছিল। সেখান থেকেই সে ঘোষণা দেয়: শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করা হয়েছে। ঘাতকেরা শুধু হত্যা করে তাই নয়, তারা আমাদের বাসা লুটপাট করে। আমার বাবার শোবার ঘরে এবং ড্রেসিং রুমের সকল আলমারি, লকার সবকিছু ভেঙে সেখান থেকে যা কিছু মূল্যবান ছিল - গহনা, ঘড়ি, টাকা-পয়সা লুটপাট করে নিয়ে যায়। বাসায় ব্যবহার করা গাড়িটাও মেজর হুদা ও নূর নিয়ে যায়।
আলমারির সব কাপড় চোপড় বিছানার ওপর পড়েছিল। সেগুলোর অনেকগুলোতে ছিল রক্তের দাগ। এই হত্যাকাণ্ডের পর লুটপাটের ঘটনা মনে করিয়ে দেয় ওদের চরিত্রের অন্ধকার দিকটা। এই ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যারা জড়িত ছিল, তারা এই সদ্য স্বাধীন দেশের মানুষের কত বড় সর্বনাশ করেছিল তা কি ওরা বুঝতে পেরেছিল?
যে বুকে বাংলার মানুষের জন্য প্রচণ্ড ভালোবাসা ছিল, সেই বুকটাই ঝাঁঝরা করে দিল তাঁরই প্রিয় বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর কিছু দুর্বৃত্ত। আমার আব্বা কোনোদিন বিশ্বাস করতেই পারতেন না যে, বাংলাদেশের কোন মানুষ তাঁকে মারতে পারে, বা কোনো ক্ষতি করতে পারে। পৃথিবীর অনেক নেতাই তাঁকে এ বিষয়ে সতর্ক করেছিলেন। কিন্তু তিনি বলেছেন, ওরা তো আমার ছেলে, আমাকে কেন মারবে? এত বড় বিশ্বাস ভঙ্গ করে ওরা বাঙালির ললাটে কলঙ্ক লেপন করল।
কী বিচিত্র এ দেশ! একদিন যে মানুষটির একটি ডাকে এদেশের মানুষ অস্ত্র তুলে নিয়ে যুদ্ধ করে বিজয় এনেছিল, বীরের জাতি হিসেবে সারা বিশ্বের কাছে মর্যাদা পেয়েছিল, আজ এই হত্যাকাণ্ডের মধ্যে দিয়ে সেই জাতি সমগ্র বিশ্বের কাছে বিশ্বাসঘাতক জাতি হিসেবে পরিচিতি পায়। খুনি ও ষড়যন্ত্রকারীদের এদেশের অগণিত জনগণ ঘৃণা করে এবং বিশ্বাসঘাতক হিসেবে চিহ্নিত করে।
আমার অন্তঃসত্ত্বা চাচি ছয় জন সন্তান নিয়ে চরম বিপদের সম্মুখীন হন। খুলনায় ভাড়ার বাসায় বসবাস করতেন। সে বাসা থেকে তাঁকে বিতাড়িত করা হয়। টুঙ্গিপাড়ার বাড়িও সিল করে রাখা হয়। ঘরবাড়ি হারা সদ্য বিধবা কোথায় ঠাঁই পাবেন?
