তিস্তার ভাঙন
তিস্তার ভাঙন: গাইবান্ধা ও কুড়িগ্রামে শতাধিক পরিবার গৃহহীন
কুড়িগ্রামের চিলমারী উপজেলা এবং গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলায় ভাঙন মারাত্মক রূপ নিয়েছে। গত এক সপ্তাহে তিস্তা নদীর তীরবর্তী বহু মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়েছে।
চিলমারী উপজেলার পাত্রখাতা এবং সুন্দরগঞ্জ উপজেলার হরিপুর ইউনিয়নের কারেন্ট বাজার এলাকায় সাম্প্রতিক ভাঙনে শত শত ঘরবাড়ি ভেসে গেছে এবং তিস্তা নদীর বিস্তীর্ণ ফসলি জমি ও গাছপালা নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। ভাঙনের হুমকিতে রয়েছে তিনটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।
সরজমিনে গিয়ে দেখা যায়, তীব্র ভাঙনে গৃহহীন পরিবারগুলো আশ্রয় না পেয়ে বর্তমানে খোলা আকাশে অবস্থান করছে। অনেকেই জানেন না তারা কোথায় আশ্রয় নিবেন। ভাঙন কবলিতদের আহাজারীতে ভারী হয়ে উঠেছে চারপাশ। তবে ভাঙন ঠেকাতে পাউবো’র পদক্ষেপ থাকলেও ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের গাফিলতির কারণে এখনও বরাদ্দকৃত জিও ব্যাগ নদীতে ফেলানো হয়নি বলে অভিযোগ স্থানীয়দের।
তবে পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছে, ভাঙন ঠেকাতে ভাঙনকবলিত এলাকায় কয়েক হাজার জিও ব্যাগ নদীতে ফেলানোর কার্যক্রম প্রক্রিযাধীন রয়েছে।
আরও পড়ুন: বিপদসীমার ২৮ সেমি ওপরে তিস্তার পানি
চিলমারীর পাত্রখাতা রিয়াজুল জান্নাহ্ দাখিল মাদরাসার সুপার মাওলানা আব্দুল আজিজ আকন্দ জানান, দীর্ঘ কয়েক মাস ধরে ভাঙন অব্যাহত থাকলেও দুই জেলার সীমান্তবর্তী এলাকা হওয়ায় কেউ আমলে নেয়নি। ফলে অনেক পরিবার গৃহহীন হয়েছে। এখন হুমকির মুখে রয়েছে মন্ডলেরহাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, মাদারীপাড়া মন্ডলেরহাট নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও পাত্রখাতা রিয়াজুল জান্নাহ্ দাখিল মাদরাসা। নদী ভাঙন রোধে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া না হলে এই প্রতিষ্ঠানগুলো বিলিন হয়ে যাবে।
নদী ভাঙনের শিকার বাহার উদ্দিন (৫০) বলেন, ‘ শত শত বস্তা বালু ভরি রাখছে। কিন্তু ঠিকাদার বস্তা ফেলায় না। আমাগো শ্যাষ সম্বলটুকু নদী খায়া গেলো। অহন আমরা কই যাই।’
এলাকার সুবলচন্দ্র, নয়া মিয়া ও আব্দুল গনি বলেন, ‘সময়মতো জিও ব্যাগ ফেলানো হলে, এতটা ভাঙত না। আর আমাদের বাড়িঘরও সড়ানো লাগত না।’
কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুল্লাহ আল মামুন জানান, ভাঙনরোধে ওই এলাকায় ৭০ হাজার জিও ব্যাগ বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। গণনা শেষ হলে খুব দ্রুত জিও ব্যাগ নদীতে ফেলানোর কাজ শুরু হবে বলে আশ্বস্ত করেন তিনি।
আরও পড়ুন: তিস্তা নদী থেকে সুন্দরগঞ্জে নিখোঁজ স্কুলছাত্রের লাশ উদ্ধার
তিস্তার ভাঙন: কুড়িগ্রামের ৫ শতাধিক ঘরবাড়ি নদী গর্ভে
তিস্তার তীব্র ভাঙনে কুড়িগ্রামের রাজারহাটের ঘড়িয়ালডাঁঙ্গা ইউনিয়নের তিনটি মসজিদ, প্রথামিক বিদ্যালয়সহ পাঁচ শতাধিক ঘরবাড়ি, গাছপালা ও শতশত একর ফসলি জমি নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, রাজারহাটের তিস্তা নদীতে পানি বৃদ্ধি ও হ্রাসের কারণে তীব্র নদী ভাঙন শুরু হয়। ফলে গত এক মাসে উপজেলার ঘড়িয়ালডাঁঙ্গা ইউনিয়নের গতিয়াশাম, নাখেন্দা ও খিতাবখাঁ মৌজার তিন শতাধিক বসতভিটা নদী গর্ভে বিলীন হয়ে যায়। ফলে বসতভিটে হারিয়ে খোলা আকাশের নিচে মানবতর জীবন-যাপন করছে অনেক পরিবার।
আরও পড়ুন: ফরিদপুরে বিপদসীমার উপরে পদ্মার পানি, তীব্র ভাঙন
সরিষাবাড়ি ইউপি সদস্য শহিদুল ইসলাম জানান, ঈদুল আজহার আগে থেকে ভাঙন চলছে। বর্তমানে ভাঙন তীব্র আকার ধারণ করেছে। এবারের ভাঙনে এই তিনটি মৌজার অধিকাংশ জায়গাই নদী গর্ভে বিলীন হয়েছে বলেও তিনি জানান।
খিতাবখাঁ বড়দরগা গ্রামের আব্দুস সাত্তার বলেন, ‘এই নিয়্যা তিনবার বসতবাড়ি নদী নিয়ে গেলো, এল্যা বেটাবেটি নিয়ে কোটে থাকিম, কোটে বাড়ি তুলিম।‘
