‘ম্যাচের শেষ ১০ মিনিট রিয়াল মাদ্রিদকে সতর্কতার সঙ্গে মোকাবিলা কর’- এটি রিয়াল মাদ্রিদের বিপক্ষে খেলা যে কোনো দলের জন্য অলিখিত নিয়ম। আর তা একবারের জন্য ভুলে গিয়েই চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনালে ওঠা হলো না বায়ার্ন মিউনিখের।

রিয়ালের ১২টি আক্রমণ, তার মাঝে অন্তত ৭টি নিশ্চিত গোল অসাধারণ দক্ষতায় প্রতিহত করেও শেষে এসে গুলিয়ে ফেললেন বায়ার্ন অধিনায়ক মানুয়েল নয়ার। আর ওই একটি সুযোগ কাজে লাগিয়েই ম্যাচের মোড় ঘুরিয়ে দিলেন হোসেলু। মুহুর্তের মধ্যে আরও একটি গোল করে একাই ধ্বংসস্তুপ থেকে দলকে টেনে তুললেন ফাইনালে।

ম্যাচের সারাংশ অনেকটা এমনই। ৮১তম মিনিটে মাঠে নেমে ৮৮ ও শেষ মিনিটে জোড়া গোল করে দলকে ২-১ ব্যবধানের জয় এনে দিলেন রিয়ালে বছরের পর বছর ধরে ব্রাত্য হোসেলু।

এ জয়ে ১৮ বারের মতো ইউরোপ সেরার মঞ্চে ফাইনালে পা রাখল রিয়াল মাদ্রিদ। আগামী ১ জুন জার্মানির আরেক দল বরুশিয়া ডর্টমুন্ডের মোকাবিলা করবে তারা।

সান্তিয়াগো বের্নাবেউতে ম্যাচ শুরুর অষ্টম মিনিটে প্রথম গোলের সুযোগ তৈরি করে বায়ার্ন মিউনিখ। কাউন্টার অ্যাটাকে গিয়ে বক্সের বাইরে থেকে বাঁ পাশ দিয়ে এগিয়ে যাওয়া সের্গে গেনাব্রিকে পাস বাড়ান পাবলোভিচ। সেখান থেকে গেনাব্রির জোরালো ক্রসে পা দিতে পারলেই গোল পেয়ে যেত বায়ার্ন, তবে হ্যারি কেইন বলে স্পর্শ করতে না পারায় নিশ্চিত গোলের সুযোগ হাতছাড়া হয় তাদের।

ম্যাচের ত্রয়োদশ মিনিটে একটু ভুল বোঝাবুঝির কারণে গোল খেয়েই বসেছিল বায়ার্ন। মাঠের মাঝে দুটি বল চলে আসায় মনযোগ হারায় বায়ার্নের খেলোয়াড়রা। এরইমধ্যে বল নিয়ে ডানপাশ দিয়ে প্রতিপক্ষের বক্সে ঢুকে জোরালো শট দেন ভিনিসিউস। বলটি প্রথমে পোস্টে লেগে আবারও ভিনির কাছে ফিরে আসে। তিনি আবার শট দিলে শরীর দিয়ে ঠেকান মানুয়েল নয়ার। বল আবারও সামনে গেলে ৬ গজের বক্সের মধ্যে থেকে শট নেন রদ্রিগো, কিন্তু এবারও তা অসাধারণ দক্ষতায় ঠেকিয়ে দেন নয়ার। ফলে অধিনায়কের নৈপুণ্যে সে যাত্রায় বেঁচে যায় বাভারিয়ার দলটি।

২৭তম মিনিটে গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্র হারান টমাস টুখেল। ইনজুরি নিয়ে মাঠ ছাড়তে হয় বায়ার্নের আক্রমণভাগের অন্যতম শক্তি গেনাব্রিকে। তার বদলি হিসেবে নামেন উইং ব্যাক আলফনসো ডেভিস। ফলে আক্রমণে শক্তি হারায় তারা।

আরও পড়ুন: ‘ইয়েলো ওয়াল’ ভাঙতে ব্যর্থ হয়ে পিএসজির বিদায়

২৮তম মিনিটে বক্সের ঠিক বাইরের মাঝামাঝি জায়গা থেকে ডান পাশের পোস্টঘেঁষা বাঁকানো শট দেন কেইন, কিন্তু ঝাঁপিয়ে পড়ে কোনোরকমে বলটি হাত দিয়ে বাইরে বের করে দিতে সক্ষম হন লুনিন।

এ ম্যাচে শারীরিক শক্তি ও ফুটবলশৈলীর সেয়ানে সেয়ানে লড়াই চলে পুরো ম্যাচজুড়ে। বল একবার একপাশে তো পরক্ষণেই অন্যপাশে চলে আক্রমণ। তবে খেলোয়াড়দের ভুল পাসে বেশকিছু কাউন্টার অ্যাটাকের সুযোগ নষ্ট করে বায়ার্ন। পুরো ম্যাচজুড়েই চলতে থাকে তাদের ভুলের লহর।

