কলেজছাত্রী সোহাগী জাহান তনুকে হত্যার আট বছর পেরিয়ে গেছে। কিন্তু তার পরিবার বিচার পায়নি। দোষীদের চিহ্নিত করতে কর্তৃপক্ষের ব্যর্থতায় তারা উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তার পরিবার অপরিসীম দুর্ভোগ সহ্য করেছে এবং এখন ন্যায়বিচারের কোনো আশা দেখছে না।
কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের ছাত্রী ও নাট্যকর্মী তনু। ২০১৬ সালের ২০ মার্চে বাসা থেকে বের হওয়ার পর কুমিল্লা সেনানিবাসের জঙ্গলে তার মরদেহ পাওয়া যায়। গতকাল বুধবার সোহাগী জাহান তনু হত্যাকাণ্ডের ৮ বছর হয়েছে। এই ৮ বছরেও তনুকে হত্যার সঙ্গে সম্পৃক্তদের চিহ্নিত করতে পারেনি পুলিশ বা অন্য কোনো সংস্থা।
এদিকে, গত ৩ বছর তনুর পরিবারের খবর নেওয়া হয়নি বলে জানানো হয়। এ অবস্থায় বিচার পাবার আশা ছেড়ে দিয়েছেন তনুর মা-বাব।
তনুর মা আনোয়ারা বেগম ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘পিবিআই ঢাকায় বসে বসে বক্তৃতা দেয়। আমাদের ডেকে পাঠিয়ে উল্টো হয়রানি করে। আমরা গরিব। তাই বলে আমরা কারো গোলাম না যে যার কারণে মেয়ে হত্যার বিচার পাব না। তাকে অনেক কষ্ট করে লালন করেছি। কী বেদনা নিয়ে বেঁচে আছি, আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না।’
আরও পড়ুন: ছয় বছরেও তনু হত্যা মামলার অগ্রগতি নেই
তিনি বলেন, ‘কলিজার টুকরাটা কবরে। তাকে ছাড়া ঈদ কীভাবে করব? এ হত্যাকাণ্ডের বিচার যদি দুনিয়ায় না হয়, আল্লাহর কাছে বিচার দিয়ে রাখলাম। আল্লাহর বিচার বড় বিচার।’
তনুর বাবা ইয়ার হোসেন বলেন, তনুর অষ্টম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে দুই মসজিদে দোয়া ও এতিম শিশুদের ইফতারের আয়োজন করেন তিনি।
বিচার না পাওয়ায় তিনি বলেন, ‘আমি আর বিচার চাই না। বিচার চেয়ে কী লাভ? গরিবের ওপর জুলুমের বিচার হয় না।’
তনুর পরিবার জানায়, ২০১৬ সালের ২০ মার্চ সন্ধ্যায় কুমিল্লা সেনানিবাসের ভেতরে একটি বাসায় টিউশনি করতে গিয়ে আর বাসায় ফেরেনি তনু। পরে স্বজনরা খোঁজাখুঁজি করে রাতে বাসার অদূরে সেনানিবাসের ভেতর একটি জঙ্গলে তনুর মরদেহ পায়। পরদিন তার বাবা কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট বোর্ডের অফিস সহায়ক ইয়ার হোসেন বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে কোতোয়ালি মডেল থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন।
থানা পুলিশ ও ডিবির পর ২০১৬ সালের ১ এপ্রিল থেকে মামলাটির তদন্তের দায়িত্ব পায় সিআইডি, কুমিল্লা। তনুর দুই দফা ময়নাতদন্তে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ফরেনসিক বিভাগ মৃত্যুর সুস্পষ্ট কারণ উল্লেখ করেনি। শেষ ভরসা ছিল ডিএনএ রিপোর্ট। ২০১৭ সালের মে মাসে সিআইডি তনুর জামা-কাপড় থেকে নেওয়া নমুনার ডিএনএ পরীক্ষা করে ৩ জন পুরুষের শুক্রাণু পাওয়ার কথা গণমাধ্যমকে জানিয়েছিল।
আরও পড়ুন: ‘খুবই কষ্ট লাগে তনুর খুনিরা পাঁচ বছরেও শনাক্ত হয়নি’
সর্বশেষ সন্দেহভাজন হিসেবে ৩ জনকে ২০১৭ সালের ২৫ অক্টোবর থেকে ২৭ অক্টোবর পর্যন্ত সিআইডির একটি দল ঢাকা সেনানিবাসে জিজ্ঞাসাবাদ করে। এর মধ্যে ২০২০ সালের নভেম্বরে মামলাটির দায়িত্ব পিবিআইকে দেওয়া হয়। পিবিআই ঢাকার একটি টিম দায়িত্ব পাওয়ার শুরুর দিকে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে ঘুরে যান।
২০২৩ সালের ৮ আগস্ট তনুর খালাতো বোন লাইজু জাহানের সাক্ষ্য নেওয়ার কথা থাকলেও তা স্থগিত করা হয়। নির্ধারিত সময়ে তনুর বাবা-মা ও ভাইসহ লাইজু জাহান কুমিল্লা পিবিআই কার্যালয়ে হাজির হওয়ার পর তাদের জানানো হয় তদন্ত কর্মকর্তা অসুস্থ, তাই সাক্ষ্য গ্রহণ স্থগিত করা হয়।
মামলায় সাক্ষ্য দিতে লাইজু তার সিলেটের স্বামীর বাড়ি থেকে একদিন আগে কুমিল্লায় পৌঁছেন। পূর্ব নির্ধারিত সময়ে লাইজু, তনুর বাবা ইয়ার হোসেন, মা আনোয়ারা বেগম ও তনুর ছোট ভাই রুবেল হোসেন কুমিল্লার নগরীর হাউজিং এস্টেট এলাকায় পিবিআই অফিসে পৌঁছেন। পরে তাদের জানানো হয় তদন্ত কর্মকর্তা অসুস্থ, তাই সাক্ষ্য নেওয়া হচ্ছে না।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআই পরিদর্শক মজিবুল হক বলেন, ‘সন্দেহভাজনদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। আমরা আসামিদের শনাক্ত করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি।’
মামলার বাদী তনুর বাবা ইয়ার হোসেন বলেন, ‘যাদের জিজ্ঞাসাবাদ করলে রহস্য বের হতো, তাদেরকেই জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে না। পরিবারের প্রতিটি সদস্য ও আত্মীয়স্বজন এমনকি শিক্ষকরাও সাক্ষ্য দিয়েছে, আর কী বাকি রইলো?’
আরও পড়ুন: অবন্তিকার আত্মহত্যা: বিচারের দাবিতে জবি আইন বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মানববন্ধন