সোবহানবাগ
আব্বার সামরিক সচিব কর্নেল জামিল তাঁর ব্যক্তিগত গাড়িতে করে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির দিকে রওয়ানা হন। সোবহানবাগ মসজিদের কাছে তাঁর গাড়ি আটকে দেয় ঘাতকেরা। তিনি এগোতে চাইলে ঘাতকেরা তাঁকে খুব কাছ থেকে গুলি করে হত্যা করে।
আমাদের বাড়ির নিচে পুলিশের বিশেষ শাখার সদস্য এসআই সিদ্দিকুর রহমানকেও তারা গুলি করে হত্যা করে।
বেলজিয়াম
ক্রিং ক্রিং ক্রিং ...। টেলিফোনটা বেজেই যাচ্ছে। আমার ঘুম ভেঙে গেল। মনে হলো টেলিফোনের আওয়াজ এত কর্কশ? আমি ঘুম থেকে উঠে সিঁড়ির কাছে দাঁড়ালাম। দেখি নিচে অ্যাম্বাসেডর সানাউল হক সাহেব ফোন ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। আমাকে দেখে বললেন, ওয়াজেদের সঙ্গে কথা বলবেন। আমি তাঁকে ঘুম থেকে ডেকে তুললাম। অপর পারে জার্মানির অ্যাম্বাসেডর হুমায়ুন রশিদ সাহেব কথা বলছেন। তিনি জানালেন বাংলাদেশে ক্যু হয়েছে। আমার মুখ থেকে বের হলো: “তাহলে তো আমাদের আর কেউ বেঁচে নাই”। রেহানা পাশে ছিল। তাঁকে জড়িয়ে ধরলাম। কিন্তু তখনও জানি না কী ঘটনা ঘটেছে।
মাত্র ১৫ দিন আগে জার্মানি এসেছি। বেলজিয়ামে বেড়াতে এসেছি। নেদারল্যান্ডেও গিয়েছিলাম। আব্বা বলেছিলেন, নেদারল্যান্ড কীভাবে সাগর থেকে ভূমি উত্তোলন করে - পারলে একবার দেখে এসো। একদিন আগেই আব্বা-মার সঙ্গে কথা হয়েছে। কেন জানি মা খুব কাঁদছিলেন। বললেন “তোর সাথে আমার অনেক কথা আছে, তুই আসলে আমি বলবো।” আমাদের খুব খারাপ লাগছিল। মনে হচ্ছিল তখনই দেশে ছুটে চলে যাই।
আব্বা বললেন: রোমানিয়া ও বুলগেরিয়াতে তিনি যাবেন। আর ফেরার পথে আমাদের নিয়ে আসবেন।
কিন্তু আমাদের আর দেশে ফেরা হলো না। একদিন পরই সব শেষ। বেলজিয়ামের বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত সানাউল হক, যিনি রাজনৈতিক সদিচ্ছায় অ্যাম্বাসেডর পদে নিয়োগ পেয়েছিলেন, রাতারাতি তার চেহারাটাই পাল্টে গেল। তিনি জার্মানিতে নিয়োজিত রাষ্ট্রদূত হুমায়ূন রশিদ সাহেবকে বলেন, যে বিপদ আমার কাঁধে পাঠিয়েছেন তাঁদের ফেরত নেন।
যিনি আগের রাতে আমাদের জন্য ‘ক্যান্ডেল লাইট ডিনার’ এর আয়োজন করেছিলেন; কত খাতির, আদর-যত্ন, আর এখন আমরা তার কাছে আপদ হয়ে গেলাম। আমাদের বর্ডার পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়ার জন্য গাড়িটাও দিলেন না। বেলজিয়াম অ্যাম্বাসিতে কর্মরত আমার স্কুলের বান্ধবী নমি’র স্বামী জাহাঙ্গীর সাদাতের গাড়িতে করে আমদের বেলজিয়াম বর্ডারে যেতে বললেন। জাহাঙ্গীর সাদাত আমাদের জার্মানির বর্ডারে পৌঁছে দিলেন। সেখান থেকে পায়ে হেঁটে নোম্যান্স ল্যান্ড পার হয়ে আমরা জার্মানির মাটিতে পৌঁছলাম। জার্মানির অ্যাম্বাসেডর হুমায়ুন রশিদ সাহেব গাড়ি পাঠিয়েছেন। আর তাঁর স্ত্রী আমার বাচ্চাদের জন্য শুকনো খাবার-দাবারও গাড়িতে দিয়েছিলেন। তাঁদের কাছে কয়েকদিন আশ্রয় পেলাম। তাঁদের আদর যত্ন দুঃসময়ে আমাদের জন্য অনেক মূল্যবান। আমরা কোনোদিন ভুলতে পারবো না হুমায়ুন রশীদ ও তাঁর স্ত্রীর অবদান। জার্মান অ্যাম্বাসির সকল অফিসার ও কর্মচারি আমাদের অত্যন্ত যত্ন করেছিলেন। অ্যাম্বাসির গাড়িতে আমাদের কার্লস রুয়ে পৌঁছে দিলেন। জার্মান সরকার, যগোস্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট মার্শাল টিটো, ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীসহ আরও অনেকে আমাদের রাজনৈতিক আশ্রয় দিতে চাইলেন। জার্মানিতে নিযুক্ত ভারতের অ্যাম্বাসেডর জনাব হুমায়ুন রশিদ ও ডক্টর ওয়াজেদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন। তিনি আমাদের ভারতে যাওয়ার সব ব্যবস্থা করে দেন। আমরা জার্মানি থেকে ভারতে পৌঁছালাম।
