���������������
দক্ষিণ এশিয়ার জ্বালানি বিকাশে নবদিগন্তের হাতছানি
যুগান্তকারী একটি জ্বালানি জোট শিগগিরই বদলে দিতে যাচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ার বিদ্যুতের প্রেক্ষাপট। সম্প্রতি ভারত, বাংলাদেশ ও নেপালের মধ্যে একটি ত্রিপক্ষীয় চুক্তি সই হয়েছে। এর বৌদলতে নবদিগন্তের হাতছানি দেখা যাচ্ছে এ অঞ্চলের বিদ্যুতের বিকাশে। চলতি বছরের জুনে নেপালের প্রধানমন্ত্রী পুষ্প কমল দাহাল ভারত সফরে এলে সই হয় এ চুক্তি।
এটি ভারতের শক্তিশালী ট্রান্সমিশন অবকাঠামোর মাধ্যমে নেপাল থেকে বাংলাদেশে জলবিদ্যুৎ প্রবাহের নতুন এক দ্বার উন্মোচন করেছে। এতে একদিকে যেমন জ্বালানি সংকটের কারণে বাংলাদেশের ফের ব্ল্যাকআউট হওয়ার শঙ্কা দূর হলো, তেমনি অন্যদিকে ৯৭ শতাংশ জলবিদ্যুতে আশীর্বাদপুষ্ট নেপালের উদ্বৃত্ত বিদ্যুৎ একটি কাঙ্ক্ষিত বাজারও খুঁজে পেল।
সেইসঙ্গে আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে ৫০০ গিগাওয়াট অজীবাশ্ম জ্বালানি সক্ষমতা অর্জনের যে উচ্চাকাঙ্ক্ষা সে যাত্রায় ভারত সহযোগী হিসেবে কাজ করছে। এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের অর্থায়নে হাই-ভোল্টেজ ট্রান্সমিশন লাইন বাংলাদেশের ভেড়ামারাকে সংযুক্ত করবে ভারতের বহরমপুরের সঙ্গে।
ত্রিদেশীয় এ চুক্তির মাধ্যমে আন্তঃসীমান্ত বিদ্যুৎ বিনিময়ের দিকে অগ্রসর হচ্ছে ভারত, বাংলাদেশ ও নেপাল। এর ফলে আঞ্চলিক জ্বালানি-নিরাপত্তা আরও জোরদার হবে এ জোনে। বিশেষ করে আজকের জ্বালানি-অনিরাপদ বিশ্বে এটি খুবই প্রাসঙ্গিক। তাই পারস্পরিক বোঝাপড়া এবং প্রতিবেশী সহযোগিতার প্রতীক হিসেবে ধরাই যায় যৌথ এ উদ্যোগকে। আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা এবং উচ্চতর সমৃদ্ধির জন্য ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে বিরামহীন আন্তঃসীমান্ত শক্তি সঞ্চালনের যুগের ইঙ্গিত দিচ্ছে এ উদ্যোগ।
চুক্তিটি ফলপ্রসূ হয়েছিল যখন নেপালের প্রধানমন্ত্রী পুষ্প কমল দাহাল শেষবার ভারত সফর করেছিলেন চলতি বছরের জুনে। আর দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের মধ্যে শক্তি সংযোগ বাড়াতে ভারতীয় ট্রান্সমিশন লাইন ব্যবহারের অনুমতি দেওয়ার জন্য নেপালের সঙ্গে সঙ্গে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে ধন্যবাদ দিতেই পারে বাংলাদেশ।
সাম্প্রতিককালে ঘন ঘন লোডশেডিংয়ের সম্মুখীন হচ্ছে বাংলাদেশ। একদিকে প্রাকৃতিক গ্যাস সংকট, আরেকদিকে হ্রাস পাচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। দ্বিতীয় কারণটি কঠিন করে তুলছে দেশের জ্বালানি আমদানির সক্ষমতা। অন্যদিকে, নেপাল ভেজা মৌসুমে তার অভ্যন্তরীণ প্রয়োজনের তুলনায় প্রায় ৩০ শতাংশ বেশি উদ্বৃত্ত জলবিদ্যুতের আশীর্বাদপ্রাপ্ত। তাই বাংলাদেশের কাছে তারা অতিরিক্ত এ বিদ্যুৎ বিক্রি করতে চাইছে। কিন্তু দুপক্ষের এ চাহিদা পূরণে প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছিল দুদেশের মধ্যে গ্রিড সংযোগের অনুপস্থিতি।
উভয়দেশই এ সমস্যা সমাধানে তাই সাহায্য চেয়েছিল মধ্যবর্তী অবস্থানে থাকা ভারতের। আর দুটি দেশেরই ভালো বন্ধু ও প্রতিবেশী হিসেবে ওই প্রস্তাবে সম্মতও হয়েছে ভারত। বহরমপুর-ভেড়ামারা হাই ভোল্টেজ লাইন ব্যবহার করে আন্তঃসীমান্ত বিদ্যুৎ ব্যবসার জন্য আন্তঃসহযোগীতামূলক এক চুক্তিতে প্রবেশ করেছে বাংলাদেশ পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ড, নেপাল ইলেকট্রিসিটি অথরিটি এবং এনটিপিসি বিদ্যুৎ ব্যবসা নিগম (এনভিভিএন)- তিন দেশের এ তিন বিদ্যুৎ কোম্পানি।
বহরমপুর-ভেড়ামারা হাই ভোল্টেজ লাইন। ভেড়ামারায় বাংলাদেশের পশ্চিম বৈদ্যুতিক গ্রিডকে বহরমপুরে ভারতের পূর্ব গ্রিডের সঙ্গে সংযুক্ত করছে উচ্চ ভোল্টেজের এ ট্রান্সমিশন লাইনটি। ত্রিপক্ষীয় চুক্তিটি সম্পাদনের ফলে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের অর্থায়নে ১৯৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের এ উচ্চ ভোল্টেজ লাইনের মাধ্যমে প্রশস্ত হবে আন্তঃসীমান্ত বিদ্যুৎ বাণিজ্যের পথ।
এই লাইনটি ছাড়াও বাংলাদেশ ও নেপাল এরই মধ্যে ভারতের মধ্য দিয়ে আরও একটি ট্রান্সমিশন লাইন বিবেচনা করছে, যা শুধুমাত্র নেপাল ও বাংলাদেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বিদ্যুৎ বাণিজ্যের জন্য নিবেদিত হবে।
অপচয় রোধ করতে কিংবা কমাতে নিজেদের উদ্বৃত্ত বিদ্যুৎ স্থানান্তরের সক্ষমতা গুরুত্বপূর্ণ ছিল নেপালের জন্য। ২৬০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসহ নেপাল তার ৯৭ শতাংশের বেশি উৎপাদন করে জলবিদ্যুৎ। বর্তমানে নেপাল প্রায় ৪৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ ভারতে রপ্তানি করছে। কিন্তু শুষ্ক মৌসুমে বিদ্যুতের চাহিদা মেটাতে নিজেদের জলবিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়িয়েছে দেশটি।
এই বর্ধিত আউটপুট আর্দ্র মৌসুমে উদ্বৃত্ত শক্তিতে পরিণত হয় যা নেপালকে রপ্তানি করতে হবে এবং এর জন্য বাজারের সন্ধানে ছিল দেশটি। ইতোমধ্যে ভারতের সঙ্গে ক্ষমতা ভাগাভাগি চুক্তির ফলে নেপাল কিছু অতিরিক্ত বিদ্যুৎ বাংলাদেশে রপ্তানি করতে চেয়েছিল।
অন্যদিকে নিজস্ব বিদ্যুৎ উৎপাদনের ঘাটতি মেটাতে এবং দেশের বিদ্যুতের চাহিদা মেটাতে বিদ্যুৎ চাইছে বাংলাদেশও।
এ ছাড়া একটি নির্বিঘ্ন বিদ্যুৎ ব্যবস্থার জন্য অদূর ভবিষ্যতে শক্তির প্রচলিত উৎস থেকে নবায়নযোগ্য শক্তির উৎসের দিকে ধাবিত হতে হবে বাংলাদেশকে। এটি কেবল দেশের শক্তি সুরক্ষা নিশ্চিত করতে নয়, দীর্ঘমেয়াদি স্থায়িত্বের জন্যও প্রয়োজনীয়।
রাশিয়া-ইউক্রেন সংকট শুরু হওয়ার পর থেকে জ্বালানি নিরাপত্তাহীনতার হুমকির মুখে পড়েছে উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত দেশগুলো। যুদ্ধের এ প্রেক্ষাপটে বিদ্যুৎ সংকট প্রশমনের নিমিত্তে আন্তঃসীমান্ত জ্বালানি সহযোগিতা এবং পাওয়ার করিডোরের ধারণাকে পুনরুজ্জীবিত করা সময়ের দাবি হয়ে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশের জন্য।
এদিকে নেপাল যেহেতু একটি স্থলবেষ্টিত দেশ, তাই বাংলাদেশে তার উদ্বৃত্ত বিদ্যুৎ রপ্তানি করতে ভারতের সাহায্য ও সমর্থন প্রয়োজন। প্রাথমিক পর্যায়ে বাংলাদেশ ও নেপাল ভারতের সহায়তায় আন্তঃসীমান্ত পাওয়ার ট্রান্সমিশন লিংক ব্যবহার করে প্রায় ৪০ থেকে ৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ বাণিজ্যের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
ভারতের সেন্ট্রাল ইলেক্ট্রিসিটি রেগুলেটরি কমিশন (সিইআরসি) অনুসারে, ভারতের সম্পৃক্ততার ভিত্তিতে এ আন্তঃসীমান্ত বাণিজ্য করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে।
