বিশ্বযুদ্ধ
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিত্র বাহিনীর বিজয়েও ভূমিকা রেখেছে চীন: জাতিসংঘে স্থায়ী প্রতিনিধি
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে চীন কেবল নিজ ভূখণ্ডই রক্ষা করেনি, মিত্র বাহিনীর বিজয়েও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে বলে মন্তব্য করেছেন জাতিসংঘে চীনের স্থায়ী প্রতিনিধি ফু কং। বুধবার (৭ মে) দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সমাপ্তির ৮০বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে এক বিশেষ সভায় তিনি এমন মন্তব্য করেন।
সভায় যুদ্ধের ভয়াবহতা ও আত্মত্যাগের কথা স্মরণ করে ভবিষ্যতে শান্তি ও মানবাধিকারের প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেন বিশ্ব নেতারা। ফু কং বলেন, ‘দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্বের সময় সাড়ে তিন কোটি চীনা নাগরিক প্রাণ হারিয়েছেন। যুদ্ধ চলাকালীন এশিয়া মহাদেশে জাপানি সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে চীন।’
এ সময়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্বকে ‘ফ্যাসিবাদবিরোধী যুদ্ধ’ আখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, ‘চীন কেবল নিজ দেশ ও জনগণের মুক্তির জন্য লড়াই করেনি, বরং মিত্র বাহিনীর অন্যান্য সদস্যদের সহায়তা ও যুদ্ধে সর্বাত্মক বিজয় লাভে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।’
অনেকটা হুঁশিয়ারি দিয়েই তিনি বলেন, ‘যুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত বা অস্বীকার করার যেকোনো প্রচেষ্টা বিশ্ববিবেক ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সাথে প্রতারণার শামিল।’
আরও পড়ুন: রোহিঙ্গাদের জন্য তহবিল নিশ্চিতে সবকিছু করবে জাতিসংঘ: গুতেরেস
তিনি জাতিসংঘকেন্দ্রিক আন্তর্জাতিক আইনের ওপর ভিত্তি করে আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার ওপর দৃঢ় সমর্থন জানান এবং ক্ষমতার রাজনীতি ও দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার আহ্বান জানান।
এদিকে, জাতিসংঘে রাশিয়ার স্থায়ী প্রতিনিধি ভাসিলি নেবেনজিয়া বলেন, ‘দক্ষিণ আমেরিকা, এশিয়া ও আফ্রিকার মানুষদের বীরত্বের কারণেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিজয় অর্জিত হয়েছে। এ যুদ্ধে চীনের সাড়ে তিন ও যুক্তরাষ্ট্রের ৫ লাখ নাগরিক নিহত হয়েছেন। অন্যদিকে, সোভিয়েত ইউনিয়নের দুই কোটি সাত লাখ মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন, যাদের মধ্যে এক কোটি দুই লাখ ছিলেন সামরিক বাহিনীর সদস্য।’
জার্মানির প্রতিনিধি অ্যান্টিয়ে লেন্ডার্টসে বলেন, ‘নাৎসি জার্মানদের আগ্রসনে শুরু হওয়া যুদ্ধের কারণে ইউরোপ ও অন্যান্য মহাদেশগুলোতে জনজীবনে বিপর্যয় ও দুর্ভোগ নেমে এসেছিল। তবে, এ দুর্দশা, ধ্বংসযজ্ঞ ও জীবনের দায় আমাদের দেশকে চিরকাল বয়ে যেতে হবে। আমরা এই নৈতিকতা ও মানবতার ভার বিনা দ্বিধায় স্বীকার করি।’
তিনি আরও বলেন, ‘দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ থেকে যে শিক্ষা, সেটা হচ্ছে আর যুদ্ধ না করা, এটি কেবল জার্মানির নয় বরং পুরো বিশ্বের অঙ্গিকার।’
