‘সঙ্গীত সেই বিশ্বজনীন সেতুবন্ধন, যা হৃদয়কে যুক্ত করে, শব্দের সীমা ছাড়িয়ে আত্মাকে ছুঁয়ে যায়’—এই ভাবনা কেন্দ্র করেই বুধবার বিকেলে রাজধানীর মগবাজারের একটি অডিটোরিয়ামে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল এক হৃদয়গ্রাহী ধ্রুপদী সঙ্গীতানুষ্ঠান ও আলোচনা সভা।
অনুষ্ঠানের আয়োজন করে সিদ্ধেশ্বরী ’৬৯ ব্যাচ। বিকেল ৪টায় শুরু হওয়া এই কনসার্টে কানায় কানায় পূর্ণ অডিটোরিয়াম পরিণত হয় সুর, তাল ও আবেগের অপূর্ব মিলনমেলায়।
অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন আদ্দীন মেডিকেল কলেজের উপদেষ্টা ডা. মুনশি আনোয়ার হোসেন। স্বাগত বক্তব্য রাখেন সিদ্ধেশ্বরী ব্যাচ ’৬৯-এর কনভেনার ফজলুল করিম আবিদ। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন, প্রতিষ্ঠানের গর্বিত প্রাক্তন ছাত্র ও প্রজন্মের অনুপ্রেরণা— প্রফেসর মোস্তফিজুর রহমান।
ভারতের লখনৌয়ের পণ্ডিত রবিশঙ্কর ঘরানার অধীনে পণ্ডিত সমরেশ চৌধুরীর শিষ্য শ্রী অদিত্য নির্মল ছিলেন অনুষ্ঠানের প্রধান শিল্পী ও উপস্থাপক। তিনি মনোমুগ্ধকর সুরযাত্রার মধ্য দিয়ে ধ্রুপদী সঙ্গীত ও সংস্কৃতির আন্তঃসম্পর্কিত ইতিহাস তুলে ধরেন। তার পরিবেশনায় ধ্রুপদ, খেয়াল, ঠুমরি ও ভজন ধারার বিবর্তন বাঙলা ভাষা, মানুষ ও সংস্কৃতির ইতিহাসের সঙ্গে মিলেমিশে এক হয়ে ওঠে।
বাঙলায় বর্ণনার পাশাপাশি অদিত্য নির্মল পরিবেশন করেন রাগ কৌশিক ধ্বনি, রাগ খামাজ, রাগ ভৈরবী, রাগ যামন ও রাগ বসন্ত। তিনি ছোট খেয়াল ও বাংলা খেয়ালের ধারায় পরিবেশন করে শ্রোতাদের মুগ্ধ করেন—যার জন্য তাকে বাংলাদেশের নবপ্রবর্তক হিসেবে গণ্য করা হয়। পরিবেশনার ফাঁকে তিনি ব্যাখ্যা করেন বাংলা ভাষা, জাতিসত্তা ও ভারতীয় ধ্রুপদী সঙ্গীতের পারস্পরিক সম্পর্ক, সমাজ-ধর্ম-সংস্কৃতির সংযোগ, এবং নজরুলগীতি, হাম্দ-নাত ও রবীন্দ্রসঙ্গীতের ঐক্যসূত্র।
সন্ধ্যায় পরিবেশিত হয় নজরুলগীতির মধ্যে ‘বাগিচায় বুলবুলি তুই’ ও ‘ভরিয়া পুরণ’, যা অদিত্য নির্মল নিজেই হরমোনিয়ামে পরিবেশন করেন। পাশাপাশি আরও একটি নজরুলগীতি, কয়েকটি রবীন্দ্রসঙ্গীত এবং ঠুমরি ‘কাকরু সাজনি’ পরিবেশন করেন ধ্রুপদী ঘরানার গভীর আবেগে।
যন্ত্রসঙ্গীতে ছিলেন শ্রী দিলীপ বিশ্বাস (হরমোনিয়াম), পণ্ডিত উজ্জ্বল রায় ও রাহুল চ্যাটার্জি (তবলা)। তাঁরা তিনতাল লহরায় যুগলবন্দি পরিবেশন করে শ্রোতাদের মন জয় করেন। পণ্ডিত উজ্জ্বল রায় ভারতের খ্যাতনামা তবলাশিল্পী, যিনি পণ্ডিত স্বপন চৌধুরী, পণ্ডিত অশোক মেহতা, পণ্ডিত সুরেশ তালওয়ালকর, পণ্ডিত যোগেশ সামসি ও পণ্ডিত স্বরাজ ভট্টাচার্যের শিষ্য। রাহুল চ্যাটার্জি তাঁর শিষ্য এবং দিলীপ বিশ্বাস প্রশিক্ষণ নিয়েছেন পণ্ডিত জ্যোতি গোহো’র কাছে।
ধ্রুপদী ও যন্ত্রসঙ্গীত ছাড়াও পরিবেশিত হয় রবীন্দ্রসঙ্গীত, নজরুলগীতি, ঠুমরি ও কবীর সুমনের বাংলা খেয়াল। সঙ্গে যুক্ত হয় জীবনানন্দ দাশ, কাজী নজরুল ইসলাম ও জসীমউদ্দিনের কবিতা ও দর্শনভিত্তিক ভাবনা, যা হাম্দ পরিবেশনার সঙ্গে মিলিত হয়ে অনুষ্ঠানে এনে দেয় আধ্যাত্মিক ও সাহিত্যিক পরিমিতি।
পুরো বিকেলজুড়ে অডিটোরিয়াম প্রতিধ্বনিত হয় করতালির শব্দে। প্রতিটি আলাপ, তান ও তালের ছন্দে বিমুগ্ধ শ্রোতারা যেন অনুভব করেন—সঙ্গীতই সেই ভাষা, যা শব্দের সীমা ছাড়িয়ে হৃদয়কে এক সূত্রে বেঁধে রাখে।
আয়োজনে নিখুঁত সমন্বয় ও আন্তরিকতার ছাপ রাখে সিদ্ধেশ্বরী ’৬৯ ব্যাচ, যাদের প্রচেষ্টা ধ্রুপদী ঐতিহ্য সংরক্ষণে প্রশংসিত হয় দর্শক-শ্রোতাদের কাছে।