উপসংহার
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের রক্তাক্ত বেদনার আঘাত বুকে ধারণ করে আমার পথচলা। বাবা মা ভাইদের হারিয়ে ৬ বছর পর ১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশে ফিরে আসতে পেরেছি। একটি প্রতিজ্ঞা নিয়ে এসেছি, যে বাংলাদেশ আমার বাবা স্বাধীন করে দিয়ে গেছেন, তা ব্যর্থ হতে পারে না। লাখো শহিদের রক্ত আর আমার বাবা-মা ভাইদের রক্ত ব্যর্থ হতে আমি দেব না।
আমার চলার পথ খুব সহজ ছিল না, বারবার আমার উপর আঘাত এসেছে। মিথ্যা অপপ্রচার, গুলি, বোমা ও গ্রেনেড হামলার শিকার হতে হয়েছে আমাকে। খুনি জিয়াউর রহমানের স্ত্রী খালেদা জিয়া বিভিন্ন সময় বলেছিল, “শত বছরেও আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যেতে পারবে না।” “শেখ হাসিনা, প্রধানমন্ত্রী তো দূরের কথা বিরোধী দলের নেতাও কখনো হতে পারবে না।” এর পরেই তো সেই ভয়াবহ ২০০৪ সালের ২১-এ আগস্টের গ্রেনেড হামলা। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা মানবঢাল রচনা করে সেদিন আমাকে রক্ষা করেছিলেন। উপরে আল্লাহ, আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী আর বাংলাদেশের জনগণই আমার শক্তি। আমার চলার কণ্টকাকীর্ণ পথে এরাই আমাকে সাহায্য করে চলেছেন। তাই আজকের বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়িয়েছে।
২০০৯ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত জনগণের নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় আছে বলেই আজকের বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পেয়েছে। বাংলাদেশের জনগণকে ক্ষুধার হাত থেকে মুক্তি দিতে পেরেছি। তারা এখন উন্নত জীবনের স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে। আত্মবিশ্বাস ফিরে পেয়েছে।
বাবা! তুমি যেখানেই থাক না কেন, তোমার আশীর্বাদের হাত আমার মাথার উপর আছে - আমি তা অনুভব করতে পারি। তোমার স্বপ্ন বাংলাদেশের জনগণের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষার ব্যবস্থা করে সোনার বাংলাদেশ গড়ে তুলবো। তোমার দেশের মানুষ তোমার গভীর ভালোবাসা পেয়েছে আর এই ভালোবাসার শক্তিই হচ্ছে এগিয়ে যাবার প্রেরণা।
লেখক- বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জ্যেষ্ঠ কন্যা।
আরও পড়ুন: শোক দিবস: বঙ্গবন্ধুর প্রতি প্রধানমন্ত্রীর শ্রদ্ধা নিবেদন
পাকিস্তান-রাশিয়া নয়া সম্পর্ক: এক দেশভিত্তিক সম্পর্ক আর নয়
সম্প্রতি পাকিস্তান ও রাশিয়া বন্ধু হওয়ার সর্বাত্মক চেষ্টা করছে। কারণগুলোও অতি সহজ।
প্রথমত- রাশিয়াকে পণ্য বিক্রি করতে হবে।
দ্বিতীয়ত- পাকিস্তানকে দ্রুত ও সস্তা পণ্য কিনতে হবে।
রাশিয়া জুনের মাঝামাঝি করাচি বন্দর দিয়ে পাকিস্তানে অপরিশোধিত তেল সরবরাহ করেছে। পাকিস্তানে ১ লাখ মেট্রিক টন রাশিয়ান অশোধিত তেল পাঠানোর জন্য এপ্রিল মাসে এ চুক্তিটি করা হয়েছিল।