তা ছাড়া ভারত নিজেই নবায়নযোগ্য শক্তি উৎপাদনের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে একটি সবুজ ভারতে রূপান্তরিত হতে চাইছে। যার লক্ষ্য অজীবাশ্ম উৎস থেকে ৫০০ গিগাওয়াট উৎপাদন করা এবং ২০৩০ সালের মধ্যে ৫০ শতাংশ নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহার করা। তাই ভারতেরও এই আন্তঃসীমান্ত চুক্তিতে দারুণ আগ্রহ আছে। কারণ বাংলাদেশের এ পাওয়ার করিডোর ব্যবহার করে তারাও নিজেদের বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ উল্লেখযোগ্যভাবে কমাতে সক্ষম হবে। আর বাংলাদেশ সরকার নিজেও ২০৫০ সালের মধ্যে নবায়নযোগ্য উৎস থেকে ৪০ শতাংশ শক্তির মিশ্রণ পেতে চাইছে, যেখানে এই মুহূর্তে তারা মাত্র তিন শতাংশ বিদ্যুৎ পাচ্ছে নবায়নযোগ্য উৎস থেকে।
মোটকথা, এ ত্রিপক্ষীয় চুক্তিটি নিরবচ্ছিন্ন উপায়ে আন্তঃসীমান্ত বিদ্যুৎ সঞ্চালনের নতুন এক যুগের সূচনা করতে চলেছে, যা দক্ষিণ এশীয়ায় ভারত, বাংলাদেশ ও নেপালের জ্বালানি নিরাপত্তা জোরদার করবে। সবার পারস্পরিক সুবিধার জন্য প্রতিবেশীদের মধ্যে সহযোগিতার প্রমাণ হিসেবে এই যৌথ উদ্যোগ সমগ্র অঞ্চলের জন্যই শুভ। দক্ষিণ এশিয়ার শক্তির দৃশ্যপটকে পুনর্নির্মাণে একটি যুগান্তকারী এক মাইলফলক হতে পারে ত্রিদেশীয় এ শক্তি-বণ্টন চুক্তি।
লেখক: পররাষ্ট্র নীতি বিশ্লেষক এবং সফট পাওয়ার কূটনীতি সম্পর্কিত জাতীয় প্রকল্পের প্রধান তদন্ত কর্মকর্তা, ভারত।
বেদনায় ভরা দিন: শেখ হাসিনা
তখনো ভোরের আলো ফোটেনি। দূরের মসজিদ থেকে আজানের ধ্বনি ভেসে আসছে। এমন সময় প্রচণ্ড গোলাগুলির আওয়াজ। এ গোলাগুলির আওয়াজ ঢাকার ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কের একটি বাড়ি ঘিরে, যে বাড়িতে বসবাস করেন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এক বিঘা জমির উপর খুবই সাধারণ মানের ছোট্ট একটা বাড়ি। মধ্যবিত্ত মানুষের মতোই সেখানে বসবাস করেন দেশের রাষ্ট্রপ্রধান। তিনি সবসময়ই সাধারণ জীবনযাপন করতেন। এই বাড়ি থেকেই ১৯৭১ সালের ২৬-এ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের যে আন্দোলন-সংগ্রাম - এই বাড়িটি তার নীরব সাক্ষী। সেই বাড়িটিই হলো আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু। গোলাগুলির আওয়াজের মধ্যে আজানের ধ্বনি হারিয়ে যায়।
রাষ্ট্রপতির বাসভবনের নিরাপত্তায় সাধারণত সেনাবাহিনীর ইনফেন্ট্রি ডিভিশনকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু মাত্র ১০-১২ দিন পূর্বে বেঙ্গল ল্যাঞ্চারের অফিসার ও সৈনিকদের এ দায়িত্বে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। আমার মা, বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, লক্ষ্য করলেন কালো পোশাকধারী সৈনিকেরা বাড়ির পাহারায় নিয়োজিত। তিনি প্রশ্নটা তুলেছিলেনও। কিন্তু কোনো সদুত্তর পাননি।
আমার বাবা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ছিল দেশের মানুষের প্রতি অঢেল ভালোবাসা। তিনি সকলকেই অন্ধের মতো বিশ্বাস করতেন। তিনি কখনো এটা ভাবতেও পারেননি যে, কোনো বাঙালি তাঁর ওপর গুলি চালাতে পারে বা তাঁকে হত্যা করতে পারে। তাঁকে বাঙালি কখনো মারবে না, ক্ষতি করবে না - এই বিশ্বাস নিয়েই তিনি চলতেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, সেই বিশ্বাসের কি মূল্য তিনি পেয়েছিলেন?
চারদিকে মুহুর্মুহু গুলির আওয়াজ। বিকট শব্দে মেশিনগান হতে গুলি করতে করতে মিলিটারি গাড়ি এসে দাঁড়ালো ৩২ নম্বর রোডের বাড়ির সামনে। গুলির আওয়াজে ততক্ষণে বাড়ির সকলেই জেগে উঠেছে। আমার ভাই শেখ কামাল দ্রুত নিচে নেমে গেল রিসেপশন রুমে - কারা আক্রমণ করলো, কী ঘটনা জানতে। বাবার ব্যক্তিগত সহকারী মহিতুল ইসলাম বিভিন্ন জায়গায় ফোন করার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু কোনো সাড়া পাচ্ছিলেন না।
সেখানে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর কামাল বেরিয়ে বারান্দায় এসে দেখে বাড়ির গেট দিয়ে মেজর নূর ও ক্যাপ্টেন হুদা এগিয়ে আসছে। কামাল তাদের দেখেই বলতে শুরু করলো: আপনারা এসে গেছেন, দেখেন তো কারা বাড়ি আক্রমণ করলো?
ওর কথা শেষ হতে পারলো না। তাদের হাতের অস্ত্র গর্জে উঠলো। কামাল সেখানেই লুটিয়ে পড়লো। অথচ মুক্তিযুদ্ধের সময় মেজর নূর আর কামাল একইসঙ্গে কর্নেল ওসমানীর এডিসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছে। আর সেই কারণে ওরা একে অপরকে ভালোভাবে চিনতো। কিন্তু কী দুর্ভাগ্য! সে চেনা মানুষগুলি কেমন অচেনা ঘাতকের চেহারায় আবির্ভূত হলো। নিজ হাতে গুলি করে হত্যা করলো সহযোদ্ধা কামালকে। কামাল তো মুক্তিযোদ্ধা। দেরাদুন থেকে ট্রেনিং নিয়ে দেশের অভ্যন্তরে যায় যুদ্ধ করতে। এরপর বাংলাদেশ সরকার ক্যাপ্টেন শেখ কামালকে নিয়োগ দেয় বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী প্রধান কর্নেল ওসমানীর এডিসি হিসেবে।
মেজর সৈয়দ ফারুক ট্যাঙ্ক নিয়ে আমাদের বাড়ি লক্ষ্য করে গুলি চালাচ্ছিল। আব্বা সবার আগে ঘর থেকে সেনাবাহিনী প্রধান সফিউল্লাহ সাহেবকে ফোন করেন। তাঁকে জানান বাড়ি আক্রান্ত। তিনি জবাব দেন: আমি দেখছি। আপনি পারলে বাইরে কোথাও চলে যান।
আরও পড়ুন: জাতীয় শোক দিবস: বঙ্গবন্ধুর প্রতি প্রধানমন্ত্রীর শ্রদ্ধা
এর মধ্যে ফোন বেজে ওঠে। কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রব সেরিয়াবাত, আমার সেজ ফুফা, ফোনে জানান যে তাঁর বাড়ি কারা যেন আক্রমণ করেছে। আব্বা জবাব দেন তাঁর বাড়িও আক্রান্ত। আব্বা আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুর রাজ্জাক ও তোফায়েল আহমেদকে ফোন করেন। আব্দুর রাজ্জাক বলেন: লিডার দেখি কী করা যায়। আব্দুর রাজ্জাক স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর দায়িত্বে ছিলেন। তোফায়েল আহমেদ ফোনে বলেন: আমি দেখছি। রিসিভার নামিয়ে রাখতে রাখতে বলতে থাকেন: আমি কী করবো? তোফায়েল আহমেদ রক্ষী বাহিনীর দায়িত্বে ছিলেন। আব্বা নিচে যাওয়ার জন্য ঘর থেকে বের হন। মা পাঞ্জাবিটা পরিয়ে দেন। আব্বা যেতে যেতে - কামাল কোথায় - জিজ্ঞেস করতে থাকেন। কথা বলতে বলতে তিনি সিঁড়ির কাছে পৌঁছান।
এ সময় সিড়ির মাঝের প্ল্যাটফর্মে যারা দাঁড়িয়েছিল তারাও দোতালায় উঠে আসছিল। এদের মধ্যে হুদাকে চিনতে পারেন আব্বা। আব্বা তার বাবার নাম ধরে বলেন: তুমি রিয়াজের ছেলে না? কী চাস তোরা? কথা শেষ করতে না করতেই গর্জে উঠে ওদের হাতের অস্ত্র। তাদের সঙ্গে ইতোমধ্যেই যোগ দিয়েছিল রিসালদার মোসলেউদ্দিন।
