বিশ্বব্যাপী সাশ্রয়ী, নিরাপদ ও মানসম্মত টিকার ন্যায্য প্রাপ্তি নিশ্চিতে উন্নয়নশীল দেশগুলোর টিকা উৎপাদনকারী নেটওয়ার্ক বা ডিসিভিএমএন-এর সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছে ইন্দোনেশিয়ার রাষ্ট্রীয় ওষুধ ও টিকা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান পিটি বায়ো ফার্মা (পারসেরো)।
২০০০ সালে নেটওয়ার্কটি গঠনের পর থেকেই বায়ো ফার্মা উন্নয়নশীল দেশগুলোর টিকা স্বনির্ভরতা ও জনস্বাস্থ্য সক্ষমতা বৃদ্ধির অন্যতম চালিকাশক্তি হিসেবে ভূমিকা পালন করে আসছে।
বায়ো ফার্মা ও ডিসিভিএমএনের এই সহযোগিতামূলক যৌথ কার্যক্রম শুরু হয় নেটওয়ার্কের সূচনালগ্নেই। ২০০০ সালে নেদারল্যান্ডসের নর্ডউইকে অনুষ্ঠিত নেটওয়ার্কটির প্রথম বার্ষিক সাধারণ সভায় বায়ো ফার্মা ছিল ১০টি প্রতিষ্ঠাতা সদস্যের একটি। পরের বছর, অর্থাৎ ২০০১ সালের এপ্রিলে ইন্দোনেশিয়ার ব্যান্ডুংয়ে দ্বিতীয় বার্ষিক সভার আয়োজন করে বায়ো ফার্মা, যেখানে নেটওয়ার্কের কাঠামো ও পরিচালনব্যবস্থা আনুষ্ঠানিকভাবে নির্ধারণ করা হয়। বায়ো ফার্মার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ডিরেক্টর থামরিন পুয়েলোয়েংয়ের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভাটি ইন্দোনেশিয়াকে উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে টিকা সহযোগিতা ও জ্ঞান বিনিময়ের কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।
বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডিরেক্টর শাদিক আকাসিয়া বলেন, বায়ো ফার্মার সক্রিয় অংশগ্রহণ ইন্দোনেশিয়ার জাতীয় স্বার্থ ছাড়িয়ে বৈশ্বিক স্বাস্থ্যক্ষেত্রে অবদান রাখার প্রতিশ্রুতির প্রতিফলন।
তিনি বলেন, “ডিসিভিএমএন প্রতিষ্ঠার পর থেকেই বায়ো ফার্মার নেটওয়ার্কটিতে সম্পৃক্ত হওয়া কেবল প্রতিনিধিত্বের জন্য নয়, বরং বৈশ্বিক টিকা স্বনির্ভরতা অর্জনে সত্যিকারের অবদান রাখার জন্য। সহযোগিতা ও উদ্ভাবনের মাধ্যমে আমরা সবার জন্য ন্যায্য ও টেকসই স্বাস্থ্যসমাধান দিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।”
আকাসিয়া আরও বলেন, “সহযোগিতার মধ্যেই উন্নয়নশীল দেশগুলোর টিকা শিল্পের প্রকৃত শক্তি নিহিত। ডিসিভিএমএনে সক্রিয় ভূমিকার মাধ্যমে আমরা নিশ্চিত করতে চাই যে প্রত্যেক দেশ নিরাপদ, মানসম্পন্ন ও সাশ্রয়ী টিকার নাগাল পাবে— যা বৈশ্বিক স্বাস্থ্য নিরাপত্তায় ইন্দোনেশিয়ার বাস্তব অবদানের প্রতিফলন।”
২০০৪ সালে নেদারল্যান্ডস ভ্যাকসিন ইনস্টিটিউটের সঙ্গে প্রযুক্তি হস্তান্তর সহযোগিতার মাধ্যমে বায়ো ফার্মা ডিসিভিএমএনের অন্যান্য সদস্যদের সঙ্গে মিলে পেন্টাভ্যালেন্ট (ডিপিটি–হেপবি–হিব) টিকার প্রাপ্যতা বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এটি প্রমাণ করে, এই নেটওয়ার্কে বায়ো ফার্মার অবদান শুধুমাত্র প্রতীকী নয়, বরং প্রযুক্তিগত ও বাস্তবধর্মী।
২০১২ সালে বালিতে পুনরায় ডিসিভিএমএনের ত্রয়োদশ বার্ষিক সভা আয়োজন করে ইন্দোনেশিয়া। সে সময় বায়ো ফার্মার পরিচালক মাহেন্দ্র সুফারদোনো ডিসিভিএমএনের নির্বাহী কমিটির সভাপতি হিসেবে (২০১৩–২০১৪ মেয়াদে) নির্বাচিত হন। পরবর্তীতে ২০২৩–২০২৫ মেয়াদের জন্য নেটওয়ার্কের বোর্ড চেয়ারম্যান হিসেবে নির্বাচিত হয় বায়ো ফার্মা, যা উন্নয়নশীল দেশগুলোর টিকা শিল্পে ইন্দোনেশিয়ার নেতৃত্বের স্বীকৃতি বহন করে।
