বাংলাদেশ-ইন্দোনেশিয়ার প্রকৃত অংশীদারিত্বকে শক্তিশালী করতে এবং আরও ভালোভাবে এগিয়ে নিতে দুই দেশের জাতীয় ক্ষমতার সর্বোচ্চ অন্তর্ভুক্ত করে ‘বৃহত্তর কর্মপরিকল্পনার’ পরামর্শ দিয়েছেন বাংলাদেশে নিযুক্ত ইন্দোনেশিয়ার রাষ্ট্রদূত হেরু এইচ সুবোলো।

বাংলাদেশে স্থিতিশীল অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও বিনিয়োগের অনুকূল পরিবেশ আছে উল্লেখ করে রাষ্ট্রদূত সুবোলো বলেন, এখানে বাণিজ্য ও বিনিয়োগের সম্ভাবনা ‘অনেক বেশি বিস্তৃত’।

বুধবার ভার্চুয়ালি অনুষ্ঠিত কসমস ডায়ালগের সর্বশেষ পর্বে মূল বক্তব্যে তিনি বলেন, বাংলাদেশ ও ইন্দোনেশিয়াকে মূলত নিজেদের অন্যতম বন্ধু ও অংশীদার হিসাবে দেখতে হবে। কেননা বাংলাদেশ ও ইন্দোনেশিয়াকে একসঙ্গে সমৃদ্ধি অর্জন করতে হবে।

আরও পড়ুন: বাংলাদেশ-সুইজারল্যান্ড সম্পর্ক নিয়ে কসমস ডায়ালগের প্রিমিয়ার বুধবার

দুই দেশ তাদের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ৫০ বছর উদযাপন করছে উল্লেখ করে রাষ্ট্রদূত বলেন, এই সম্পর্ক অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব জোরদার, দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ও ডিজিটাল অর্থনৈতিক পরিবেশকে আরও গভীর করা, জ্বালানি বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বিতরণে বিনিয়োগ এবং জনগণকে তাদের ক্ষমতার সঙ্গে সংযুক্ত করার সুযোগ দিয়েছে।

রাষ্ট্রদূত বলেন, বাংলাদেশ ইন্দোনেশিয়ার কৌশলগত ও নেতৃস্থানীয় শিল্পের জন্য একটি সম্ভাবনাময় বাজার।

কসমস গ্রুপের জনহিতকর শাখা কসমস ফাউন্ডেশনের আয়োজনে ‘বাংলাদেশ-ইন্দোনেশিয়া সম্পর্ক: ভবিষ্যতের জন্য পূর্বাভাস’ শীর্ষক এই সংলাপটির আয়োজন করা হয়।

কসমস ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক নাহার খান সংলাপে সূচনা বক্তব্য রাখেন। অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন বিশিষ্ট কূটনীতিক ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা ড. ইফতেখার আহমেদ চৌধুরী।

আরও পড়ুন: কসমস আতেলিয়ার৭১ এর আয়োজনে 'আর্টিস্ট রেসিডেন্সি প্রোগ্রাম'

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. লাইলুফার ইয়াসমিন, কসমস ফাউন্ডেশনের সম্মানিত উপদেষ্টা ইমেরিটাস রাষ্ট্রদূত (অব.) তারিক এ করিম ও ঢাকা কুরিয়ারের নির্বাহী সম্পাদক শায়ান এস খান আলোচক প্যানেলে যোগ দেন।

সেশনে আরও বক্তব্য দেন কসমস ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান এনায়েতুল্লাহ খান।

 

ড. ইফতেখার বলেছেন, তিনি মোটামুটি অনেকটা কাছ থেকে বৃহত্তম মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ ইন্দোনেশিয়াকে দেখেছেন।‘মুক্ত ও সক্রিয়’ বৈদেশিক নীতি হিসাবে এবং এশিয়া প্যাসিফিকের বৃহত্তম অর্থনীতি হিসাবে আসিয়ানে দেশটির নেতৃত্বের ভূমিকার প্রশংসা করেন তিনি।

ড. ইফতেখার আরও বলেন, ইন্দোনেশিয়া এই অঞ্চলে তার আকার ও অবস্থানের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে কাজ করে যাচ্ছে। তবে বৃহত্তর শক্তির দ্বন্দ্ব বা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জড়ানো থেকে নিজেদের বিরত রেখেছে।