ঘাতকদের নির্মম বুলেটের আঘাতে সিঁড়ির উপর লুকিয়ে পড়লেন আব্বা। আমার মা সিঁড়ির দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। ঘাতকের দল ততক্ষণে ওপরে উঠে এসেছে। আমার মাকে তারা বাধা দিল এবং বললো যে আপনি আমাদের সঙ্গে চলেন। মা বললেন: আমি এক পা-ও নড়বো না, কোথাও যাবো না। তোমরা উনাকে মারলে কেন? আমাকেও মেরে ফেলো। ঘাতকদের হাতের অস্ত্র গর্জে উঠলো। আমার মা লুটিয়ে পড়লেন মাটিতে।
কামালের স্ত্রী সুলতানা কামাল ও জামালের স্ত্রী রোজী জামাল মা’র ঘরে ছিল। সেখানেই তাঁদের গুলি করে হত্যা করে ঘাতকেরা। রাসেলকে রমা জড়িয়ে ধরে এক কোণে দাঁড়িয়েছিল। ছোট্ট রাসেল কিছুই বুঝতে পারছে না। একজন সৈনিক রাসেল আর রমাকে ধরে নিচের তলায় নিয়ে যায়। একইসঙ্গে বাড়িতে আরও যারা ছিল তাদেরও নিচে নিয়ে দাঁড় করায়।
গৃহকর্মী আব্দুল গুলিবিদ্ধ হয়েছিল। তাকেও নিয়ে যায়। বাড়ির সামনে আম গাছতলায় সকলকে দাঁড় করিয়ে একে একে পরিচয় জিজ্ঞেস করে। আমার একমাত্র চাচা মুক্তিযোদ্ধা শেখ আবু নাসের পঙ্গু ছিলেন। তিনি বার বার মিনতি করছিলেন: আমার স্ত্রী অন্তঃসত্ত্বা; আমি মুক্তিযোদ্ধা। আমাকে মেরো না। ছোট ছোট বাচ্চারা আমার, ওদের কী হবে? কিন্তু খুনিরা কোনো কথাই কানে নেয় না। তাঁর পরিচয় পেয়ে তাঁকে অফিস ঘরের বাথরুমে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করে।
রমার হাত ধরে রাসেল “মা’র কাছে যাব, মা’র কাছে যাব” বলে কান্নাকাটি করছিল। রমা বারবার ওকে বোঝাচ্ছিল: তুমি কেঁদো না ভাই। ওরা তোমাকে মেরে ফেলবে। কিন্তু অবুঝ শিশু মায়ের কাছে যাব বলে কেঁদেই চলছে। এ সময় একজন পরিচয় জানতে চায়। পরিচয় পেয়ে বলে: চলো, তোমাকে মায়ের কাছে দিয়ে আসি।
ভাইয়ের লাশ, বাবার লাশ মাড়িয়ে রাসেলকে টানতে টানতে দোতলায় নিয়ে মায়ের লাশের পাশেই গুলি করে হত্যা করে। দশ বছরের ছোট্ট শিশুটাকে ঘাতকের দল বাঁচতে দিল না।
যে বাড়ি থেকে একদিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন, সেই বাড়িটি রক্তে ভেসে গেল। সেই রক্তের ধারা ওই সিঁড়ি বেয়ে বাংলার মাটিতে মিশে গেছে- যে মাটির মানুষকে তিনি গভীরভাবে ভালোবাসতেন।
৪৬ ব্রিগেডের দায়িত্বে ছিলেন সাফায়েত জামিল। সেনাপ্রধান তাঁকে ফোন করে পায়নি। সিজিএস খালেদ মোশাররফও কোনো দায়িত্ব পালন করেনি। সেনাবাহিনীর ডেপুটি চিফ জিয়াউর রহমান কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার চেষ্টা করেনি বরং সে পুরো ষড়যন্ত্রের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল। খুনি রশিদ ও ফারুক বিবিসি-তে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জিয়াউর রহমানের জড়িত থাকার কথা বলেছে। খুনি মোস্তাক জিয়াকে সেনাপ্রধান হিসেবে নিয়োগ দেয়। ঢাকার তৎকালীন এসপি মাহবুবকেও ফোন করে পাওয়া যায়নি।
মেজ ফুপুর বাসা
ঘাতকেরা ধানমন্ডির মেজ ফুফুর বাড়ি আক্রমণ করে রিসালদার মোসলেউদ্দিনের নেতৃত্বে। তাদের একটি দল সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে উঠতে গালি দিতে থাকে। বুটের আওয়াজ আর চিৎকার-চেঁচামেচি শুনে মুক্তিযোদ্ধা যুবনেতা এবং বাংলার বাণীর সম্পাদক শেখ ফজলুল হক মনি ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন। বন্দুক তাক করে তাঁকে অকথ্য ভাষায় গালি দিতে থাকে ঘাতকের দল। এ সময় তাঁর অন্তঃসত্তা স্ত্রী আরজু ছুটে এসে স্বামীকে জড়িয়ে ধরে ঘাতকদের বুলেট থেকে বাঁচাতে। কিন্তু ঘাতকের দল তাঁদের লক্ষ্য করে গুলি করে। বুলেটের আঘাতে দুজনের শরীর ঝাঁঝরা হয়ে যায়। মাটিতে লুটিয়ে পড়ে নিথর দেহ দুটি। ছোট দুই ছেলে, তিন বছরের তাপস আর বছর পাঁচেকের পরশ, মা-বাবার লাশের পাশে এসে চিৎকার করতে থাকে আর বলতে থাকে: মা ওঠো, বাবা ওঠো। ওই শিশুদের কান্না মা-বাবা কি শুনতে পেয়েছিল? ততক্ষণে তাঁরা তো না-ফেরার দেশে চলে গেছে। শিশুদের চোখের পানি মা-বাবার রক্তের সঙ্গে মিশে একাকার হয়ে যায়।
সেজ ফুপুর বাড়ি
গুলি করতে করতে মেজর সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান ও মেজর এ এম রাশেদ চৌধুরী মিন্টু রোডে সেজ ফুফার সরকারি বাড়ির সিঁড়ি বেয়ে দোতালায় উঠে যায়। পরিবারের সকল সদস্যকে তাঁদের ঘর থেকে বের করে নিচতলায় বসার ঘরে নিয়ে আসে। এর পর তাদের উপর ব্রাশ ফায়ার করে। গুলির আঘাতে লুটিয়ে পড়েন আবার ফুপু আমিনা সেরনিয়াবাত, আমার ফুফা কৃষিমন্ত্রী মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রব সেরিয়াবাত, তাঁর মেয়ে বিউটি, বেবি, রিনা, ছেলে খোকন, আরিফ, বড় ছেলে আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহর স্ত্রী শাহানা, নাতি সুকান্ত, ভাইয়ের ছেলে মুক্তিযোদ্ধা শহীদ, ভাগ্নে রেন্টু। আট বছরের নাতনি কান্তা গুলিবিদ্ধ লাশের নিচে চাপা পড়ে যাওয়ায় বেঁচে যায়। দেড় বছরের নাতি সাদেক গুলিবিদ্ধ মায়ের বুকে পড়ে কাঁদতে থাকে। আট বছরের কান্তা নিজের ফুফু বেবির লাশের নিচে চাপা পড়েছিল। সেখান থেকে কোন মতে বের হয়ে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে। সারি সারি গুলিবিদ্ধ আপনজন পড়ে আছে। কারও নিথর দেহ, কেউ বা যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন। ঘরের কোণায় রাখা অ্যাকুরিয়াম গুলি লেগে ভেঙে যায়। অ্যাকুরিয়ামের পানির সঙ্গে মাছগুলি মাটিতে পড়ে যায়। রক্ত ভেজা পানিতে মাছগুলিও ছটফট করে লাফাতে থাকে। কিছুক্ষণ আগে যে আপনজন মা, বাবা, দাদা-দাদি, চাচা, ফুফুসহ সকলকে নিয়ে এই শিশুরা ছিল, আর এখন গুলিবিদ্ধ রক্তে ভেজা আপনজন। লাশের নিচ থেকে নিজেকে বের করে ঘরের কোণে দাঁড়িয়ে ৮ বছরের শিশুটি অবাক বিস্ময়ে ভীত-সন্ত্রস্ত চোখে তাকিয়ে থাকে।
আরও পড়ুন: ১৫ আগস্ট: শোক দিবসে জাতির পিতাকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করা হবে
মেজর ফারুক ট্যাঙ্ক নিয়ে লেকের ওপার থেকে ৩২ নম্বরের বঙ্গবন্ধু ভবন লক্ষ্য করে গুলি চালাচ্ছিল। সেই গুলি মোহাম্মদপুরে এক বাড়িতে পড়ে। সেখানে ১১ জন মানুষ নিহত হয় আরও অনেকেই আহত হয়। মেজর ডালিম রেডিও স্টেশন দখলের দায়িত্বে ছিল। সেখান থেকেই সে ঘোষণা দেয়: শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করা হয়েছে। ঘাতকেরা শুধু হত্যা করে তাই নয়, তারা আমাদের বাসা লুটপাট করে। আমার বাবার শোবার ঘরে এবং ড্রেসিং রুমের সকল আলমারি, লকার সবকিছু ভেঙে সেখান থেকে যা কিছু মূল্যবান ছিল - গহনা, ঘড়ি, টাকা-পয়সা লুটপাট করে নিয়ে যায়। বাসায় ব্যবহার করা গাড়িটাও মেজর হুদা ও নূর নিয়ে যায়।
আলমারির সব কাপড় চোপড় বিছানার ওপর পড়েছিল। সেগুলোর অনেকগুলোতে ছিল রক্তের দাগ। এই হত্যাকাণ্ডের পর লুটপাটের ঘটনা মনে করিয়ে দেয় ওদের চরিত্রের অন্ধকার দিকটা। এই ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যারা জড়িত ছিল, তারা এই সদ্য স্বাধীন দেশের মানুষের কত বড় সর্বনাশ করেছিল তা কি ওরা বুঝতে পেরেছিল?