চুক্তির রাজনীতি
বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক বলয়ের বাইরেও এই চুক্তির প্রভাব রয়েছে। পাকিস্তানের সঙ্গে যা কিছু ঘটে, তার একটি ভারতীয় দিক থাকে। এটি চুক্তিটিও ভিন্ন নয়। রাশিয়া পাকিস্তানের ঘনিষ্ঠ বৃত্তের অংশ নয়, তবে তারা ভারতের ঘনিষ্ট।
কিছু সূত্রের তথ্যমতে, এই সম্পর্কটি (ভারত-রাশিয়া) নাকি চাপের মধ্যে আছে। এগুলো মূলত মার্কিন সূত্রের খবর।
আরও পড়ুন: রাশিয়ার সংসদীয় গ্রুপের সঙ্গে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের বৈঠক
পরিস্থিতি থেকে আরও বোঝা যাচ্ছে, আজীবনের বন্ধু বা ‘আমার বন্ধু, তোমার মিত্র’- টাইপ ভাবনার মডেলের সংস্কার চলছে; পরিবর্তন এসেছে।
সুন্দরভাবে যেটিকে ‘গ্লোবাল সাউথ’ বলা হয়, সেখানকার নেতা ও মানুষেরা এতটাই বোকা না যে তারা সবকিছু মেনে নেবে। এমনকি এখন তারা পশ্চিমসহ কোনো ব্লকের প্রতি স্থায়ী আনুগত্যে বিশ্বাস করে না।
মস্কো, পশ্চিম, বেইজিং এবং এমনকি বহিরাগত এলিয়েনও যদি এগিয়ে আসে, অনেকে তাদের সঙ্গেও সম্পর্ক তৈরির জন্য আগ্রহীI আর ইউক্রেন যুদ্ধ এই প্রক্রিয়াটিকে ত্বরান্বিত করেছে।
রাশিয়া ও পাকিস্তান ছিল স্নায়ুযুদ্ধে একে অন্যের ঘোর শত্রু। বিশেষত ১৯৭১ সালের যুদ্ধের সময় এটি সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছায়, যখন রাশিয়া ভারতকে সমর্থন করে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে।
অন্যদিকে, চীন সেসময় রাশিয়ার বিরুদ্ধে নতুন বন্ধু ও মিত্রদের সন্ধানে ব্যস্ত ছিল। সেসব পুরনো কথা।
দৌড়ের ওপর কঠিন সিদ্ধান্ত
তবে আফগানিস্তানে মার্কিন নেতৃত্বাধীন যুদ্ধের পরবর্তী পর্যায়ে সম্পর্ক একটু ভাল হয়েছিল, কারণ তাদের যৌথ স্বার্থ ছিল। অর্থাৎ সন্ত্রাসবাদ দমন এবং তালেবানের সঙ্গে পুনর্মিলনের বিষয়।
২০২২ সালে যখন পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান মস্কো সফর করেন, তখন এজেন্ডার শীর্ষে ছিল তেল বা এনার্জি।
ততক্ষণে রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করেছে। এতে বিশ্বজোড়া সম্পূর্ণ নতুন একটি জগাখিচুড়ি তৈরি হয়েছে এবং এর ফলাফল এখনও অস্পষ্ট।
কিন্তু পরিস্থিতি অনিশ্চিত হওয়ার কারণেই ছোট/দুর্বল দেশগুলো দৌড়ের ওপর খুব কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হচ্ছে।
পাক-রাশিয়া এপ্রিলের তেল চুক্তিটিকে ‘ট্রায়াল রান’ বলা হয়েছিল, তবে স্পষ্টতই তেলের ড্রামে এর চেয়ে আরও বেশি কিছু রয়েছে।
স্পষ্টতই পাকিস্তান রাশিয়ান অপরিশোধিত দিয়ে তার ট্যাঙ্কের এক-তৃতীয়াংশ পূরণ করার পরিকল্পনা করছে, যার অর্থ তারা শুধুমাত্র মধ্যেপ্রাচের তেলের ওপর নির্ভর করতে চায় না, যা বিশ্বব্যাপী অনিশ্চয়তা নতুন হিসাব-নিকাশ তৈরি করছে।
অন্যদিকে, রাশিয়াও ‘দিল’ খুলে বন্ধুত্বের বোতলে তেল ঢালছে।
এমনকি পাকিস্তানের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ৭৫ বছরপূর্তি অনুষ্ঠানে রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ উর্দুতে ‘পাকিস্তান-রাশিয়া সম্পর্ক দীর্ঘজীবী হোক’- বলে তার বক্তৃতা শেষ করেন।
এ নিয়ে টলস্টয় কি ভাববেন সেটা জানা যায় নি।
আরও পড়ুন: বাংলাদেশ ২০২৩-২৪ সালে অর্থনীতির সব খাতে পাকিস্তানকে পেছনে ফেলেছে: প্রতিবেদন
ভারতকে কি একটু চিন্তায় ফেলেছে?