তিনি বলেন, দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের বিকাশের সঙ্গে নিরাপত্তাকে কেন্দ্র করে সম্পর্কের যে বিবর্তন সেটিও আমাদের লক্ষ্য রাখতে হবে। ইন্দোনেশিয়া সেই পথ দেখিয়েছে কীভাবে আমরা বৃহত্তর শক্তির বিরোধে জড়ানো থেকে বিরত থাকতে পারি।

ড. ইফতেখার বলেন, আমাদের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে এমনভাবে গড়ে তুলুন যাতে এটি আমাদের দেশ ও জনগণের উপকারে আসে।

আরও পড়ুন: 'ইনসাইড আউট’: শিশুদের জন্য গ্যালারি কসমসের দিনব্যাপী পেইন্টিং ও অরিগামি ওয়ার্কশপ

তিনি বাণিজ্য, রাজনীতি, প্রতিরক্ষা ও সংস্কৃতির মতো ব্যাপক ক্ষেত্রে সহযোগিতার কথা উল্লেখ করেছেন।

ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে কসমস ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান এনায়েতুল্লাহ খান বলেন, ‘বাংলাদেশ ও ইন্দোনেশিয়ার সম্পর্ক সম্পূর্ণরূপে অগ্রাহ্য করা হয়েছে এবং আশা রাখছি দুই দেশ অবশ্যই সেই সুযোগগুলোর ব্যাপারে দৃষ্টি নিবদ্ধ করবে।

এনায়েতুল্লাহ খান বলেন, আমি খুব উৎসাহিত বোধ করি যে আমাদের সম্পর্কগুলো বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে, যেটা কিনা সম্পর্ক গড়ে তোলার মৌলিক বিষয়। সেই আস্থা আমাদের আছে।

তিনি বলেন, দু’দেশের মধ্যে আরও বেশি শিক্ষার্থীদের সুযোগ প্রদান এবং সবুজ ও ডিজিটাল অর্থনীতিতে আরও সহযোগিতা হতে পারে।

খান বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থানের সুবিধা নেয়ার ওপর জোর দিয়ে বলেন, আমরা আমাদের শক্তিকে উপেক্ষা ও অবমূল্যায়ন করেছি। আমাদের সচেতন হওয়া এবং কাজ করার সময় এসেছে।

আরও পড়ুন: কালিদাস কর্মকারের স্মরণে গ্যালারি কসমসের দিনব্যাপী আয়োজন

নাহার খান বলেন, ইন্ডিয়ান ওশান রিম অ্যাসোসিয়েশনের অন্তর্ভুক্ত দুটি দেশ গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য অংশীদার হয়ে উঠছে।

তিনি বলেন, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বৃহত্তম অর্থনীতি এবং দক্ষিণ এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি হিসাবে, ইন্দোনেশিয়া ও বাংলাদেশ তাদের দ্বিপক্ষীয় অর্থনৈতিক সম্পৃক্ততা প্রসারিত করতে প্রাকৃতিক সুযোগগুলো উপভোগ করছে।

কসমস ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক আরও  বলেন, বাংলাদেশ তার রপ্তানি পণ্যের বহুমুখীকরণের মাধ্যমে প্রবৃদ্ধির পরবর্তী স্তরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে এবং এটি ইন্দোনেশিয়ার জন্য সহজাত গন্তব্য হওয়া উচিত।

তিনি বলেন, আলোচনার অধীনে থাকা অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য চুক্তি (পিটিএ) স্বাক্ষর দুই দেশের মধ্যকার বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক আরও জোরদার করার ক্ষেত্রে অন্যতম মাধ্যম হতে পারে।

 

অধ্যাপক লাইলুফার ইয়াসমিন বলেন, ইন্দোনেশিয়া ও বাংলাদেশ উভয়েই সহাবস্থানের পাঁচটি নীতির ভিত্তিতে একই ধরনের পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করে।

টেকসই সহ-উন্নয়নের কথা উল্লেখ করে লাইলুফার বলেন, প্রতিবেশী এবং বৃহত্তর অঞ্চল একসঙ্গে বিকাশ না করলে উন্নয়ন টিকতে পারা যাবে না। তাই উন্নয়নের ফল প্রতিবেশী এবং এর বাইরেও ছড়িয়ে দিতে হবে।

আরও পড়ুন: কসমস সংলাপ: ঢাকা-বেইজিং সম্পর্কে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের প্রত্যাশা

প্রথম থেকেই রোহিঙ্গা ইস্যুতে ইন্দোনেশিয়ার সক্রিয় ভূমিকার প্রশংসা করেন অধ্যাপক লাইলুফার।