যে বুকে বাংলার মানুষের জন্য প্রচণ্ড ভালোবাসা ছিল, সেই বুকটাই ঝাঁঝরা করে দিল তাঁরই প্রিয় বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর কিছু দুর্বৃত্ত। আমার আব্বা কোনোদিন বিশ্বাস করতেই পারতেন না যে, বাংলাদেশের কোন মানুষ তাঁকে মারতে পারে, বা কোনো ক্ষতি করতে পারে। পৃথিবীর অনেক নেতাই তাঁকে এ বিষয়ে সতর্ক করেছিলেন। কিন্তু তিনি বলেছেন, ওরা তো আমার ছেলে, আমাকে কেন মারবে? এত বড় বিশ্বাস ভঙ্গ করে ওরা বাঙালির ললাটে কলঙ্ক লেপন করল।
কী বিচিত্র এ দেশ! একদিন যে মানুষটির একটি ডাকে এদেশের মানুষ অস্ত্র তুলে নিয়ে যুদ্ধ করে বিজয় এনেছিল, বীরের জাতি হিসেবে সারা বিশ্বের কাছে মর্যাদা পেয়েছিল, আজ এই হত্যাকাণ্ডের মধ্যে দিয়ে সেই জাতি সমগ্র বিশ্বের কাছে বিশ্বাসঘাতক জাতি হিসেবে পরিচিতি পায়। খুনি ও ষড়যন্ত্রকারীদের এদেশের অগণিত জনগণ ঘৃণা করে এবং বিশ্বাসঘাতক হিসেবে চিহ্নিত করে।
আমার অন্তঃসত্ত্বা চাচি ছয় জন সন্তান নিয়ে চরম বিপদের সম্মুখীন হন। খুলনায় ভাড়ার বাসায় বসবাস করতেন। সে বাসা থেকে তাঁকে বিতাড়িত করা হয়। টুঙ্গিপাড়ার বাড়িও সিল করে রাখা হয়। ঘরবাড়ি হারা সদ্য বিধবা কোথায় ঠাঁই পাবেন?
সোবহানবাগ
আব্বার সামরিক সচিব কর্নেল জামিল তাঁর ব্যক্তিগত গাড়িতে করে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির দিকে রওয়ানা হন। সোবহানবাগ মসজিদের কাছে তাঁর গাড়ি আটকে দেয় ঘাতকেরা। তিনি এগোতে চাইলে ঘাতকেরা তাঁকে খুব কাছ থেকে গুলি করে হত্যা করে।
আমাদের বাড়ির নিচে পুলিশের বিশেষ শাখার সদস্য এসআই সিদ্দিকুর রহমানকেও তারা গুলি করে হত্যা করে।
বেলজিয়াম
ক্রিং ক্রিং ক্রিং ...। টেলিফোনটা বেজেই যাচ্ছে। আমার ঘুম ভেঙে গেল। মনে হলো টেলিফোনের আওয়াজ এত কর্কশ? আমি ঘুম থেকে উঠে সিঁড়ির কাছে দাঁড়ালাম। দেখি নিচে অ্যাম্বাসেডর সানাউল হক সাহেব ফোন ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। আমাকে দেখে বললেন, ওয়াজেদের সঙ্গে কথা বলবেন। আমি তাঁকে ঘুম থেকে ডেকে তুললাম। অপর পারে জার্মানির অ্যাম্বাসেডর হুমায়ুন রশিদ সাহেব কথা বলছেন। তিনি জানালেন বাংলাদেশে ক্যু হয়েছে। আমার মুখ থেকে বের হলো: “তাহলে তো আমাদের আর কেউ বেঁচে নাই”। রেহানা পাশে ছিল। তাঁকে জড়িয়ে ধরলাম। কিন্তু তখনও জানি না কী ঘটনা ঘটেছে।
মাত্র ১৫ দিন আগে জার্মানি এসেছি। বেলজিয়ামে বেড়াতে এসেছি। নেদারল্যান্ডেও গিয়েছিলাম। আব্বা বলেছিলেন, নেদারল্যান্ড কীভাবে সাগর থেকে ভূমি উত্তোলন করে - পারলে একবার দেখে এসো। একদিন আগেই আব্বা-মার সঙ্গে কথা হয়েছে। কেন জানি মা খুব কাঁদছিলেন। বললেন “তোর সাথে আমার অনেক কথা আছে, তুই আসলে আমি বলবো।” আমাদের খুব খারাপ লাগছিল। মনে হচ্ছিল তখনই দেশে ছুটে চলে যাই।
আব্বা বললেন: রোমানিয়া ও বুলগেরিয়াতে তিনি যাবেন। আর ফেরার পথে আমাদের নিয়ে আসবেন।
কিন্তু আমাদের আর দেশে ফেরা হলো না। একদিন পরই সব শেষ। বেলজিয়ামের বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত সানাউল হক, যিনি রাজনৈতিক সদিচ্ছায় অ্যাম্বাসেডর পদে নিয়োগ পেয়েছিলেন, রাতারাতি তার চেহারাটাই পাল্টে গেল। তিনি জার্মানিতে নিয়োজিত রাষ্ট্রদূত হুমায়ূন রশিদ সাহেবকে বলেন, যে বিপদ আমার কাঁধে পাঠিয়েছেন তাঁদের ফেরত নেন।
যিনি আগের রাতে আমাদের জন্য ‘ক্যান্ডেল লাইট ডিনার’ এর আয়োজন করেছিলেন; কত খাতির, আদর-যত্ন, আর এখন আমরা তার কাছে আপদ হয়ে গেলাম। আমাদের বর্ডার পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়ার জন্য গাড়িটাও দিলেন না। বেলজিয়াম অ্যাম্বাসিতে কর্মরত আমার স্কুলের বান্ধবী নমি’র স্বামী জাহাঙ্গীর সাদাতের গাড়িতে করে আমদের বেলজিয়াম বর্ডারে যেতে বললেন। জাহাঙ্গীর সাদাত আমাদের জার্মানির বর্ডারে পৌঁছে দিলেন। সেখান থেকে পায়ে হেঁটে নোম্যান্স ল্যান্ড পার হয়ে আমরা জার্মানির মাটিতে পৌঁছলাম। জার্মানির অ্যাম্বাসেডর হুমায়ুন রশিদ সাহেব গাড়ি পাঠিয়েছেন। আর তাঁর স্ত্রী আমার বাচ্চাদের জন্য শুকনো খাবার-দাবারও গাড়িতে দিয়েছিলেন। তাঁদের কাছে কয়েকদিন আশ্রয় পেলাম। তাঁদের আদর যত্ন দুঃসময়ে আমাদের জন্য অনেক মূল্যবান। আমরা কোনোদিন ভুলতে পারবো না হুমায়ুন রশীদ ও তাঁর স্ত্রীর অবদান। জার্মান অ্যাম্বাসির সকল অফিসার ও কর্মচারি আমাদের অত্যন্ত যত্ন করেছিলেন। অ্যাম্বাসির গাড়িতে আমাদের কার্লস রুয়ে পৌঁছে দিলেন। জার্মান সরকার, যগোস্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট মার্শাল টিটো, ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীসহ আরও অনেকে আমাদের রাজনৈতিক আশ্রয় দিতে চাইলেন। জার্মানিতে নিযুক্ত ভারতের অ্যাম্বাসেডর জনাব হুমায়ুন রশিদ ও ডক্টর ওয়াজেদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন। তিনি আমাদের ভারতে যাওয়ার সব ব্যবস্থা করে দেন। আমরা জার্মানি থেকে ভারতে পৌঁছালাম।
উপসংহার
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের রক্তাক্ত বেদনার আঘাত বুকে ধারণ করে আমার পথচলা। বাবা মা ভাইদের হারিয়ে ৬ বছর পর ১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশে ফিরে আসতে পেরেছি। একটি প্রতিজ্ঞা নিয়ে এসেছি, যে বাংলাদেশ আমার বাবা স্বাধীন করে দিয়ে গেছেন, তা ব্যর্থ হতে পারে না। লাখো শহিদের রক্ত আর আমার বাবা-মা ভাইদের রক্ত ব্যর্থ হতে আমি দেব না।
আমার চলার পথ খুব সহজ ছিল না, বারবার আমার উপর আঘাত এসেছে। মিথ্যা অপপ্রচার, গুলি, বোমা ও গ্রেনেড হামলার শিকার হতে হয়েছে আমাকে। খুনি জিয়াউর রহমানের স্ত্রী খালেদা জিয়া বিভিন্ন সময় বলেছিল, “শত বছরেও আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যেতে পারবে না।” “শেখ হাসিনা, প্রধানমন্ত্রী তো দূরের কথা বিরোধী দলের নেতাও কখনো হতে পারবে না।” এর পরেই তো সেই ভয়াবহ ২০০৪ সালের ২১-এ আগস্টের গ্রেনেড হামলা। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা মানবঢাল রচনা করে সেদিন আমাকে রক্ষা করেছিলেন। উপরে আল্লাহ, আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী আর বাংলাদেশের জনগণই আমার শক্তি। আমার চলার কণ্টকাকীর্ণ পথে এরাই আমাকে সাহায্য করে চলেছেন। তাই আজকের বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়িয়েছে।
২০০৯ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত জনগণের নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় আছে বলেই আজকের বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পেয়েছে। বাংলাদেশের জনগণকে ক্ষুধার হাত থেকে মুক্তি দিতে পেরেছি। তারা এখন উন্নত জীবনের স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে। আত্মবিশ্বাস ফিরে পেয়েছে।
বাবা! তুমি যেখানেই থাক না কেন, তোমার আশীর্বাদের হাত আমার মাথার উপর আছে - আমি তা অনুভব করতে পারি। তোমার স্বপ্ন বাংলাদেশের জনগণের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষার ব্যবস্থা করে সোনার বাংলাদেশ গড়ে তুলবো। তোমার দেশের মানুষ তোমার গভীর ভালোবাসা পেয়েছে আর এই ভালোবাসার শক্তিই হচ্ছে এগিয়ে যাবার প্রেরণা।