এদিকে, উপজেলার ঘড়িয়ালডাঁঙ্গা ইউনিয়নের খিতাবখাঁ, চর-খিতাবখাঁ, গতিয়াশাম, সরিষাবাড়ি ও বিদ্যানন্দ ইউনিয়নের রামহরি, তৈয়বখাঁ, চতুরা, কালিরহাট, চরবিদ্যানন্দসহ ১০টি গ্রামে দফায় দফায় নদী ভাঙনে চলতি মৌসুমে ৫ শতাধিক বসতভিটা নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে বলে জানা গেছে।
এ ছাড়া, এই ১০টি গ্রামের সহস্রাধিক বসতভিটাসহ তৈয়বখাঁ বাজার, কালিরহাট বাজার, বুড়িরহাট বাজার, সরিষাবাড়ি বাজার, তৈয়বখাঁ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, কালিরহাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, কালিরহাট নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়, খিতাবখাঁ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, চর খিতাবখাঁ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ২টি ইউনিয়নের আরও ৩টি মসজিদ, মন্দির, স্থাপনা ও শতশত একর ফসলি জমি হুমকির মুখে পরেছে।
আরও পড়ুন:যমুনার ভাঙনে অর্ধশতাধিক ঘরবাড়ি বিলীন
কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী মাহমুদ হাসান বলেন, ‘ভাঙন কবলিত চার স্থানে জরুরি ব্যবস্থা হিসেবে জিও ব্যাগ ফেলা হচ্ছে। তবে গতিয়াশাম, নাখেন্দা ও খিতাবখাঁ মৌজায় জিও ব্যাগ দিয়ে ভাঙন প্রতিরোধ সম্ভব হবে না।’
কুড়িগ্রামে তিস্তার ভাঙনে দিশেহারা মানুষ
উজানে অতিবৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলের কারণে তিস্তা নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে ৮টি পয়েন্টে তীব্র নদী ভাঙন শুরু হয়েছে। গত এক সপ্তাহে নদীর করাল গ্রাসে গৃহহীন হয়েছে চার শতাধিক পরিবার। বিলীন হয়েছে শতশত বিঘা আবাদি জমি, গাছপালা, জলাশয়, পুকুরসহ দুটি মসজিদ।
এ অবস্থায় ভাঙনকবলিতরা আশ্রয় নিয়েছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও বিভিন্ন আত্মীয় স্বজনের বাড়িতে। একদিকে জিও ব্যাগ ও জিও টিউব দিয়ে চলছে ভাঙন ঠেকানোর চেষ্টা। অপরদিকে বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে ভাঙন কবলিতদের কান্না। এরকম বিষাদময় অবস্থা বিরাজ করছে তিস্তা পাড়ের জনপদে।
আরও পড়ুন: বন্যার পানিতে পড়ে দেড় বছরের শিশুর মৃত্যু
কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী মো. মাহমুদ হাসান, থেতরাই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আইয়ুব আলী ও ঘড়িয়ালডাঙ্গা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান রবীন্দ্রনাথ কর্মকার জানান, তিস্তা ব্রীজ থেকে কুড়িগ্রামের চিলমারী উপজেলা পর্যন্ত প্রায় ৯ কিলোমিটার ব্যাপি উন্মুক্ত জায়গায় ভাঙন অব্যাহত রয়েছে। এতে ৮টি পয়েন্ট চিহ্নিত করে পানি উন্নয়ন বোর্ড জিও ব্যাগ ও জিও টিউব দিয়ে ভাঙন ঠেকানোর চেষ্টা করলেও নদীর গতিপথ পরিবর্তন করে নতুন নতুন এলাকায় ভাঙন শুরু করেছে। ফলে গত এক সপ্তাহে জেলার রাজারহাট ও উলিপুর উপজেলার ৫টি ইউনিয়নে ৪ শতাধিক পরিবারকে নিশ্চিহ্ন করেছে।
তারা বলেন, বর্তমানে প্রচণ্ড ভাঙন দেখা দিয়েছে উলিপুরের থেতরাই ইউনিয়নের গোড়াই পিয়ার ও বজরা ইউনিয়নের পশ্চিম বজরা এলাকায়। এছাড়াও রাজারহাট উপজেলার ঘড়িয়ালডাঙ্গা ইউনিয়নের গতিয়াসাম, সরিষাবাড়ি ও খিতাব খাঁ গ্রামে প্রচণ্ড ভাঙন দেখা দিয়েছে। যদিও এই তিন এলাকায় পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে ভাঙনকবলিত এলাকায় জিও ব্যাগ ও জিও টিউব দিয়ে ভাঙন প্রতিরোধ করা হয়েছে। কিন্তু হঠাৎ করে এর আপার সাইডে আবার নতুন করে ভাঙন দেখা দিয়েছে। গত পাঁচদিনে থেতরাই ইউনিয়নের গোড়াই পিয়ার গ্রামে ৬১টি ভাঙনকবলিত পরিবারকে উলিপুর উপাজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নগদ অর্থ ও খাদ্য সামগ্রি বিতরণ করা হয়।
আরও পড়ুন: বন্যার আশঙ্কা: কুড়িগ্রামে নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত
উলিপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) নুর-ই-জান্নাত রুমি জানান, গত এক সপ্তাহ ধরে থেতরাইয়ের গোড়াই পিয়ার গ্রামে ম্যাচাকার ভাঙনে ৬১ ঘর বিলীন হয়ে গেছে। ভাঙন কবলিতদের সরকার থেকে নগদ অর্থ ও খাদ্য সামগ্রি বিতরণ করা হয়েছে।