নারী-পুরুষের সমান অধিকার
নারীদের ওপর সাম্প্রতিক হামলা উদ্বেগজনক: প্রধান উপদেষ্টা
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, সম্প্রতি নারীদের ওপর যে জঘন্য হামলার খবর আসছে—তা গভীরভাবে উদ্বেগজনক। এটি ‘নতুন বাংলাদেশ’র যে স্বপ্ন আমরা দেখছি—তার সম্পূর্ণ বিপরীত।’
তিনি বলেন, ‘নতুন বাংলাদেশে’ নারী-পুরুষ সকলের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠায় আমরা আমাদের সকল শক্তি প্রয়োগ করব। ‘
আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে শনিবার (৮ মার্চ) রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে ‘অদম্য নারী পুরস্কার’ বিতরণ অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা বলেন।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে বাংলাদেশের ছাত্র-শ্রমিক-জনতা মিলে যে অসাধ্য সাধন করেছে তার সম্মুখসারির ভূমিকায় ছিল এ দেশের নারীরা। ফ্যাসিবাদী শক্তির প্রাণঘাতি অস্ত্রের সামনে হিমালয়ের মতো দাঁড়িয়েছিল আমাদের মেয়েরা।
আরও পড়ুন: অগ্রগতির জন্য নারীর ক্ষমতায়নকে অগ্রাধিকার দেওয়ার আহ্বান তারেকের
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে সর্বোচ্চ আত্মত্যাগকারী ও অংশগ্রণকারী ও আহত নারীদের স্মরণ করে তাদের দ্রুত সুস্থ-স্বাভাবিক জীবন কামনা করেন তিনি।
ড. ইউনূস বলেন, গণ-অভ্যুত্থানে সম্মুখসারীতে থাকলেও আমাদের সমাজে এখনো অনেকক্ষেত্রেই নারীরা পিছিয়ে আছে। নারীদের অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নে সরকার সবসময় সচেষ্ট। এজন্য বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ চলমান। দুঃস্থ মায়েদের আর্থিক সহায়তা প্রদান, নারীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা, ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচি, কর্মজীবী নারীদের থাকার হোস্টেল, ডে কেয়ার সেন্টার সুবিধাসহ নানান ধরনের উদ্যোগ অন্তর্বর্তী সরকার নিচ্ছে। এ সংক্রান্ত আরও উদ্যোগ নিয়েও আলোচনা চলছে বলে জানন তিনি।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, নারীর প্রতি সহিংসতা রোধ সরকারের অন্যতম অগ্রাধিকার। অনেক সময় নারীরা নির্যাতনের শিকার হলেও তারা বুঝতে পারেন না কোথায় অভিযোগ জানাবেন। নারীরা যেন তাদের অভিযোগ জানাতে পারেন সেজন্য হটলাইন চালু করা হয়েছে। আইনি সহায়তা দেওয়ার জন্য আমরা পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন, ২০১০ হালনাগাদ করার উদ্যোগ নিয়েছি। যৌন হয়রানি প্রতিরোধ ও সুরক্ষা আইন, ২০২৫ প্রণয়নের কাজও আমরা হাতে নিয়েছি। আমরা একটি নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন করেছি, তারাও তাদের সুপারিশগুলো দেবে।
তিনি বলেন, আমাদের দেশের মেয়েরা অত্যন্ত সাহসিকতার সঙ্গে তাদের নিজ নিজ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। শত বাধা পেরিয়ে দেশের রাজনীতি, অর্থনীতিসহ সার্বিকভাবে দেশকে এগিয়ে নিতে অবদান রাখছে।
ড. ইউনূস বলেন, নারীবিরোধী যে শক্তি মাথাচাড়া দেওয়ার চেষ্টা করছে, তাকে আমরা দেশের সকল মানুষকে সঙ্গে নিয়ে অবশ্যই মোকাবিলা করব। তাছাড়া, আমাদের সমাজে এখনো এমন বহু মানুষ আছে—যারা নিপীড়িত নারীদের পাশে দাঁড়ানোর বদলে তাদের খাটো করে দেখে, অবজ্ঞার চোখে দেখে। অথচ নারীর প্রতি সহিংসতা, নারী নির্যাতন প্রতিরোধ করতে হলে, বৈষম্যহীন, সুন্দর বাংলাদেশ গড়তে হলে নারীর পাশে দাঁড়ানোর, তাদেরকে সমর্থন জানানোর, কোনো বিকল্প নেই।
তিনি বলেন, আমাদের সমাজে নারীকে খাটো করে দেখার এই দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে হবে। তা না হলে আমরা জাতি হিসেবে এগোতে পারব না।
আরও পড়ুন: বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রূপান্তরে নারীরা সম্মুখ সারিতে ছিল: প্রধান উপদেষ্টা
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, পতিত স্বৈরাচার দেশে নৈরাজ্য সৃষ্টি করতে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করছে। আমাদেরকে এখন ততটাই সতর্ক থাকতে হবে যেমনটা আমরা যুদ্ধের মতো পরিস্থিতির মধ্যে ছিলাম। নারী ও শিশুদের নিরাপত্তা রক্ষায় সর্বোচ্চ সজাগ থাকুন। নিপীড়নের বিরুদ্ধে সামাজিক ঐক্য গড়ে তুলুন। একে অন্যের পাশে দাঁড়ান। একটি সুন্দর ও শান্তিপূর্ণ সমাজ গড়তে সরকারকে সহযোগিতা করুন।
তিনি আরও বলেন, আজকের বিশ্বে নারীরা যতটুকু অধিকার আর স্বাধীনতা চর্চা করতে পারছেন এর পুরোটাই তাদের আন্দোলন সংগ্রামের মাধ্যমে অর্জন করতে হয়েছে। আন্তর্জাতিক নারী দিবসের সূচনা হয়েছিল নারীদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। নিউইয়র্কের নারী শ্রমিকরা কর্মঘণ্টা কমানো, বেতন বৃদ্ধি ও ভোটের অধিকারের দাবিতে প্রতিবাদ জানাতে রাস্তায় নেমেছিল। অধিকার আদায়ের জন্য আহত ও নির্যাতিত হন।
ড. ইউনূস বলেন, বাংলাদেশেও নারীরা নায্য অধিকারের জন্য যুগযুগ ধরে সংগ্রাম করে এসেছে। তেভাগা থেকে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধে বাংলার নারীসমাজ সক্রিয় ভূমিকা রেখেছে। ইতিহাসের অনেক বীর নারীদের আমরা ভুলে গেছি, তাদের অবদানের কথা জানি না। কিন্তু জুলাই কন্যাদের নেতৃত্ব ও আত্মত্যাগের কথা আমরা কিছুতেই ভুলে যেতে দেবো না।
তিনি বলেন, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া নারীরা বিভিন্ন সময়ে আমাকে তাদের সংগ্রাম ও আশা-আকাঙ্ক্ষার কথা জানিয়েছে। আমরা যে নতুন বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখছি, নারীদের অংশগ্রহণ ও তাদের অধিকার নিশ্চিত করা ছাড়া তা সম্ভব হবে না। এই অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য নারীদের সঙ্গে পুরুষদেরও সহযোদ্ধা হয়ে কাজ করতে হবে।
সমাজে নারীদের নায্য স্থান প্রতিষ্ঠার জন্য পুরুষদেরকে উৎসাহী সহযোগিতায় এগিয়ে আসার আহ্বান জানান প্রধান উপদেষ্টা।
তিনি বলেন, ‘নতুন বাংলাদেশে আমরা আমাদের প্রত্যাশী পরিবারকে নতুনভাবে গড়তে চাই। যেটা সব বাবা-মা’র, ভাই-বোনের নিশ্চিত ও স্বীকৃত অধিকারের পরিবার।’
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘আন্তর্জাতিক নারী দিবস আমাদের নতুন করে নারীদের সংগ্রামের ইতিহাস মনে করিয়ে দেয়, অনুপ্রেরণা আর সাহস যোগায়। সমাজে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় যারা কাজ করছেন তাদের প্রতি আহ্বান জানাই, যত বাধাই আসুক না কেন ইতিহাস আমাদের যে সুযোগ করে দিয়েছে। সে সুযোগ আমরা পরিপূর্ণভাবে ব্যবহার করবই। আমরা নতুন বাংলাদেশ গড়বই। এই আমাদের প্রতিজ্ঞা।’
এসময় মহান মুক্তিযুদ্ধের বীর শহীদদের, বীরাঙ্গনাসহ একাত্তরে সংগ্রামী নারীদের,জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে শহীদ ও আহতদের শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন ড. ইউনূস।
২৭২ দিন আগে