লেখক- বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জ্যেষ্ঠ কন্যা।
আরও পড়ুন: শোক দিবস: বঙ্গবন্ধুর প্রতি প্রধানমন্ত্রীর শ্রদ্ধা নিবেদন
পাকিস্তান-রাশিয়া নয়া সম্পর্ক: এক দেশভিত্তিক সম্পর্ক আর নয়
সম্প্রতি পাকিস্তান ও রাশিয়া বন্ধু হওয়ার সর্বাত্মক চেষ্টা করছে। কারণগুলোও অতি সহজ।
প্রথমত- রাশিয়াকে পণ্য বিক্রি করতে হবে।
দ্বিতীয়ত- পাকিস্তানকে দ্রুত ও সস্তা পণ্য কিনতে হবে।
রাশিয়া জুনের মাঝামাঝি করাচি বন্দর দিয়ে পাকিস্তানে অপরিশোধিত তেল সরবরাহ করেছে। পাকিস্তানে ১ লাখ মেট্রিক টন রাশিয়ান অশোধিত তেল পাঠানোর জন্য এপ্রিল মাসে এ চুক্তিটি করা হয়েছিল।
চুক্তির রাজনীতি
বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক বলয়ের বাইরেও এই চুক্তির প্রভাব রয়েছে। পাকিস্তানের সঙ্গে যা কিছু ঘটে, তার একটি ভারতীয় দিক থাকে। এটি চুক্তিটিও ভিন্ন নয়। রাশিয়া পাকিস্তানের ঘনিষ্ঠ বৃত্তের অংশ নয়, তবে তারা ভারতের ঘনিষ্ট।
কিছু সূত্রের তথ্যমতে, এই সম্পর্কটি (ভারত-রাশিয়া) নাকি চাপের মধ্যে আছে। এগুলো মূলত মার্কিন সূত্রের খবর।
আরও পড়ুন: রাশিয়ার সংসদীয় গ্রুপের সঙ্গে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের বৈঠক
পরিস্থিতি থেকে আরও বোঝা যাচ্ছে, আজীবনের বন্ধু বা ‘আমার বন্ধু, তোমার মিত্র’- টাইপ ভাবনার মডেলের সংস্কার চলছে; পরিবর্তন এসেছে।
সুন্দরভাবে যেটিকে ‘গ্লোবাল সাউথ’ বলা হয়, সেখানকার নেতা ও মানুষেরা এতটাই বোকা না যে তারা সবকিছু মেনে নেবে। এমনকি এখন তারা পশ্চিমসহ কোনো ব্লকের প্রতি স্থায়ী আনুগত্যে বিশ্বাস করে না।
মস্কো, পশ্চিম, বেইজিং এবং এমনকি বহিরাগত এলিয়েনও যদি এগিয়ে আসে, অনেকে তাদের সঙ্গেও সম্পর্ক তৈরির জন্য আগ্রহীI আর ইউক্রেন যুদ্ধ এই প্রক্রিয়াটিকে ত্বরান্বিত করেছে।
রাশিয়া ও পাকিস্তান ছিল স্নায়ুযুদ্ধে একে অন্যের ঘোর শত্রু। বিশেষত ১৯৭১ সালের যুদ্ধের সময় এটি সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছায়, যখন রাশিয়া ভারতকে সমর্থন করে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে।
অন্যদিকে, চীন সেসময় রাশিয়ার বিরুদ্ধে নতুন বন্ধু ও মিত্রদের সন্ধানে ব্যস্ত ছিল। সেসব পুরনো কথা।
দৌড়ের ওপর কঠিন সিদ্ধান্ত
তবে আফগানিস্তানে মার্কিন নেতৃত্বাধীন যুদ্ধের পরবর্তী পর্যায়ে সম্পর্ক একটু ভাল হয়েছিল, কারণ তাদের যৌথ স্বার্থ ছিল। অর্থাৎ সন্ত্রাসবাদ দমন এবং তালেবানের সঙ্গে পুনর্মিলনের বিষয়।
২০২২ সালে যখন পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান মস্কো সফর করেন, তখন এজেন্ডার শীর্ষে ছিল তেল বা এনার্জি।
ততক্ষণে রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করেছে। এতে বিশ্বজোড়া সম্পূর্ণ নতুন একটি জগাখিচুড়ি তৈরি হয়েছে এবং এর ফলাফল এখনও অস্পষ্ট।
কিন্তু পরিস্থিতি অনিশ্চিত হওয়ার কারণেই ছোট/দুর্বল দেশগুলো দৌড়ের ওপর খুব কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হচ্ছে।
পাক-রাশিয়া এপ্রিলের তেল চুক্তিটিকে ‘ট্রায়াল রান’ বলা হয়েছিল, তবে স্পষ্টতই তেলের ড্রামে এর চেয়ে আরও বেশি কিছু রয়েছে।
স্পষ্টতই পাকিস্তান রাশিয়ান অপরিশোধিত দিয়ে তার ট্যাঙ্কের এক-তৃতীয়াংশ পূরণ করার পরিকল্পনা করছে, যার অর্থ তারা শুধুমাত্র মধ্যেপ্রাচের তেলের ওপর নির্ভর করতে চায় না, যা বিশ্বব্যাপী অনিশ্চয়তা নতুন হিসাব-নিকাশ তৈরি করছে।
অন্যদিকে, রাশিয়াও ‘দিল’ খুলে বন্ধুত্বের বোতলে তেল ঢালছে।
এমনকি পাকিস্তানের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ৭৫ বছরপূর্তি অনুষ্ঠানে রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ উর্দুতে ‘পাকিস্তান-রাশিয়া সম্পর্ক দীর্ঘজীবী হোক’- বলে তার বক্তৃতা শেষ করেন।
এ নিয়ে টলস্টয় কি ভাববেন সেটা জানা যায় নি।
আরও পড়ুন: বাংলাদেশ ২০২৩-২৪ সালে অর্থনীতির সব খাতে পাকিস্তানকে পেছনে ফেলেছে: প্রতিবেদন
ভারতকে কি একটু চিন্তায় ফেলেছে?
রাশিয়া ও চীনের বন্ধুত্বের বিষয়টি প্রাক্তনের সঙ্গে রোম্যান্স পুনরুজ্জীবিত করার একটি ক্লাসিক উদাহরণ। একইসঙ্গে উভয়ই একসময় ‘সমাজতান্ত্রিক’ ব্লকের অংশ ছিল, যা ১৯৬১ সালে ভেঙে যায়।
তবে সম্পর্কের মেরামত চলছে এবং উভয়ই অস্ত্রের বিষয় নিয়ে কথা বলছে। এটাই নয়াদিল্লিকে কিছুটা উদ্বিগ্ন করছেI সে আশঙ্কা করছে যে মস্কো তার নতুন প্রেমিক চীনকে বেশি পছন্দ করতে পারে এবং তার সঙ্গে অস্ত্র সহযোগিতা কমাতে পারেI
তবে এটি এখনও ঘটেনি, যদিও মার্কিনিরা খুব আশাবাদী যে অচিরেই এমনটা ঘটবে।
নতুন অংক, পুরনো শত্রু
ভারত বিশেষজ্ঞরা পাকিস্তানের সঙ্গে রাশিয়ার নয়া মাখামাখি’র ভবিষ্যত সম্পর্কে সতর্কI তবে তারা বলছে যে এটি পাকিস্তান বা ভারতের সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্কের পুনর্বিন্যাস নয় এবং মস্কো ও ইসলামাবাদের মধ্যে সমীকরণ ইতিবাচক; তবে দীর্ঘস্থায়ী হওয়া সম্ভব নয়।
কারণ পাকিস্তানের পকেট ছিঁড়ে গেছে এবং তারা মস্কোকে বেশিদিন অর্থ দিতে পারবে না; কারণ তার (রাশিয়ার) নিজের পকেটও মেরামত করা যথেষ্ট প্রয়োজন।
তবে পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় উদ্বেগের বিষয় হতে পারে যে রাশিয়ার সঙ্গে খুব বেশি প্রণয় করলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ক্ষুব্ধ হবে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই আইএমএফ ও ওয়ার্ল্ড ব্যাংককে নিয়ন্ত্রণ করে। আর পাকিস্তানের এখন তাদের ভীষণ প্রয়োজন।
সুতরাং, পশ্চিমা দেশগুলো যে তেলের দাম নির্ধারণ করেছে, পাকিস্তানকে তা মেনে চলতে হবেI না হয় মার্কিন নিষেধাজ্ঞার মুখোমুখি হতে হবে।
মার্কিন, রাশিয়া এবং দক্ষিণ এশিয়া
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বলছে যে নগদ টাকার ঘাটতির কারণে রাশিয়া আর নির্ভরযোগ্য সরবরাহকারী নয়, কিন্তু ভারত এই খেলায় পুরানো পাপী।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা বাড়ালেও ভারত এখনও রাশিয়ার সঙ্গে একটি ‘সব সময়ের বন্ধু’-মার্কা পোজ দিচ্ছে।
কারণ ভারত নিশ্চিত হতে চায় যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কৌশলগত বিয়েতে গেলে সে রাশিয়ার চেয়ে ভাল পার্টনার পাবেI তবে ভারত নিশ্চয়ই শিশু বা কিশোরীর মতো মালাবদলের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়বে না, কারণ এতে অর্থ জড়িত; আর এটাই আসল কথা।
এখন দক্ষিণ এশিয়ার কোনো দেশই আর কোনো সরবরাহকারী কাম সুপার পাওয়ারের সঙ্গে একচেটিয়া সম্পর্ক করার চুক্তিতে যাচ্ছে না। সব দরজা খোলা রাখতে চায় সবাইI আর এটা শুধু ভারত ও পাকিস্তানই করছে, এমন না।
বাংলাদেশ যেমন মার্কিন নিষেধাজ্ঞা দেওয়া অনুমোদিত কয়েক ডজন রুশ জাহাজ তার বন্দরে ভিড়তে বাধা দিয়েছে, অন্যদিকে আবার রাশিয়ার সঙ্গে চীনা মুদ্রায় লেনদেন অব্যাহত রেখেছে।
(প্রকাশিত মতামতের দায় লেখকের, ইউএনবির নয়)
আরও পড়ুন: রাশিয়ার থ্রিডি-প্রিন্টেড রকেট উৎক্ষেপণের পরপরই ব্যর্থ!