রাশিয়া ও চীনের বন্ধুত্বের বিষয়টি প্রাক্তনের সঙ্গে রোম্যান্স পুনরুজ্জীবিত করার একটি ক্লাসিক উদাহরণ। একইসঙ্গে উভয়ই একসময় ‘সমাজতান্ত্রিক’ ব্লকের অংশ ছিল, যা ১৯৬১ সালে ভেঙে যায়।
তবে সম্পর্কের মেরামত চলছে এবং উভয়ই অস্ত্রের বিষয় নিয়ে কথা বলছে। এটাই নয়াদিল্লিকে কিছুটা উদ্বিগ্ন করছেI সে আশঙ্কা করছে যে মস্কো তার নতুন প্রেমিক চীনকে বেশি পছন্দ করতে পারে এবং তার সঙ্গে অস্ত্র সহযোগিতা কমাতে পারেI
তবে এটি এখনও ঘটেনি, যদিও মার্কিনিরা খুব আশাবাদী যে অচিরেই এমনটা ঘটবে।
নতুন অংক, পুরনো শত্রু
ভারত বিশেষজ্ঞরা পাকিস্তানের সঙ্গে রাশিয়ার নয়া মাখামাখি’র ভবিষ্যত সম্পর্কে সতর্কI তবে তারা বলছে যে এটি পাকিস্তান বা ভারতের সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্কের পুনর্বিন্যাস নয় এবং মস্কো ও ইসলামাবাদের মধ্যে সমীকরণ ইতিবাচক; তবে দীর্ঘস্থায়ী হওয়া সম্ভব নয়।
কারণ পাকিস্তানের পকেট ছিঁড়ে গেছে এবং তারা মস্কোকে বেশিদিন অর্থ দিতে পারবে না; কারণ তার (রাশিয়ার) নিজের পকেটও মেরামত করা যথেষ্ট প্রয়োজন।
তবে পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় উদ্বেগের বিষয় হতে পারে যে রাশিয়ার সঙ্গে খুব বেশি প্রণয় করলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ক্ষুব্ধ হবে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই আইএমএফ ও ওয়ার্ল্ড ব্যাংককে নিয়ন্ত্রণ করে। আর পাকিস্তানের এখন তাদের ভীষণ প্রয়োজন।
সুতরাং, পশ্চিমা দেশগুলো যে তেলের দাম নির্ধারণ করেছে, পাকিস্তানকে তা মেনে চলতে হবেI না হয় মার্কিন নিষেধাজ্ঞার মুখোমুখি হতে হবে।
মার্কিন, রাশিয়া এবং দক্ষিণ এশিয়া
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বলছে যে নগদ টাকার ঘাটতির কারণে রাশিয়া আর নির্ভরযোগ্য সরবরাহকারী নয়, কিন্তু ভারত এই খেলায় পুরানো পাপী।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা বাড়ালেও ভারত এখনও রাশিয়ার সঙ্গে একটি ‘সব সময়ের বন্ধু’-মার্কা পোজ দিচ্ছে।
কারণ ভারত নিশ্চিত হতে চায় যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কৌশলগত বিয়েতে গেলে সে রাশিয়ার চেয়ে ভাল পার্টনার পাবেI তবে ভারত নিশ্চয়ই শিশু বা কিশোরীর মতো মালাবদলের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়বে না, কারণ এতে অর্থ জড়িত; আর এটাই আসল কথা।
এখন দক্ষিণ এশিয়ার কোনো দেশই আর কোনো সরবরাহকারী কাম সুপার পাওয়ারের সঙ্গে একচেটিয়া সম্পর্ক করার চুক্তিতে যাচ্ছে না। সব দরজা খোলা রাখতে চায় সবাইI আর এটা শুধু ভারত ও পাকিস্তানই করছে, এমন না।
বাংলাদেশ যেমন মার্কিন নিষেধাজ্ঞা দেওয়া অনুমোদিত কয়েক ডজন রুশ জাহাজ তার বন্দরে ভিড়তে বাধা দিয়েছে, অন্যদিকে আবার রাশিয়ার সঙ্গে চীনা মুদ্রায় লেনদেন অব্যাহত রেখেছে।
(প্রকাশিত মতামতের দায় লেখকের, ইউএনবির নয়)
আরও পড়ুন: রাশিয়ার থ্রিডি-প্রিন্টেড রকেট উৎক্ষেপণের পরপরই ব্যর্থ!