সহযোগিতার বাইরে বায়ো ফার্মা উদ্ভাবনেও অগ্রগামী। ২০২০ সালে তাদের তৈরি nOPV2 টিকা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) জরুরি ব্যবহার তালিকায় (ইমার্জেন্সি ইউজ লিস্টিং) অন্তর্ভুক্ত প্রথম টিকা হয়, যা বৈশ্বিক স্বাস্থ্য সংকটে দ্রুত টিকা ব্যবহারের পথ খুলে দেয়। এই অর্জন কেবল বায়ো ফার্মার বৈজ্ঞানিক উৎকর্ষতার প্রমাণ নয়, বরং আন্তর্জাতিক তহবিলদাতা, গবেষক, নীতিনির্ধারক, বিজ্ঞানী ও টিকা নির্মাতাদের সঙ্গে সমন্বিত কার্যকর সহযোগিতার ফলাফল।
এই সাফল্য দেখিয়েছে যে, উন্নয়নশীল দেশের একটি প্রতিষ্ঠানও নিরাপত্তা, মান ও কার্যকারিতার সর্বোচ্চ আন্তর্জাতিক মান পূরণ করে বিশ্বমানের উদ্ভাবন করতে পারে। nOPV2 কেবল বৈজ্ঞানিক সাফল্য নয়, এটি প্রযুক্তিগত স্বনির্ভরতার প্রতীক এবং বৈশ্বিক স্বাস্থ্য নিরাপত্তায় ইন্দোনেশিয়ার সক্ষমতার প্রতি আস্থার প্রতিফলন। এই অর্জন গবেষণা, উদ্ভাবন ও উৎপাদন সক্ষমতা জোরদারেও ডিসিভিএমএনের সদস্যদের অনুপ্রাণিত করেছে।
বায়ো ফার্মা বছরে ৩৫০ কোটি (৩.৫ বিলিয়ন) ডোজ টিকা উৎপাদনের সক্ষমতা রাখে এবং বর্তমানে ১২ ধরনের টিকার জন্য ডব্লিউএইচও প্রাক-যোগ্যতা (প্রিকোয়ালিফিকেশন) সনদপ্রাপ্ত। প্রতিষ্ঠানটি ১৫০টিরও বেশি দেশে টিকা সরবরাহ করে এবং ইসলামিক সহযোগিতা সংস্থা (ওআইসি)-এর টিকা উন্নয়ন, উৎপাদন ও বিতরণে উৎকর্ষ কেন্দ্র (সেন্টার অব এক্সেলেন্স) হিসেবে স্বীকৃত।
আগামী ২৯ থেকে ৩১ অক্টোবর আরও একবার ডিসিভিএমএনের বার্ষিক সাধারণ সভার আয়োজন করতে চলেছে ইন্দোনেশিয়া। বালিতে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া ২৬তম বার্ষিক সাধারণ সভা বৈশ্বিক স্বাস্থ্য কূটনীতিতে নেতৃত্ব পুনর্নিশ্চিত করতে দেশটির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মঞ্চ হবে। এই সম্মেলনের মাধ্যমে বায়ো ফার্মা বৈশ্বিক স্বাস্থ্য খাতে উদ্ভাবন, সহযোগিতা ও টিকা স্বনির্ভরতার প্রচেষ্টা আরও জোরদার করার অঙ্গীকার করেছে, যাতে আরও টেকসই ও ন্যায্য বৈশ্বিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা গড়ে ওঠে।
ডিসিভিএমএন
উন্নয়নশীল দেশগুলোর টিকা উৎপাদনকারী নেটওয়ার্ক বা ডিসিভিএমএন ২০০০ সালে প্রতিষ্ঠিত একটি বৈশ্বিক জোট, যার সদস্য ১৭টি উন্নয়নশীল দেশের ৪৬টি টিকা নির্মাতা সংস্থা। এর লক্ষ্য হলো মানসম্পন্ন টিকার ন্যায্য প্রাপ্তি নিশ্চিতের মাধ্যমে বৈশ্বিক জনস্বাস্থ্যকে শক্তিশালী করা। সংগঠনটি সদস্যদের মধ্যে যৌথ গবেষণা, সক্ষমতা বৃদ্ধি, প্রশিক্ষণ ও সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করে এবং প্রতিটি দেশকে সাশ্রয়ী ও জীবনরক্ষাকারী টিকা উৎপাদনে সক্ষম করে তুলতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ইউনিসেফ, জিএভিআই, সিএপিআই, পিএটিএইচ, সিএইচএআই ও বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করে।
বায়ো ফার্মা
পিটি বায়ো ফার্মা (পারসেরো) ইন্দোনেশিয়ার রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন জীবনবিজ্ঞান প্রতিষ্ঠান এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বৃহত্তম টিকা প্রস্তুতকারক। ১৮৯০ সালে প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানটি ব্যান্ডুংয়ে সদর দপ্তর স্থাপন করার পর থেকে ১৫০টিরও বেশি দেশে টিকা সরবরাহ করছে। বায়ো ফার্মা বায়োটেকনোলজি গবেষণা, উদ্ভাবন ও বৈশ্বিক স্বাস্থ্য নিরাপত্তা জোরদারে সক্রিয় ভূমিকা রাখছে। ডিসিভিএমএনের সদস্য হিসেবে প্রতিষ্ঠানটি বিশ্বব্যাপী টিকার ন্যায্য প্রাপ্তি ও জনস্বাস্থ্য উন্নয়নে আন্তর্জাতিক সহযোগিতায় অবদান রেখে চলেছে।
সূত্র: এশিয়া নেট