বাংলাদেশের অর্থনীতি সংস্কারে ভূমিকা রাখবে আইএমএফের ঋণ
গত ফেব্রুয়ারি মাসে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে ‘রেসিলিয়েন্ট সাসটেইনেবল ফান্ড’ এর আওতায় ঋণ সহায়তার প্রথম কিস্তি পেয়েছে বাংলাদেশ। ডলারের হিসেবে যার পরিমাণ ৪৭ কোটি ৬২ লাখ ৭০ হাজার ডলার।
আইএমএফ থেকে সাড়ে তিন বছর ধরে সাত কিস্তিতে যে ৪৭০ কোটি মার্কিন ডলারের ঋণ পাচ্ছে, তার মূল্যও কম নয়।
কারণ, এ ঋণের বিপরীতে মোটা দাগে ৩৮টি শর্ত পূরণ করতে হবে বাংলাদেশকে। আর এই অর্থনীতি সংস্কারের শর্ত পূরণের মূল্য দিতে হতে পারে দেশের খেটে খাওয়া মানুষদের।
আইএমএফের মূল শর্তগুলোর মধ্যে রয়েছে- আন্তর্জাতিক নিয়মের সঙ্গে মিল রেখে এদেশের রিজার্ভ ব্যবস্থা পুনর্গঠন করা, ব্যাংকঋণের সুদহারের সীমা তুলে দেওয়া, ডলারের দাম বাজারের ওপর ছেড়ে দিয়ে একটি নির্দিষ্ট দাম ঠিক করা, সব সময় জ্বালানি তেলের দাম আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে মিলিয়ে সমন্বয় করা, মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) তুলনায় রাজস্ব সংগ্রহের হার বৃদ্ধি ইত্যাদি।
এছাড়াও বিভিন্ন খাত থেকে উল্লেখযোগ্য হারে ভর্তুকি কমানো, ব্যাংকঋণের সুদের হার বৃদ্ধি, ডলারের একদর করাসহ আইএমএফ যে সকল সুপারিশ বাংলাদেশ সরকারকে বাস্তবায়ন করতে বলেছে; সেগুলার একটি সরাসরি প্রভাব দেশের সাধারণ জনগণের ওপর পড়ছে।
বাংলাদেশ মূলত জ্বালানি, বিদ্যুৎ ও গ্যাসে ভর্তুকি দিয়ে থাকে; যার পরিমাণ জিডিপির ০.৪ শতাংশ।
বিদ্যুৎ খাতে বাংলাদেশ সরকারের ভর্তুকির পরিমাণ প্রতিবছর প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার এবং গ্যাসে প্রায় ০.৪ বিলিয়ন ডলার।
আরও পড়ুন: বাংলাদেশ ব্যাংকের আশা আইএমএফ ঋণের প্রথম কিস্তি আগামী মাসের মধ্যে আসবে: মুখপাত্র
বাংলাদেশে বিগত বছরগুলোতে কয়েক দফায় বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে। কারণ আইএম এফ এর শর্ত হলো অলাভজনক খাতগুলো থেকে ভর্তুকি তুলে নেওয়া।
মূলত গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়েনি, বরং এসব পণ্যের মূল্যের বড় একটি অংশ আগে সরকার পরিশোধ করত, কিন্ত এখন সেটি ভোক্তা পর্যায়ে পরিশোধ করতে হচ্ছে।
ব্যাংকঋণের সুদহারের সীমা তুলে দিলে ব্যাংকগুলো ঋণের সুদ বাড়িয়ে দেবে। এতে পণ্য ও সেবা উৎপাদনের খরচ বেড়েছে, ফলে বেড়েছে পণ্যের দামও। যার ভুক্তভোগী হচ্ছে নিম্ন আয়ের মানুষ।
যদি ডলারের দাম বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়, তাহলে রাতারাতি এদেশে ডলারের দাম বেড়ে যাবে এবং ডলারের বিপরীতে বাংলাদেশি মুদ্রা টাকার বড় ধরনের অবমূল্যায়ন হতে পারে।
তখন পণ্য আমদানিতে খরচ আরও বেড়ে যেতে পারে, যা মূল্যস্ফীতিতে ব্যাপক প্রভাব ফেলবে।
এদিকে, ঋণপ্রাপ্তির প্রথম দুই বছরে কর-জিডিপি দশমিক ৫০ শতাংশ এবং তিন বছরে দশমিক ৭০ শতাংশ হারে বৃদ্ধির কথা বলেছে আইএমএফ।
দেশের রাজস্ব প্রশাসনের প্রবণতা হচ্ছে, যারা কর দেন তাদের ওপরই বাড়তি করের বোঝা চাপানো।
অর্থাৎ এদেশের কর-রাজস্ব আয়ের ক্ষেত্রটি বিস্তৃত হলেও আমাদের কর সংগ্রহ ব্যবস্থায় যথেষ্ট ফাঁক-ফোকর রয়েছে। এদেশের চাকরিজীবীরাই একমাত্র নিয়মিত কর দেয়।
যদি কর-রাজস্ব আয় বৃদ্ধির জন্য মাথাপিছু কর বাড়ানোর পরিকল্পনা নেওয়া হয়, তবে সেটি হবে কিছু নির্দিষ্ট সংখ্যক মানুষের ওপর একটি বাড়তি বোঝা।
সরকার ইতোমধ্যে জ্বালানি তেল, গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েছে; যার প্রভাব জিনিসপত্রের দামের ওপর পড়েছে। এগুলোতে সরকার আর ভর্তুকি দিতে রাজি নয়। জ্বালানি তেল ও গ্যাসের দাম বাড়িয়ে বর্তমানে যে জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে, তা আন্তর্জাতিক বাজারদরের কাছাকাছিই আছে।
আরও পড়ুন: সাড়ে ৪ বিলিয়ন ডলার ঋণ চুক্তি চূড়ান্ত করতে ঢাকায় আসছেন আইএমএফ’র ডিএমডি
২০২৬ সালের মধ্যে সরকারি মালিকানাধীন ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার ১০ শতাংশের মধ্যে ও বেসরকারি খাতের ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৫ শতাংশের মধ্যে নামিয়ে আনতে বলেছে আইএমএফ।
এদিকে আইএমএফকে বাংলাদেশ জানিয়েছে, ব্যাংকের পুনঃতফসিল করা ঋণকেও খেলাপি ঋণের হিসাবে আনা হচ্ছে, যা আগামী জুনের মধ্যে কার্যকর হবে।
এর বাইরে দ্রুততম সময়ে আয়কর আইন ও শুল্ক আইন প্রণয়ন, ব্যাংক কোম্পানি আইনের সংশোধন, ফাইন্যান্স কোম্পানি আইনের সংশোধন এবং দেউলিয়া আইন প্রণয়নের শর্তও রয়েছে আইএমএফের।
শুধু ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম ৩ মাসে বাংলাদেশের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১৩৪৩.৯৬ বিলিয়ন টাকা এবং এই খেলাপী ঋণের পরিমাণ দিন দিন বেড়েই চলছে।
আইএমেফের এই শর্তটি বাস্তবায়ন করা গেলে দেশে ঋণ খেলাপির পরিমাণ অনেকটা কমে যাবে বলে আশা করা যায়।
এছাড়াও, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোকে তিন মাস পরপর জিডিপির তথ্য প্রকাশ, প্রকৃত ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভের হিসাবায়ন পদ্ধতি এবং আন্তর্জাতিক নিয়মের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে মুদ্রাস্ফীতি পরিমাপ পদ্ধতির প্রণয়ন আগামী জুনের মধ্যেই বাস্তবায়ন করতে বলা হয়েছে।
আইএমএফের ঋণের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতির যে সংস্কার হবে বলে মনে করা হচ্ছে, সেই সংস্কারের ঢেউয়ের প্রভাব শুধু নির্দিষ্ট কোনো একটি শ্রেণির মানুষের ওপরে না পড়ে, দেশের সকল মানুষের ওপর ন্যায়সঙ্গতভাবে পড়ুক; তবেই দেশের উন্নয়ন টেকসই হবে।
(প্রকাশিত মতামতের দায় লেখকের, ইউএনবির নয়)
আরও পড়ুন: আইএমএফ’র ঋণ একটি চারিত্রিক সনদের মতো: প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা মশিউর
হিরো আলমের যুদ্ধ চলবেই
হিরো আলম একজন বাজে গায়ক এবং ততোধিক খারাপ অভিনেতা। তিনি তার নিতান্ত ‘অনাকর্ষণীয়’ রূপ নিয়েই সমাজের প্রতিষ্ঠিত ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাতে শুরু করেছেন। তার আগেও অল্পকিছু মানুষ এমনটি করার দুঃসাহস দেখিয়েছিলেন।
সমাজের প্রতিষ্ঠিত মানুষেরা তাকে ‘অসৎ, সংস্কৃতি জ্ঞানহীন, নিচু শ্রেণির ও অশিক্ষিত’-বলে সম্বোধন করলেও, তার ভক্তরা এসব বিষয়কে খুব একটা পাত্তা দেয় বলে মনে হয় না।
বাংলাদেশের শহুরে অভিজাত সুশীল শ্রেণির অনেকেই আলমকে ‘অচ্ছুৎ’ বলে মনে করেন। তার ব্যক্তিত্ব ও কর্মকাণ্ড সবকিছুরই অপব্যাখা করেন তারা। কিন্তু এরপরেও কোনোভাবেই তারা আলমকে আটকাতে পারছে না, এটাই তাদের মূল সমস্যা।
তারা সবচেয়ে খুশি হয়েছিল যখন পুলিশ হিরো আলমকে গ্রেপ্তার করে এবং সেসব গান গাইতে নিষেধ করে; বিশেষত যেগুলো রবীন্দ্র অনুরাগী সুশীলদের ‘সংবেদনশীলতায়’ আঘাত করে।
সেসময় বেশ কয়েকজন শীর্ষ স্থানীয় সুশীল ও কণ্ঠশিল্পী পুলিশের কাছে হিরো আলমের গান গাওয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছিলেন।
পরবর্তীতে রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রণীত সংগীত আইন মেনে চলার প্রতিশ্রুতিতে তাকে মুক্তি দেয়া হয়েছিল।
তবে বলতেই হয় আলম একজন ভাগ্যবান মানুষ, তাই র্যাব তাকে তুলে নিয়ে যায়নি। ভাগ্যিস, মার্কিন নিষেধাজ্ঞা ছিল!
আরও পড়ুন: এবার জরিমানার ফাঁদে হিরো আলম!
গলার কাঁটা
গ্রেপ্তারের বিষয়টি তার জন্য সাপে বর হয়ে যায় এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হিরো আলম আরও বেশি আলোচিত হয়ে ওঠেন। এমনকি সেসময় হিরো আলম নিজেও সামাজিক মাধ্যমের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গিয়ে নিজের অবস্থান ও বিভিন্ন অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছিলেন।
সরকারের পক্ষ থেকে পুলিশকে এ বিষয়ে জড়ানোর কথা বলাটা আসলেই হাস্যকর ছিল।
কারণ, বাজে গান যদি আইন-শৃঙ্খলার জন্য সমস্যা হয়; তবে দেশের অনেক রাজনৈতিক নেতার বক্তব্য ও হাস্যরসাত্মক মন্তব্যের জন্য পুলিশকে প্রতিদিন কয়েক ঘন্টা নষ্ট করতে হবে।
দুঃখজনকভাবে, সুশীলদের জন্য এরপর আরও বড় ধামাকা অপেক্ষা করছিল।
গান গাওয়ার ব্যাপারটা ওখানেই শেষ হলেও, এরপরই শোনা যায় এবার হিরো আলম সংসদ উপনির্বাচনে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন।
অনেক ব্যঙ্গবিদ্রুপের পরে নির্বাচনের ফল ঘোষণার পর দেখা যায়, হিরো আলমকে মাত্র ১ হাজারেরও কম ভোটে হারানো হয়েছে।
দুঃখজনকভাবে বিজয়ী জাসদের প্রার্থী তানসেন জাতীয় পর্যায়ে পরিচিত মুখ না হওয়ায়, তার জয়ের চেয়ে হিরো আলমের পরাজয়ই বড় খবর হয়ে ওঠে।
আরও পড়ুন: মাইক্রোবাস উপহার নিতে হিরো আলম যাচ্ছেন হবিগঞ্জ
তানসেন যেহেতু আ.লীগ সমর্থিত প্রার্থী ছিলেন, অতীতের নির্বাচনী অভিজ্ঞতার আলোকে স্বভাবতই জনগণ মনে করছে হিরো আলমকে সংসদে যেতে না দেয়ার জন্যই জোর করে তাকে হারানো হয়েছে।
ইসি অবশ্য নির্বাচনে কারচুপির কথা অস্বীকার করেন এবং এ বিষয়ে হিরো আলমের তোলা অভিযোগ প্রত্যাখান করেন।
তবে সংশ্লিষ্ট সবার মাথাব্যাথা আরও বেড়ে যায় তখন, যখন মানুষ ইসির কথা না বিশ্বাস করে হিরো আলমের কথাই বিশ্বাস করে।
তবে এখন মনে হচ্ছে এই মানুষটিকে (হিরো আলম) ঘিরে অনেক কিছু চলছে এবং গান গাওয়া ও ভোট দেয়ার বাইরেও তার আরও অনেক বড় বড় ‘শত্রু’ হয়ে গেছে।
আলো ঝলমলে ঢাকা থেকে অনেক দূরের কোনও এক গ্রামীণ পশ্চাৎপদ পরিবেশ থেকে উঠে আসা ‘একগুঁয়ে' মানুষটির একটি অনিশ্চিত পেশা, কিছু নোংরা প্রেমের সম্পর্ক এবং জনগণের মনোযোগ আকর্ষণের দক্ষতা; সমাজের প্রতিষ্ঠিত মানুষদেরকে বিভ্রান্ত ও হতবুদ্ধি করে তুলেছে।
শুধু তাই নয়, একজন তাকে একটি মাইক্রোবাস উপহার দিল এবং কেউ যা করে না আলম তাই করলো; সেটি দান করে দিলেন। আর এ বিষয়টি এতটাই আলোচিত হয়ে উঠল, যে সংসদেও এসব নিয়ে আলোচনা উঠল।
সুশীলদের ওপর ফের আঘাত
ইউএনবির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলায় যাওয়ার পথে হিরো আলমকে ২৫০০ টাকা জরিমানা করে হাইওয়ে পুলিশ। ওই উপজেলার নরপতি গ্রামের আব্দুল জব্বার গাউছিয়া একাডেমির প্রিন্সিপাল এম মখলিছুর রহমানের কাছ থেকে উপহারের মাইক্রোবাস আনতে গিয়েছিলেন তিনি।
কারণ মখলিছুর সম্প্রতি ফেসবুক লাইভে ওয়াদা করেছিলেন যে বগুড়া দুই আসনে উপনির্বাচনে জিতলে বা হারলে হিরো আলমকে তিনি গাড়ি উপহার দেবেন। তার আবেদনের প্রেক্ষিতে হিরো আলম গাড়িটি গ্রহণ করেন এবং তারপর লাশ বহনের অ্যাম্বুলেন্স হিসেবে ব্যবহার করার জন্য এটি দান করেন।
আরও পড়ুন: যারা হিরোকে জিরো বানাতে চায় তারাই জিরো হয়ে গেছে: হিরো আলম
আলমকে জরিমানা করা পুলিশের এই পদক্ষেপটিতে কি কিছুটা প্রতিহিংসার গন্ধ ছিল! যে দেশে মন্ত্রীরা ঢাকার ব্যস্ত সড়কে জাতীয় পতাকা লাগানো তাদের সরকারি গাড়ি নিয়ে রংসাইড দিয়ে যাওয়া দোষের কিছু মনে করেন না, মোটরসাইকেলগুলো ফুটপাতকে সাব-রোড হিসেবে ব্যবহার করে, ফুটপাতে পার্ক করা গাড়ির জ্বালায় জনগণের হাঁটা দুষ্কর এবং এমনকি ‘ট্রাফিক নিয়ম লঙ্ঘন’- বলে যে কিছু আছে, অনেকে তা জানেই না। সেখানে আলমকে নিয়ে সরকারি বাহিনীর এত উদ্বেগ কিসের?
