কোর্ট মার্শালের ঝুঁকি নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যোগ দেওয়া প্রথম ভারতীয় কমান্ডার কিংবদন্তি ও খ্যাতিমান ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) কর্মকর্তা মেজর পরিমল কুমার ঘোষ মারা গেছেন।
বৃহস্পতিবার (৬ জুলাই) ৮৪ বছর বয়সে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ভারতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি।
তার মেয়ে আগমনি ঘোষ বলেন, ‘আমার বাবা পরিমল কুমার ঘোষ একজন আনসাং হিরো। সেনাবাহিনী, বিএসএফ এবং ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা আরঅ্যান্ডএডাব্লিউ-এ তার কর্মজীবন নিখুঁত পেশাদারিত্বের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।’
তিনি আরও বলেন, ‘সংবেদনশীল প্রকৃতির কারণে তার চাকরি জীবনে এটা অজানা থেকে যায়। তিনি বাংলাদেশের জন্য একজন নিবেদিত প্রাণ ছিলেন। তিনিই প্রথম ভারতীয় যিনি ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের হয়ে লড়াই করেছিলেন।’
আরও পড়ুন: ফুটবল কিংবদন্তি পেলে ৮২ বছর বয়সে মারা গেছেন
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ক্র্যাকডাউন এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেপ্তারের সময় মেজর পি কে ঘোষ ত্রিপুরার সাব্রুম অঞ্চলে ৯২তম বিএসএফ ব্যাটালিয়নের এফ কোম্পানির কমান্ডিং করছিলেন। তখন তিনি সমরেন্দ্রগঞ্জের আমলিঘাটের চারটি সীমান্ত ফাঁড়ির দায়িত্বে ছিলেন।
‘ফার্স্ট ক্রসিং ওভার অ্যান্ড ফরমেশন অব ফার্স্ট মুক্তিবাহিনী বাই বিএসএফ’- শিরোনামের অধীনে ‘বর্ডারম্যান ২০২১’- নিবন্ধে তার গল্পটি ইকোনমিক টাইমস বিশদভাবে প্রকাশ করেছেন।
সেখানে বলা হয়েছে, একদল বাঙালি তার কাছে এসে পাক সেনাদের বর্বরতার কথা বর্ণনা করে সাহায্য চাইলে তিনি সিনিয়রদের না জানিয়ে এমনকি কোর্ট মার্শালের ঝুঁকি নিয়ে সীমানা অতিক্রম করেছিলেন।
নিবন্ধে আরও তুলে ধরা হয়, ‘বাঙালিরা তার কাছে এসে বলেন যে পাক সেনারা গ্রামবাসীদের ওপর অমানবিক অত্যাচার করছে। বিশেষ করে নারীদের টার্গেট করে নির্যাতন করা হচ্ছে। এ বর্বরতা থেকে পরিত্রাণের জন্য তার কাছে সাহায্য চাইলে তিনি সহানুভূতি দেখিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে তাদের এ অভিযোগ জানানোর আশ্বাস দিয়েছিলেন।’
তাদের কথায় তিনি অত্যন্ত আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন। কিছুক্ষণ পর 'প্রফেসর আলী' ছদ্মনাম ধারণ করে তাদের সঙ্গে গিয়েছিলেন। এ সময় গ্রামবাসীরা তাদের নেতা অধ্যাপক মজুমদারের সঙ্গে দেখা করতে বেরিয়ে এসে ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগান দিতে থাকে।
তখন নুরুদ্দিনের অধীনে ৬ ইপিআর সেনাদের নিয়ে মুক্তিবাহিনীর ১ম গ্রুপ গঠন করা হয়। ঘটনাস্থলেই তাদের অনুপ্রেরণামূলক কথা বলে শপথ অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়। সুভাপুর ব্রিজের উত্তর প্রান্তে তিনজনের দলে মোতায়েন করে পাক সৈন্যদের প্রবেশ ঠেকানোর পরিকল্পনা নেওয়া হয়।
আরও পড়ুন: প্রখ্যাত ভাস্কর শামীম শিকদার মারা গেছেন
পরিমল কুমার ঘোষ এ ঘটনা প্রসঙ্গে এক বর্ণনায় বলেন, ‘২৭ মার্চ ১৯৭১ সকালে সিও লেফটেন্যান্ট কর্নেল এ কে ঘোষ শ্রীনগরে আমার কাছে আসেন এবং আমার বিশেষ এসআইটিআরইপি এর জন্য আমাকে ধন্যবাদ জানান। আমি খুব দ্বিধাগ্রস্ত ছিলাম। কিন্তু একজন অনুগত সৈনিক হিসেবে ২৬ মার্চ সুভাপুরে আমার ক্রসিংয়ের খবর প্রকাশ হয়ে যায়। হঠাৎ করে সিওর দৃষ্টিভঙ্গি বদলে গেল।’
তিনি আরও বলেন, ‘তিনি কাউকে না বলে বর্ডার ক্রস করায় আমার ওপর রেগে গেলেন। চিৎকার করে বললেন, আপনি আন্তর্জাতিক সীমান্ত পার হওয়ার সাহস কিভাবে করলেন? এ জন্য আপনি হয়তো কোর্ট মার্শালের মুখোমুখি হতে পারেন। তিনি অনেক রাগারাগি করে চলে গেলেন। আমি ক্ষণিকের জন্য মন খারাপ করলেও মনের অজান্তে এক মোলায়েম সুখ অনুভব করতে শুরু করলাম। কারণ সীমান্তের ওপারে নিরস্ত্র, নিরপরাধ নাগরিকদের পাশে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমি।’
পরিমল কুমার ঘোষের মৃত্যুকে একজন ‘কিংবদন্তি প্রয়াণ’ হিসেবে অভিহিত করে সুরেশ দত্ত (প্রাক্তন আইজি বিএসএফ) বলেন, ‘ঘোষ দাদা আগরতলায় বিএসএফ জি শাখায় আমার পূর্বসূরি ছিলেন। তিনি পেশাদারিত্বের মান অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন যা অনুকরণ করা সহজ নয়।’
আরও পড়ুন: একুশে পদকপ্রাপ্ত নৃত্যশিল্পী গোলাম মোস্তফা মারা গেছেন