এদিকে, জাতিসংঘের ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধি স্তাভরোস লামব্রিনিদিস বলেন, ‘শান্তির জন্য আমাদের সম্মিলিত অঙ্গীকার অপরিহার্য। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তির ৮০ বছর পর জাতিসংঘ সনদের নীতিগুলোকে সমুন্নত রাখা, সবার সম্মিলিত অঙ্গীকারে অটুট থাকা এবং যাতে যুদ্ধের পুনরাবৃত্তি না হয়, তা নিশ্চিত করা, আমাদের গুরু দায়িত্ব।’
এদিকে, জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের সভাপতি ফিলেমন ইয়াং বলেন, ‘এই বার্ষিকী শুধু অতীতের স্মৃতিরোমন্থণ করায়নি, বরং ভবিষ্যতের জন্য শান্তি, ন্যায়বিচার ও মানবাধিকারে অটল থাকতে অনুপ্রাণিত করছে।’
আরও পড়ুন: গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার ও জনগণের সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ নিয়ে আশাবাদী জাতিসংঘ মহাসচিব
চলতি বছরের মার্চে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তির ৮০ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে একটি প্রস্তাব পাস করে। এতে ২০২৫ সালের মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে এবং এরপর থেকে প্রতি পাঁচ বছর অন্তর যুদ্ধের ভুক্তভোগীদের সম্মান জানাতে একটি বিশেষ স্মরণসভা আয়োজনের আহ্বান জানানো হয়েছে। এ প্রস্তাবটি রাশিয়া, চীন, বেলারুশ, আজারবাইজান, আর্মেনিয়া, কাজাখস্তান, কিরগিজস্তান, সার্বিয়া, তাজিকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান এবং উজবেকিস্তান উত্থাপন করেছে।
২১১ দিন আগে
সমস্যা কি শুধুই ইউক্রেনের?
ইউক্রেনের বর্তমান অবস্থা দৃশ্যতঃ রাশিয়ার আগ্রাসন থেকে নিজের দেশকে রক্ষা করা, স্বাধীনভাবে চলার শক্তি অর্জন করা বোঝায়। ইউক্রেন সে চেষ্টাই করছে। সুখে দুঃখে আপনজনের মত আমেরিকা এগিয়ে এসেছে। ওরা বোঝাতে চাচ্ছে কূটনীতি, সামরিক হুমকি সব কিছু দিয়ে রাশিয়াকে ইউক্রেনের কাছে ঘেঁষতে দেবে না। আধুনিক অস্ত্র এবং সৈন্য ও ন্যাটো (উত্তর আটলান্টিক নিরাপত্তা জোট) মিত্ররা সাথে থাকবে। তারপরও ইউক্রেন কি রাশিয়াকে ঠেকাতে পারবে?
ইউক্রেন সীমান্তে রাশিয়া অস্ত্র ও সেনা মোতায়েন করেছে। চীন সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছে। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট কমিউনিস্ট পন্থী। দেশের জনগণ ও বিভক্ত। শতকরা ৮০ ভাগ লোক ইউক্রেনিয়ান ভাষায় কথা বললেও রাশিয়ান ভাষা সবার জানা যা সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের কালচার ছিল। এখন যেকোনো মুহূর্তে বিমান হামলার মাধ্যমে যুদ্ধ শুরু হয়ে যেতে পারে বলে মিডিয়া জানাচ্ছে । অপর দিকে বাইডেন ও পুতিন সংলাপের পথে এগোচ্ছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে বিজয়ী মিত্র শক্তি দুই মেরুতে বিভক্ত হয়ে পড়ে। আমেরিকার নেতৃত্বে ইউরোপীয় পুঁজিবাদী দেশগুলো ন্যাটো নামীয় সামরিক জোট গঠন করে। উদ্দেশ্য জোটের শক্তিকে কাজে লাগিয়ে বিশ্বে আধিপত্য বজায় রাখা তথা সমাজতান্ত্রিক আগ্রাসন থেকে বিশ্বকে রক্ষা করা।