তিনি বলেন, আমরা জানি রোহিঙ্গা ইস্যু সমাধান হতে কিছুটা সময় লাগতে পারে, তবে আমরা সাধুবাদ জানাই এবং আমরা এই ইস্যুতে ইন্দোনেশিয়ার ক্রমাগত সক্রিয় ভূমিকাকে উৎসাহিত করি।

দুই দেশের মধ্যে শক্তিশালী প্রতিরক্ষা সহযোগিতা রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এটিকে কৌশলগত প্রতিরক্ষা সহযোগিতায় রূপান্তর করা যেতে পারে। এছাড়া সামুদ্রিক ডেটা কেবল নিরাপত্তা এবং সাইবার নিরাপত্তার ক্ষেত্রে দু’দেশ একযোগে কাজ করতে পারে।

ঢাকা কুরিয়ারের নির্বাহী সম্পাদক শায়ান খান বলেন, এটা আশ্চর্যজনক যে ঘনিষ্ঠ দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের সমস্ত উপাদান থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ-ইন্দোনেশিয়া গত ৫০ বছরে একে অপরের সঙ্গে সে অর্থে জড়িত হয়নি।

তিনি বলেন, সর্বোচ্চ পর্যায়েও দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য প্রতি বছর দুই বিলিয়ন ডলারের নিচে রয়ে গেছে এবং এটি অত্যধিকভাবে ইন্দোনেশিয়ার পক্ষে। কেননা বাংলাদেশে পাম তেল রপ্তানি বাণিজ্য পরিসংখ্যানে প্রাধান্য পেয়েছে।

 

কসমস ফাউন্ডেশনের সম্মানিত উপদেষ্টা ইমেরিটাস রাষ্ট্রদূত তারিক এ করিম বলেন, দুই দেশের একে অপরের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা জোরদার করতে হবে এবং একে অপরকে আরও নতুন করে আবিষ্কার করতে হবে।

তিনি বলেন, যদি আমরা একসঙ্গে কাজ করি, তবে জাতীয় স্থিতিস্থাপকতাই নয়, সঙ্গে আমাদের উপর যে চাপ আসবে তা মোকাবিলায় আমরা একটি আঞ্চলিক স্থিতিস্থাপকতাও গড়ে তুলতে পারব।

রাষ্ট্রদূত সুবোলো বলেন, সক্ষমতা বৃদ্ধির খাত, সংস্কৃতি, স্বাস্থ্য ইত্যাদিসহ শিক্ষায় আরও সহযোগিতা বৃদ্ধির মাধ্যমে জনগণের মধ্যে যোগাযোগ জোরদার করতে হবে।

তিনি বলেন, বাংলাদেশে ইন্দোনেশিয়ান প্রবাসী এবং ইন্দোনেশিয়ায় বাঙালি প্রবাসীদের শক্তিশালী করা সত্যিই একটি মিশন যা নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে আধুনিক অধ্যায়ে উন্নীত করতে হবে।

রাষ্ট্রদূত বলেন, এ পর্যন্ত বাংলাদেশ ও ইন্দোনেশিয়া প্রতিরক্ষা ও সামরিক ক্ষেত্রে প্রতিরক্ষা সার্ভিস কমান্ড অ্যান্ড স্টাফ কলেজ এবং ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজে ছাত্র বিনিময়ের মাধ্যমে ধারাবাহিকভাবে সহযোগিতা করেছে। এছাড়াও সামরিক কর্মকর্তাদের সফর, প্রতিরক্ষা ও সন্ত্রাস দমনে সহযোগিতা কার্যক্রম চলে আসছে।

আরও পড়ুন: ঢাকা-ওয়াশিংটন সম্পর্ক নিয়ে কসমস ফাউন্ডেশনের ওয়েবিনার শনিবার

তিনি বলেন, এই ক্ষেত্রে একটি সমঝোতা স্মারক সম্পূর্ণ করার কাজ চলছে।

রাষ্ট্রদূত বলেন, উভয় দেশ বাণিজ্য মিথস্ক্রিয়া আরও সহজতর করার লক্ষ্যে পিটিএ চূড়ান্ত করতে কাজ চলছে। এটি সম্পন্ন হলে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য লেনদেন বৃদ্ধিতে উল্লেখযোগ্য প্রভাব আসবে।

তিনি বলেন, দু দেশের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের পরিমাণ ২০২০ সালের এক দশমিক ৭৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার থেকে ২০২১ সালে ৭২ শতাংশ বেড়ে তিন দশমিক তিন বিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে।