ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা
জুলাই অভ্যুত্থানে ৪১টি জেলার ৪৩৮টি স্থানে হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে: ট্রাইব্যুনালে তদন্ত কর্মকর্তার জবানবন্দি
চব্বিশের জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান চলাকালে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সরকার দলীয় সশস্ত্র নেতাকর্মীরা দেশের ৪১টি জেলার ৪৩৮টি স্থানে হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে।
মঙ্গলবার (৩০ সেপ্টেম্বর) ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে চলমান মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ৫৪তম সাক্ষীর জবানবন্দিতে এ তথ্য দেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মো. আলমগীর (পিপিএম)।
আজ বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ দেওয়া জবানবন্দিতে তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান চলাকালে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সরকারদলীয় সশস্ত্র নেতাকর্মীরা দেশের ৪১টি জেলার ৪৩৮টি স্থানে হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করেছে। এছাড়া ৫০টিরও বেশি জেলায় আন্দোলনকারীদের ওপর মারণাস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে।
সাক্ষীর জবানবন্দিতে তদন্ত কর্মকর্তা মো. আলমগীর বলেন, আমি তদন্তকালে পেয়েছি যে ২০২৪ সালের আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকার যত গুম, খুন, জখম, অপহরণ ও নির্যাতন করেছে তার মূল উদ্দেশ্য ছিল ক্ষমতায় টিকে থাকা। এছাড়া গত ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য বিরোধী দল, মত ও প্রতিপক্ষের ওপর হত্যা, জঙ্গি নাটক, জোরপূর্বক অপহরণ, গুমসহ পাতানো নির্বাচনের মতো সবকিছুর মূলে ছিল দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার বাসনা। আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায় এসেছে, তখন ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করার জন্য যত রকমের ব্যবস্থা আছে তার সবই গ্রহণ করেছে। এর ফলশ্রুতিতে ২০২৪ সালের আন্দোলনে সকল শ্রেণি-পেশার মানুষ অংশগ্রহণ করেছে।
এ দিকে এই মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তার জবানবন্দির অংশবিশেষ ও জব্দ করা ভিডিও বিটিভিতে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়। সেই জুলাই আন্দোলনে নৃশংসতা নিয়ে বিবিসি ও আল জাজিরায় প্রচারিত ভিডিওচিত্রও জব্দ তালিকার অংশ হিসেবে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে প্রদর্শিত হয়। ঐতিহাসিক এই মামলায় এর আগে সাক্ষ্য দিয়েছেন গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম প্রতীক শহীদ আবু সাঈদের পিতাসহ স্বজনহারা অনেক পরিবার। এছাড়া স্টার উইটনেস হিসেবে সাক্ষ্য দিয়েছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির আহ্বায়ক ও জুলাই আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী নাহিদ ইসলাম এবং দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক ড. মাহমুদুর রহমান।
এই মামলায় প্রসিকিউশন পক্ষে চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম, প্রসিকিউটর মিজানুল ইসলাম ও গাজী এসএইচ তামিম শুনানি করছেন। অপর প্রসিকিউটররাও শুনানিতে উপস্থিত ছিলেন। পলাতক শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের পক্ষে শুনানি করছেন রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী আমির হোসেন। আর এই মামলায় গ্রেফতার হয়ে রাজসাক্ষী হওয়া সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের পক্ষে আছেন আইনজীবী যায়েদ বিন আমজাদ।
মানবতাবিরোধী অপরাধের এই মামলায় শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের বিরুদ্ধে গত ১০ জুলাই অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। এক পর্যায়ে এই মামলায় দোষ স্বীকার করে ঘটনার সত্যতা উদঘাটনে (অ্যাপ্রোভার) রাজসাক্ষী হতে সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের আবেদন মঞ্জুর করেন ট্রাইব্যুনাল। পরে রাজসাক্ষী হয়ে তিনি সাক্ষ্য দেন।
এই মামলাটি ছাড়াও শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে আরও দুটি মামলা রয়েছে। এর মধ্যে একটি মামলায় আওয়ামী লীগের সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে গুম-খুনের ঘটনায় তাকে আসামি করা হয়েছে। অন্য মামলাটি হয়েছে রাজধানীর মতিঝিলের শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায়।
গত বছরের জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমনে আওয়ামী লীগ সরকার, এর দলীয় ক্যাডার ও সরকারের অনুগত প্রশাসনসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটি অংশ গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করে বলে একের পর এক অভিযোগ জমা পড়ে। বর্তমানে দুটি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এসব অপরাধের বিচার চলছে।
৬৫ দিন আগে
শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল আজ
জুলাই গণ–অভ্যুত্থানে সংঘটিত গণহত্যাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে তদন্ত শেষ হয়েছে। সোমবার (১২ মে) চিফ প্রসিকিউটর কার্যালয়ে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করবে তদন্ত সংস্থা।
আজ (সোমবার) দুপুর ১টা নাগাদ এ উপলক্ষে এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন (রাষ্ট্রপক্ষ)।
মামলার অন্য দুই আসামি হলেন— সাবেক স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও সাবেক পুলিশ প্রধান চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন। এই তিনজনের বিরুদ্ধে জুলাই গণহত্যার ঘটনায় নির্দেশ দেওয়ার প্রমাণ পেয়েছে তদন্ত সংস্থা।
এর আগে শুক্রবার (৯ মে) এক ফেসবুক পোস্টে চিফ প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম জানিয়েছিলেন, সোমবার তদন্ত রিপোর্ট হাতে পাওয়ার পর আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিলের মাধ্যমে শেখ হাসিনার আনুষ্ঠানিক বিচার শুরু হবে।
নিয়ম অনুযায়ী, ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা প্রথমে চিফ প্রসিকিউটরের কার্যালয়ে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেন। এরপর চিফ প্রসিকিউটর সেই তদন্ত প্রতিবেদন পর্যালোচনা করেন এবং আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (ফরমাল চার্জ) আকারে ট্রাইব্যুনালে দাখিল করেন।
আরও পড়ুন: শেখ হাসিনাকে ফেরাতে ইন্টারপোলের মাধ্যমে চেষ্টা চলছে: স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা
শুক্রবার তাজুল ইসলাম পোস্টে লেখেন, ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে জুলাই গণহত্যার তদন্ত রিপোর্ট সোমবার চিফ প্রসিকিউটর বরাবর দাখিল করবে বলে আশা করছি। তদন্ত রিপোর্ট দাখিল হওয়ার পর ফরমাল চার্জ (আনুষ্ঠানিক অভিযোগ) দাখিলের মাধ্যমে হাসিনার বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক বিচারকাজ শুরু হবে।’
গত বছর ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করা হয়। ওই ট্রাইব্যুনালে গণ-অভ্যুত্থানের সময় হত্যা, গণহত্যাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধে প্রথম মামলাটি (মিস কেস বা বিবিধ মামলা) হয় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে। এ মামলায় পরে চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনকেও (গণ–অভ্যুত্থানের সময় আইজিপির দায়িত্বে ছিলেন) আসামি করা হয়।
এই মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের সময় এ পর্যন্ত তিনবার বাড়ানো হয়েছে। সর্বশেষ গত ২০ এপ্রিল এই মামলার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার জন্য সময় বৃদ্ধির আবেদন করে রাষ্ট্রপক্ষ।
সে আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে দুই মাস বাড়িয়ে আগামী ২৪ জুনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার সময় নির্ধারণ করেন ট্রাইব্যুনাল। অবশ্য এর আগেই তদন্ত প্রতিবেদন তৈরি করার কাজ শেষ হয়েছে বলে জানান ট্রাইব্যুনাল ।
এ মামলা ছাড়াও শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালের আরও দুটি মামলা রয়েছে। এর মধ্যে একটি মামলায় আওয়ামী লীগ শাসনামলের সাড়ে ১৫ বছরে গুম ও খুনের ঘটনায় তাকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। অপর মামলাটি হয়েছে রাজধানীর মতিঝিলের শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায়।
আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিলও চলতি সপ্তাহে
গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়ার আগে রাজধানীর চানখাঁরপুলে গুলি করে হত্যা করা হয় ছয়জনকে। গণহত্যার এ ঘটনায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে করা মামলায় ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমানসহ আটজনকে আসামি করে ইতিমধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন চূড়ান্ত করেছে ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা। গত ২১ এপ্রিল এই প্রতিবেদন চিফ প্রসিকিউটরের কার্যালয়ে জমা দেন তারা।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত হত্যা, গণহত্যাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের কোনো মামলায় এটিই ছিল তদন্ত সংস্থার প্রথম কোনো চূড়ান্ত প্রতিবেদন।
আরও পড়ুন: হেলিকপ্টার দিয়ে ছাত্রজনতার ওপর গুলির নির্দেশ দিয়েছিলেন হাসিনা: এ্যানি
তদন্ত সংস্থার কাছ থেকে পাওয়া প্রতিবেদন ট্রাইব্যুনালে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (ফরমাল চার্জ) আকারে জমা দিতে চার সপ্তাহ সময় নিয়েছে রাষ্ট্রপক্ষ। চলতি মাসের ২৫ তারিখের মধ্যে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করার কথা রয়েছে। অবশ্য তার আগেই আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করা যাবে বলে জানিয়েছেন চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম।
এ বিষয়ে ফেসবুক পোস্টে তাজুল ইসলাম বলেন, ‘ইতোমধ্যে চানখাঁরপুল হত্যাকাণ্ডের দায়ে সিনিয়র পুলিশ অফিসারদের বিরুদ্ধে তদন্ত রিপোর্ট দাখিল করা হয়েছে। ওই হত্যকাণ্ডের দায়ে আনুষ্ঠানিক বিচারের জন্য ফরমাল চার্জ চলতি সপ্তাহেই দাখিল করা হবে এবং এর মাধ্যমে জুলাই গণহত্যার আনুষ্ঠানিক বিচার শুরু হবে।’
২০৭ দিন আগে