বাংলাদেশের অর্থনীতি সংস্কারে ভূমিকা রাখবে আইএমএফের ঋণ
গত ফেব্রুয়ারি মাসে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে ‘রেসিলিয়েন্ট সাসটেইনেবল ফান্ড’ এর আওতায় ঋণ সহায়তার প্রথম কিস্তি পেয়েছে বাংলাদেশ। ডলারের হিসেবে যার পরিমাণ ৪৭ কোটি ৬২ লাখ ৭০ হাজার ডলার।
আইএমএফ থেকে সাড়ে তিন বছর ধরে সাত কিস্তিতে যে ৪৭০ কোটি মার্কিন ডলারের ঋণ পাচ্ছে, তার মূল্যও কম নয়।
কারণ, এ ঋণের বিপরীতে মোটা দাগে ৩৮টি শর্ত পূরণ করতে হবে বাংলাদেশকে। আর এই অর্থনীতি সংস্কারের শর্ত পূরণের মূল্য দিতে হতে পারে দেশের খেটে খাওয়া মানুষদের।
আইএমএফের মূল শর্তগুলোর মধ্যে রয়েছে- আন্তর্জাতিক নিয়মের সঙ্গে মিল রেখে এদেশের রিজার্ভ ব্যবস্থা পুনর্গঠন করা, ব্যাংকঋণের সুদহারের সীমা তুলে দেওয়া, ডলারের দাম বাজারের ওপর ছেড়ে দিয়ে একটি নির্দিষ্ট দাম ঠিক করা, সব সময় জ্বালানি তেলের দাম আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে মিলিয়ে সমন্বয় করা, মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) তুলনায় রাজস্ব সংগ্রহের হার বৃদ্ধি ইত্যাদি।
এছাড়াও বিভিন্ন খাত থেকে উল্লেখযোগ্য হারে ভর্তুকি কমানো, ব্যাংকঋণের সুদের হার বৃদ্ধি, ডলারের একদর করাসহ আইএমএফ যে সকল সুপারিশ বাংলাদেশ সরকারকে বাস্তবায়ন করতে বলেছে; সেগুলার একটি সরাসরি প্রভাব দেশের সাধারণ জনগণের ওপর পড়ছে।
বাংলাদেশ মূলত জ্বালানি, বিদ্যুৎ ও গ্যাসে ভর্তুকি দিয়ে থাকে; যার পরিমাণ জিডিপির ০.৪ শতাংশ।
বিদ্যুৎ খাতে বাংলাদেশ সরকারের ভর্তুকির পরিমাণ প্রতিবছর প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার এবং গ্যাসে প্রায় ০.৪ বিলিয়ন ডলার।
আরও পড়ুন: বাংলাদেশ ব্যাংকের আশা আইএমএফ ঋণের প্রথম কিস্তি আগামী মাসের মধ্যে আসবে: মুখপাত্র
বাংলাদেশে বিগত বছরগুলোতে কয়েক দফায় বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে। কারণ আইএম এফ এর শর্ত হলো অলাভজনক খাতগুলো থেকে ভর্তুকি তুলে নেওয়া।
মূলত গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়েনি, বরং এসব পণ্যের মূল্যের বড় একটি অংশ আগে সরকার পরিশোধ করত, কিন্ত এখন সেটি ভোক্তা পর্যায়ে পরিশোধ করতে হচ্ছে।
ব্যাংকঋণের সুদহারের সীমা তুলে দিলে ব্যাংকগুলো ঋণের সুদ বাড়িয়ে দেবে। এতে পণ্য ও সেবা উৎপাদনের খরচ বেড়েছে, ফলে বেড়েছে পণ্যের দামও। যার ভুক্তভোগী হচ্ছে নিম্ন আয়ের মানুষ।
যদি ডলারের দাম বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়, তাহলে রাতারাতি এদেশে ডলারের দাম বেড়ে যাবে এবং ডলারের বিপরীতে বাংলাদেশি মুদ্রা টাকার বড় ধরনের অবমূল্যায়ন হতে পারে।
তখন পণ্য আমদানিতে খরচ আরও বেড়ে যেতে পারে, যা মূল্যস্ফীতিতে ব্যাপক প্রভাব ফেলবে।
এদিকে, ঋণপ্রাপ্তির প্রথম দুই বছরে কর-জিডিপি দশমিক ৫০ শতাংশ এবং তিন বছরে দশমিক ৭০ শতাংশ হারে বৃদ্ধির কথা বলেছে আইএমএফ।
