লিবিয়ায় মানব পাচারকারী চক্রের খপ্পরে পড়ে ৯ মাস ধরে অমানবিক নির্যাতন সহ্য করেছেন ঝিনাইদহের মতিউর রহমান সাগর, কুষ্টিয়ার তানজির শেখ ও নোয়াখালীর আলমগীর হোসেন নামের ৩ ব্যক্তি। বুধবার (৯ জুলাই) সকালে একটি ফ্লাইটে দেশে ফিরেছেন তারা।
জানা যায়, ২০২৩ সালে দালালদের মিথ্যা প্রলোভনে সাগর ও তানজির প্রত্যেকে ৪ লাখ টাকা খরচ করে লিবিয়ায় যান। আলমগীর আড়াই বছর আগে ৩ লাখ টাকা খরচ করে বিদেশ গিয়েছিলেন। দালালরা তাদের ইতালিতে চাকরি দেওয়ার লোভ দেখিয়ে লিবিয়া পাঠিয়েছিল। সেখানে পৌঁছানোর পরে পাচারকারীরা তাদের কুখ্যাত এক মাফিয়া চক্রের কাছে বিক্রি করে দেয়। ত্রিপোলিতে এমন আরও ৮০ জন বাংলাদেশির সঙ্গে আটকে রেখে তাদের উপর চালানো হয় মাসের পর মাস নির্মম নির্যাতন। পরিবারের কাছ থেকে মুক্তিপণও নেওয়া হয়।
একসময় তারা মারা গেছেন এটা ভেবে পাচারকারীরা তাদেরকে মরুভূমিতে ফেলে রেখে চলে যায়। সেখান থেকে তাদের মৃতপ্রায় অবস্থায় কয়েকজন বাংলাদেশি শ্রমিক খুঁজে পান এবং আশ্রয় ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন বলে জানান তারা।
আজ সকালে লিবিয়া দূতাবাস ও আইওএমের সহায়তায় দেশে ফিরেছেন লিবিয়ায় আটকে পড়া ১৪১ জন বাংলাদেশি। ফিরেছেন সাগর, তানজির ও আলমগীরও।
এদিকে, লিবিয়ায় আটকে থাকা তিন বাংলাদেশির পরিবার তাদের দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য ব্র্যাকের সঙ্গে যোগাযোগ করে। পরিবারের আবেদনের ভিত্তিতে ব্র্যাক, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের ট্রাফিকিং ইন পারসনস (টিআইপি) অফিস, ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ফর মাইগ্রেশন (আইওএম)-এর ওয়াশিংটনের দপ্তর এবং ইন্টারন্যাশনাল জাস্টিস মিশন (আইজেএম)-এর সমন্বিত প্রচেষ্টায় এই তিন তরুণকে লিবিয়ায় সেইফ হোমে স্থানান্তর করা হয়।
আইনি জটিলতা কাটিয়ে এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মাধ্যমে তাদের প্রত্যাবাসন সম্পন্ন হয়েছে।
এই প্রক্রিয়ায় প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড, ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ফর মাইগ্রেশন (আইওএম)-এর লিবিয়া মিশন এবং লিবিয়ায় বাংলাদেশ দূতাবাসও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
এ ঘটনায় মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনে ঢাকায় পৃথক দুটি মামলা দায়ের হয়েছে যার মধ্যে একটির তদন্ত পরিচালনা করছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। এরইমধ্যে গ্রেপ্তার হয়েছে দুই মানব পাচারকারী।
মানব পাচারের শিকার তানজির শেখ বলেন, ‘লিবিয়ায় আমাদের দিনের পর দিন বেঁধে রাখতো, লোহার রড দিয়ে পেটাতো। নির্যাতনের ভিডিও আমাদের পরিবারকে পাঠিয়ে মুক্তিপণ নিয়েছে। মারা গেছি ভেবে তারা আমাদের মরুভূমিতে ফেলে রেখে গিয়েছিল। বেঁচে কোনোদিন যে দেশে ফিরতে পারব সেটা ভাবিনি।’
ব্র্যাকের সহযোগী পরিচালক (মাইগ্রেশন প্রোগ্রাম এন্ড ইয়ুথ প্ল্যাটফর্ম) শরিফুল হাসান বলেন, ইউরোপে পাঠানোর লোভ দেখিয়ে যাদের লিবিয়া নেওয়া হয় তাদের সবাইকে ইতালিতে ভালো চাকরির কথা বললেও তারা কিন্তু চাকরি পায় না। উল্টো অধিকাংশকেই লিবিয়ার বিভিন্ন ক্যাম্পে বন্দী রেখে শারীরিক নির্যাতন করা হয়। এরপর তাদেরকে জিম্মি করে পরিবারের কাছ থেকে অর্থ আদায় করা হয়। তবে এতোকিছুর পরেও ভূমধ্যসাগর পেরিয়ে বাংলাদেশের মানুষের ইউরোপের স্বপ্নে লিবিয়া যাওয়ার এই প্রবণতা থামছে না।’
ব্র্যাকের মাইগ্রেশন ওয়েলফেয়ার সেন্টারের ম্যানেজার আল আমিন নয়ন বলেন, ‘তিন বাংলাদেশি মানব পাচার সার্ভাইভারের প্রত্যাবাসনের জন্যে আমরা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড ও যুক্তরাষ্ট্রের ট্রাফিকিং-ইন-পারসন্স হিরো নেটওয়ার্কের সহায়তা নিয়েছি। গত মাসের ২৫ জুন মানব পাচারের শিকার আরও দুই জন বাংলাদেশিকে ব্র্যাক ও টিআইপি হিরো নেটওয়ার্কের সহায়তায় দেশে ফিরিয়ে এনেছে।’