যাইহোক, ৪০তম মিনিটে নয়ারের আরও এক অসাধারণ সেভ দেখে দর্শক। বক্সের ডান পাশে বেশ বাইরে থেকে দূরের পোস্টে বাঁকানো শট নেন ভিনি। বলটি ৬ গজ বক্সের মধ্যে ঢোকার সময় ফ্লিক করেন রদ্রিগো। সাধারণ এ ধরনের ফ্লিকে গোলরক্ষক বোকা বনে যান, কিন্তু ঠান্ডা মাথায় সে বলটিও ঠেকিয়ে দিয়ে জাল অক্ষত রাখেন নয়ার।

প্রথমার্ধ শেষ হওয়ার কয়েক সেকেন্ড আগে আরও একটি গোলের সুযোগ তৈরি হয় বায়ার্নের। মাঝমাঠের কিছুটা ওপর থেকে বল পেয়েই বক্সের দিকে এগোতে থাকা হ্যারি কেইনকে তা ঠেলে দেন কিমিখ। তবে বলে গতি সামান্য বেশি থাকায় কেইন পৌঁছানোর আগেই লুনিন এগিয়ে এসে দলকে বিপদ মুক্ত করেন। ফলে কোনো পাশে পাল্লা ভারী না করেই বিরতিতে যায় দুই দল।

দ্বিতীয়ার্ধ শুরুর পর ৫১তম মিনিটে প্রথম সুযোগ আসে বায়ার্নের পক্ষে। কিমিখের পাস থেকে কেইন শট নিলে তা পোস্টের ওপর দিয়ে বের করে দেন লুনিন।

এর তিন মিনিট পরই গোলের সুযোগ তৈরি করে রিয়াল। বাঁ দিকে কিমিখকে পরাস্ত করে বক্সে ঢুকে গোলের সামনে পাস বাড়ান ভিনিসিউস। সেখানে থাকা বেলিংহ্যাম ডান দিকের পোস্ট দিয়ে জালে বল জড়াতে গেলে তা সামান্য সামনে দিয়ে বের হয়ে যায়।

পাঁচ মিনিট পর ফের বক্সের বাইরে থেকে রদ্রিগোর নেয়া বাঁকানো শট ডান দিকে ঝাঁপিয়ে ঠেকিয়ে দেন নয়ার। এরপর আবারও ভিনিসিউসের আগুনে শট প্রতিহত করেন জার্মান গোলরক্ষক। ম্যাচের এ সময়টায় ছয়-সাত মিনিটের জন্য হঠাৎ করে জ্বলে ওঠে রিয়াল মাদ্রিদ। তবে কোনোরকমে তাদের রক্ষণাত্মকভাবে মোকাবিলা করেন টমাস টুখেলের শিষ্যরা। আসলে এ সময় বারবার কাউন্টারে বল নিয়ে গিয়ে রিয়ালের বক্সের সামনে থেকে ভুল পাসে বিব্রতকরভাবে পজেশন হারাচ্ছিল বায়ার্ন। আর প্রতি-আক্রমণে রিয়ালের আক্রমণের হলকা সামলাতে হচ্ছিল নয়ারকে।

কিংসলি কোমানের ইনজুরির কারণে এ ম্যাচে ভিনিসিউসের কাছে নিদারুণভাবে ভুগতে হয়েছে কোমানের পরিবর্তে রাইট উইং ব্যাংক পজিশনে নামা মিডফিল্ডার ইয়োশুয়া কিমিখকে। ভিনির কাছে কিমিখ বারবার পরাস্ত হওয়ার কারণেই ডান পাশ দিয়ে আক্রমণের দুয়ার খুলে যায়। আর এ সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে থাকেন ভিনিসিউস অ্যান্ড কোং।

ম্যাচের ৬৮তম মিনিটে আসে মাহেন্দ্রক্ষণ। মাঝমাঠ থেকে আলফনসো ডেভিসকে এগোতে দেখে লং পাস দেন কেইন। বলটি বেশ সামনে চলে গেলেও রকেট গতিতে তা রিসিভ করে বাঁ পাশে রুডিগারকে পরাস্ত করে দূরের পোস্ট দিয়ে জালে জড়িয়ে দেন ডেভিস। এটিই চ্যাম্পিয়ন্স লিগে ডেভিসের প্রথম গোল।

আরও পড়ুন: প্যারিস জয় করে কি ফাইনালে যেতে পারবে ডর্টমুন্ড

তবে চার মিনিট পরই সেই লিড হারাতে বসেছিল বায়ার্ন, নেহাত ভাগ্যের জোরে রক্ষা পায় তারা। বক্সের বাইরে থেকে বেলিংহ্যামের শটটি যখন জাল খুঁজে নিয়েছে, ঠিক তার আগে বক্সের মধ্যে ফাউলের শিকার হন কিমিখ। ফলে রিভিউ দেখে গোলটি বাতিল করেন রেফারি।

এর কিছুক্ষণ পর দারুণ খেলতে থাকা লেরয় জানেকে তুলে ডিফেন্ডার ক্যাং লি ইনকে মাঠে নামান টুখেল।

৮২তম মিনিটে ফের গোল দিতে বসেছিলেন ভিনিসিউস। রুডিগারের হাওয়ায় বাড়ানো লং পাস প্রথম স্পর্শেই গোলে পাঠান ভিনি, কিন্তু নয়ারের কাছে ফের কাটা পড়ে তার শটটি।

দুই মিনিট পর আরও একটি কাউন্টারে গিয়ে শেষ পাসটি ভুল দেয়ায় ফের গোলের সুযোগ নষ্ট হয় বায়ার্নের। মিউনিখের দলটির এই ভুলগুলোরই চরম মূল্য দিতে হয়েছে শেষ সময়ে।

তবে নির্ধারিত সময়ের ৩ মিনিট বাকি থাকতে প্রথমবারের মতো ভুল করে বসেন নয়ার। আর ওই একটি ভুল কাজে লাগিয়ে গোল পেয়ে যান এর কিছুক্ষণ আগেই বদলি হিসেবে নামা হোসেলু। বক্সের বাইর থেকে আসা জোরালো শট ঠেকিয়ে দিলেও প্রথম স্পর্শে তা ধরতে ব্যর্থ হন নয়ার। ফলে বলটি একটু সামনে বাউন্স করে ফিরে আসে। এর মধ্যে হঠ্যাৎ কোত্থেকে এসে বলটি ছোঁ মেরে জালে জড়িয়ে দেন হোসেলু। প্রাণ ফিরে পায় রিয়াল।

তবে দুই মিনিট পর উল্লাসে ফেটে পড়ে সান্তিয়াগো বের্নাবেউ। আবারও গোল! আবারও তা করেছেন হোসেলু!

তবে অফসাইড ধরে দেন লাইন ম্যান। এখানে বিষয়টি আরও মজার হয়ে ওঠে। রিভিউতে দেখা যায়, অফসাইড ছিলেন না হোসেলু। ফলে ৮৭ মিনিট পর্যন্ত ১ গোলে পিছিয়ে থাকা রিয়াল নব্বইতম মিনিটে এগিয়ে যায় ২-১ গোলে।

এরপর অতিরিক্ত ৯ মিনিট যোগ হয় ম্যাচে। এ সময় জমে খির হয়ে যায় ম্যাচ। গোল পেতে মরিয়া হয়ে ওঠে বায়ার্ন আর অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা দিয়ে সময়ক্ষেপণ করতে থাকে রিয়ালের খেলোয়াড়রা। এর মাঝে বায়ার্নের এক খেলোয়াড় ইনজুরিতে পড়ার কারণে অতিরিক্ত সময় গড়ায় ১৫তম মিনিটে।

রেফারি শেষ বাঁশি বাজানোর প্রায় সঙ্গে সঙ্গে গোল পায় বায়ার্ন, কিন্তু তার আগেই অফসাইডের পতাকা তুলে দেন লাইন ম্যান। খালি চোখে রিভিউতে অফসাইড মনে না হলেও পরে বায়ার্নের আবেদন আর গ্রহণ করেননি রেফারি। ফলে ভাঙা হৃদয়ে মাঠ ছাড়ে নয়ার অ্যান্ড কোং। অন্যদিকে, পঞ্চদশ চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জয়ের উদ্দেশ্যে ওয়েম্বলির দিকে এগিয়ে যায় রিয়াল মাদ্রিদ।

এ নিয়ে রেকর্ড ১৮ বারের মতো চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনাল খেলতে যাচ্ছে রিয়াল মাদ্রিদ। আগের ১৬টি ফাইনালের মধ্যে মাত্র তিনটিতে হেরেছে রিয়াল। সবশেষ ইউরোপ-সেরার এ প্রতিযোগিতার ফাইনাল তারা হারে ৪৩ বছর আগে ১৯৮১ সালে। মজার বিষয় হচ্ছে, ১৯৯২ সালে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ নামকরণের পর থেকে একটি ফাইনালও হারেনি ১৪ বারের চ্যাম্পিয়নরা। এর মধ্যে ৭ বার ফাইনালে উঠে সাতটি ট্রফি ঘরে তুলেছে রিয়াল।

আরও পড়ুন: প্যালেসের মাঠে ধরাশায়ী ইউনাইটেড