দেশের রাজস্ব প্রশাসনের প্রবণতা হচ্ছে, যারা কর দেন তাদের ওপরই বাড়তি করের বোঝা চাপানো।
অর্থাৎ এদেশের কর-রাজস্ব আয়ের ক্ষেত্রটি বিস্তৃত হলেও আমাদের কর সংগ্রহ ব্যবস্থায় যথেষ্ট ফাঁক-ফোকর রয়েছে। এদেশের চাকরিজীবীরাই একমাত্র নিয়মিত কর দেয়।
যদি কর-রাজস্ব আয় বৃদ্ধির জন্য মাথাপিছু কর বাড়ানোর পরিকল্পনা নেওয়া হয়, তবে সেটি হবে কিছু নির্দিষ্ট সংখ্যক মানুষের ওপর একটি বাড়তি বোঝা।
সরকার ইতোমধ্যে জ্বালানি তেল, গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েছে; যার প্রভাব জিনিসপত্রের দামের ওপর পড়েছে। এগুলোতে সরকার আর ভর্তুকি দিতে রাজি নয়। জ্বালানি তেল ও গ্যাসের দাম বাড়িয়ে বর্তমানে যে জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে, তা আন্তর্জাতিক বাজারদরের কাছাকাছিই আছে।
আরও পড়ুন: সাড়ে ৪ বিলিয়ন ডলার ঋণ চুক্তি চূড়ান্ত করতে ঢাকায় আসছেন আইএমএফ’র ডিএমডি
২০২৬ সালের মধ্যে সরকারি মালিকানাধীন ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার ১০ শতাংশের মধ্যে ও বেসরকারি খাতের ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৫ শতাংশের মধ্যে নামিয়ে আনতে বলেছে আইএমএফ।
এদিকে আইএমএফকে বাংলাদেশ জানিয়েছে, ব্যাংকের পুনঃতফসিল করা ঋণকেও খেলাপি ঋণের হিসাবে আনা হচ্ছে, যা আগামী জুনের মধ্যে কার্যকর হবে।
এর বাইরে দ্রুততম সময়ে আয়কর আইন ও শুল্ক আইন প্রণয়ন, ব্যাংক কোম্পানি আইনের সংশোধন, ফাইন্যান্স কোম্পানি আইনের সংশোধন এবং দেউলিয়া আইন প্রণয়নের শর্তও রয়েছে আইএমএফের।
শুধু ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম ৩ মাসে বাংলাদেশের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১৩৪৩.৯৬ বিলিয়ন টাকা এবং এই খেলাপী ঋণের পরিমাণ দিন দিন বেড়েই চলছে।
আইএমেফের এই শর্তটি বাস্তবায়ন করা গেলে দেশে ঋণ খেলাপির পরিমাণ অনেকটা কমে যাবে বলে আশা করা যায়।
এছাড়াও, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোকে তিন মাস পরপর জিডিপির তথ্য প্রকাশ, প্রকৃত ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভের হিসাবায়ন পদ্ধতি এবং আন্তর্জাতিক নিয়মের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে মুদ্রাস্ফীতি পরিমাপ পদ্ধতির প্রণয়ন আগামী জুনের মধ্যেই বাস্তবায়ন করতে বলা হয়েছে।
আইএমএফের ঋণের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতির যে সংস্কার হবে বলে মনে করা হচ্ছে, সেই সংস্কারের ঢেউয়ের প্রভাব শুধু নির্দিষ্ট কোনো একটি শ্রেণির মানুষের ওপরে না পড়ে, দেশের সকল মানুষের ওপর ন্যায়সঙ্গতভাবে পড়ুক; তবেই দেশের উন্নয়ন টেকসই হবে।
(প্রকাশিত মতামতের দায় লেখকের, ইউএনবির নয়)
আরও পড়ুন: আইএমএফ’র ঋণ একটি চারিত্রিক সনদের মতো: প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা মশিউর