অপরদিকে সমাজতান্ত্রিক আদর্শে সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে পূর্ব ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোকে নিয়ে ওয়ারশ প্যাক্ট নামীয় সামরিক জোট আত্মপ্রকাশ করে। দুই সামরিক জোটের শক্তির টানাপোড়েনে বিশ্ব বার বার অস্থির হয়েছে, শান্তির বার্তা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত হয়েছে। বৃহৎ শক্তিগুলো নিজেকে নিরাপদ রেখে অন্যের দুর্গে হানা দেয়ায় ব্যস্ত। এদিক দিয়ে আমেরিকা তার সীমান্ত নিরাপদ করেছে। একদিকে মেক্সিকো অন্য দিকে কানাডা।
রুশ বলশেভিক বিপ্লবের পর সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রতিবেশী দেশগুলোকে সোভিয়েতের অন্তর্ভুক্ত করে একটি নিরাপদ সীমান্ত বলয় সৃষ্টি করে। ভাষা, সংস্কৃতি বিভিন্ন বিষয়ে আধিপত্যবাদের সৃষ্টি হয়।
১৯৯১ এ সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গেলে এর রিপাবলিক দেশগুলো স্বাধীন হয়ে যায়। কমিউনিস্ট ঐক্যমত ধরে রাখার জন্য সিআইএস (কমনওয়েলথ অব ইন্ডিপেন্ডেন্টে স্টেট) নামীয় সংস্থার সৃষ্টি হয়। গুরুত্বপূর্ণ রিপাবলিক সমূহকে নিয়ন্ত্রণে রাখে রাশিয়ান ফেডারেশন। তার মধ্যে ইউক্রেন ছিল অন্যতম। সোভিয়েত ইউনিয়নের রিপাবলিক সমূহের মাঝে ইউক্রেন ছিল সমৃদ্ধশালী। পারমাণবিক সাইলো ও অন্যান্য স্থাপনাগুলো এখানেই অবস্থিত। সে জন্যে নিরাপদ সীমান্তের জন্য ইউক্রেনকে হাতে রাখা রাশিয়ার অতি প্রয়োজন।
অপরদিকে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙনের ফল ভোগ করতে থাকে ইউরোপ ও ন্যাটো দেশগুলো। মার্কিন পণ্য বিশাল কমিউনিস্ট অঞ্চলে প্রবেশ করে। আমেরিকা বিশ্ব নেতৃত্বের একক কর্তৃত্ব লাভ করে।
ওয়ারশ জোট ভেঙে গেলে আমেরিকা এই জোট থেকে কিছু রাষ্ট্রকে ন্যাটো সদস্য হওয়ার প্রস্তাব দেয়। অনেক দেশ নুতন জীবনের আশায় পশ্চিমা সুখ ও সমৃদ্ধির লোভে জোটে যোগ দেয়। নব্য যোগ দেয়া সশস্ত্র বাহিনীর বেশির ভাগই ন্যাটো স্ট্যান্ডার্ড রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়। ফলে এসব দেশগুলোর যুদ্ধকালীন মোতায়েন কম গুরুত্বপূর্ণ স্থানে করা হয়। রাশিয়ান বলয় খর্ব করাই পূর্ব ইউরোপের সাবেক কমিউনিস্ট দেশগুলোকে আমেরিকা সাহায্য সহায়তা করে আসছে। ইউক্রেন সুকৌশলে ন্যাটো যোগদান এড়িয়ে যায়। এখন ইউক্রেনের সার্বভৌমত্ব, নিরাপদ সীমান্ত, রাশিয়ান আধিপত্যবাদ থেকে মুক্তি ও বিবিধ কর্মকাণ্ডে আমেরিকা তার মিত্রদের সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে আসছে।
রাশিয়ান ফেডারেশন নিজ সীমান্তে আমেরিকা ও তাদের মিত্রদের ঘেঁষতে দেবে না। রাশিয়ার ভূখণ্ডে লড়তে এসে অনেক দেশ পরাজিত হয়ে ফিরে গেছে।
দুটি বৃহৎ শক্তি পরস্পরের সাথে লড়বে না। তারা লড়াইটা অন্যের মাঠে লড়তে ভালো বাসেন। সম্পদ লুটের সম্ভাবনা থাকলে হয়তো আমেরিকা মিত্রদেরকে দিয়ে এ কাজটা করাবে। এর মাঝে বাইডেন পুতিনের সাথে সংলাপ বন্ধ দিয়ে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রীর সাথে শলা পরামর্শ করছেন। রুশ বাহিনীও সীমান্তে দহরম মহরম দেখিয়ে পেছনে সরে গেছে।
দেখা যাক, সমস্যাটা কার? আমেরিকা, রাশিয়া নাকি ইউক্রেনের।
লেখক: কলামিস্ট কর্নেল (অব.) মো. শাহ জাহান মোল্লা
(প্রকাশিত মতামতের দায় লেখকের, ইউএনবির নয়)
আরও পড়ুন: মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি-১
মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি- ২
মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি-৩
১৩৮৮ দিন আগে