নিম্নশ্রেণির উত্থান
হিরো আলম ব্যক্তিগতভাবে ও সাংস্কৃতিকভাবে নিম্নশ্রেণির মানুষের উত্থানের প্রতিনিধিত্ব করছেন। শিল্পের মানদণ্ড কি তা নির্ধারণ করে রেখে সুশীলরা এতদিন যে একচেটিয়া সুবিধা ভোগ করছে, প্রথমেই তা হুমকির মুখে পড়েছিল গ্রামীণ ধর্মীয় সংস্কৃতির উত্থানের ফলে।
রাজনীতি ছাড়াও, হেফাজতের ঢাকা অবরোধের মধ্যদিয়ে দেখা যায় যে, জেগে উঠলে মুহূর্তে তারা ব্যক্তিগত ও সামাজিক যে কোনও বাধা অতিক্রম করতে পারে।
‘আধুনিক ও ধর্মনিরপেক্ষ’ সুশীল সংস্কৃতির জন্য ওয়াজ মাহফিল বা হেফাজত ও তাবলিগ সংস্কৃতিকে প্রত্যাখান করা সহজ, কারণ তারা একটি রাজনৈতিক ও বিশেষ গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করে।
কিন্তু এখানেই হিরো আলম তাদের কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলছে।
সারা বাংলাদেশের শহুরে অভিজাত বা সুশীলদের চর্চিত সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড আর হিরো আলমের কর্মকাণ্ড তো একই।
হিরো আলম হয়তো ভালোভাবে কাজগুলো করতে পারে না, তবে অভিজাত বা সুশীলরা তাদের কমন স্পেসে যা করে সেও ঠিক তাই করে ।
আলম তাদেরই মতো গান করেন, তাদের মতো বিভিন্ন নায়ক ও আইকনদের নকল করেন এবং এমনকি তাদের অনেকের মতো নারীও সাজেন।
কেউ তাকে অপছন্দ করতেই পারে, যেমনটি অধিকাংশ সুশীলই তা করেন। তবে কেউ তার সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডকে বন্ধ করতে পারে না, কারণ সুশীল অভিজাতরাও ঠিক এ কাজগুলোই করে।
হিরো আলম ও তার সমগোত্রীয়রা ক্রমে উঠে আসছে এবং শিগগিরই সুশীলদের একচেটিয়া দখলদারিত্বের ভিত্তি নড়িয়ে দিতে পারে তারা। মূলত এ ভয়েই তারা এত উদ্বিগ্ন।
কিন্তু ইতিহাস বলে, এ শ্রেণির মানুষেরা আজীবনই অপ্রতিরোধ্য। নিম্নশ্রেণির মানুষেরাই হয়তো একদিন শখের গায়ক ও তথাকথিত সৌন্দর্য্য সর্বস্ব শ্রেণির মানুষের ওপর আধিপত্য বিস্তার করবে।
(প্রকাশিত মতামতের দায় লেখকের, ইউএনবির নয়)
আরও পড়ুন: হিরো আলমকে তাচ্ছিল্য করে প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের বক্তব্য শিষ্ঠাচার বহির্ভূত ও বৈষম্যমূলক: টিআইবি
কোন দেশে বেশি স্মার্টফোন ব্যবহার, বেশি মানসিক রোগ?
যদি ভেবে থাকেন আমেরিকা, আপনি ফেল। এটা হলো চীন। কানাডার ম্যাকগিল ইউনিভার্সিটি এক গবেষণা চালিয়ে বলেছেন। ২০১৪ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে ২৪টি দেশের ৩৪ হাজার ব্যবহারকারীর তথ্য ও তালিকা নির্ণয় করে তারা জানিয়েছে। আচ্ছা চীন না হয় বোঝা গেলো, তারপর কে? সৌদি আরব, আছে মালয়েশিয়া। কিন্তু ১০ নম্বরে কে? ভাবুন একবার, নেপাল। তারা ভারত থেকে এগিয়ে? জি-তাই, ভারত ১৭ নম্বরে। সবই এশিয়ান দেশ। বরং ইউরোপ কমের দিকে। জার্মানি ও ফ্রান্স ২৩ ও ২৪ তম স্থানে।এই ধরনের বড় আকারের গবেষণা কমই হয়েছে যেখানে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের তথ্য নেয়া হয় পরিমাপের জন্য। কিন্তু স্মার্টফোন ব্যবহার থেকে অনেক ধরনের মানসিক বৈকল্য ও শান্তি জন্মায়। তার হিসেবেও করে এই গবেষণা। তারা ‘স্মার্টফোন এডিকশন স্কেল’(এসএএস) ব্যবহার করে এই ক্ষেত্রে। ইউরোপ, আমেরিকার অবস্থা কি রকম?এই জরিপ মতে কানাডা দখল করে আছে সপ্তম স্থান আর মার্কিনিরা অনেক নিচে-১৮ মানে ভারতেরও নিচে। ফ্রান্স ২৩ আর জার্মানি ২৪। তুরস্ক , ইরান, মালয়েশিয়া সবাই এই তালিকায় আছে যেমন আছে নাইজেরিয়া। ইসরাইল আছে ১৩ নম্বর দখল করে। কেন এক দেশে বেশি, অন্য দেশে কম সেটা বোঝার চেষ্টা চলছে তবে গবেষকরা বলছেন, হয়তো এশিয়ার সাবেকি সমাজে পারিবারিক ও সামষ্টিক যোগাযোগ রাখার একটা তাগিদ আছে যা স্মার্টফোন পূরণ করে। তবে এটা একেবারেই অনুমান।স্মার্টফোন নেশা কত ব্যাপক?আইপাস নামক যোগাযোগ সংস্থা আমেরিকা ও ইউরোপের ১৭০০ লোকের ওপর এক জরিপ চালায়। তাদের কয়েকটি তথ্য বেশ চমকানোর মতো: কি সব অদ্ভুত ও উদ্ভট পরিস্থিতিতে মানুষ স্মার্টফোন ব্যবহার করার তাগিদ অনুভব করেন বা করেছেন তার কয়েকটি উদাহরণ: * ৭ শতাংশ যৌন কর্মকালে * মল ত্যাগ করতে গিয়ে ৭২ শতাংশ* অন্তোষ্টক্রিয়ায় ১১ শতাংশ* ৬১ শতাংশ জানায় ওয়াইফাই ছাড়া থাকা তাদের পক্ষে সম্ভব নয় * এর চাহিদা যৌন কর্মের চেয়ে বেশি (৫৮ শতাংশ)* জাঙ্ক ফুডের চেয়ে বেশি (৪২ শতাংশ)* ধূমপানের চেয়ে (৪১ শতাংশ)* মদের চেয়ে (৩৩ শতাংশ) * মাদকের চেয়ে ৩১ (শতাংশ)* গোসল করার চেয়ে বেশি (২৫ শতাংশ) আর ১৯ শতাংশ বলেছে তারা মানব সঙ্গ ত্যাগ করতে পারবে কিন্তু ওয়াইফাই নয়।২৪টি জরিপ করা দেশের তালিকা। পাশে ১-৬০ হিসেবে স্মার্টফোন জনিত মানসিক সমস্যার সূচক ২৪ দেশের তালিকা১ . চীন (৩৬ .১৮)২ . সৌদি আরবে (৩৫.৭৩)৩ . মালয়েশিয়া (৩৫.৪৩)৪ . ব্রাজিল (৩২ )৫ . দক্ষিণ কোরিয়া (৩১.৬২)৬ . ইরান (৩১.৫২)৭ . কানাডা (৩১ .১১ )৮ . টার্কি (৩০.৯২)৯ . মিশর (২৯.৫৪)১০. নেপাল (২৯.৪১)১১ . ইতালি (২৮ .৮২)১২ . অস্ট্রেলিয়া (২৮.৬১ )১৩ . ইসরাইল (২৮.২৯ )১৪ . সার্বিয়া (২৮ .১৬ )১৫ . জাপান (২৭.৭১)১৬ . যুক্তরাজ্য (২৭.৬৯)১৭ . ভারত (২৭.২)১৮ . যুক্তরাষ্ট্র (২৬ .৬৮ )১৯ . রোমানিয়া (২৫.৫২ )২০ . নাইজেরিয়া (২৪.৭৩ )২১ . বেলজিয়াম (২৪.২৪)২২ . সুইজারল্যান্ড (২৩.৪৫)২৩ . ফ্রান্স (২০.২৯)২৪ . জার্মানি (১৮.৪৪)
(প্রকাশিত মতামতের দায় লেখকের, ইউএনবির নয়)
পড়ুন: যোগ্য পাকিস্তানের কাছে চূর্ণ হলো বাংলাদেশি নারীদের অতি আত্মবিশ্বাস!
মিডিয়া: মরিয়ম মান্নান, শাকিব খান, বুবলী...
হিরো আলম: আসল ঝামেলাটা কি গান না শ্রেণি?
যোগ্য পাকিস্তানের কাছে চূর্ণ হলো বাংলাদেশি নারীদের অতি আত্মবিশ্বাস!
নারী এশিয়া কাপে পাকিস্তানের কাছে ৯ উইকেটে পরাজিত হওয়ার পর বাংলাদেশ নারী ক্রিকেটকে ঘিরে যে ধরনের উচ্ছ্বসিত প্রচারণা ছিল তা অনেকটাই ম্লান হয়েছে। পাকিস্তান খেলেছে জায়গা মতো আর বাংলাদেশ পড়েছে বেকায়দায়।
বাংলাদেশ আয়ারল্যান্ড ও থাইল্যান্ডকে পরাজিত করে এই কাপে এবং তাদের বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের কাপ জয়ের পর পাকিস্তানের বিপক্ষে জয়ের প্রত্যাশা করেছিল সবার। কিন্তু পুরাই ব্যর্থ হয়েছে। সত্যিকার অর্থে পাকিস্তান একটি শক্তিশালী দল। কিন্তু কাপের ডিফেন্ডার হিসেবে বাংলাদেশে কাছ থেকে অনেক ভালো করার প্রত্যাশা ছিল। তা হয়নি।
যেমন ক্রিকেট সাইট ক্রিকবাজ তাদের লাইভ ধারাভাষ্যে অকপটে বলেছে, ‘বাংলাদেশের ব্যাটিং ও বোলিংয়ের অবস্থা ভয়ঙ্কর বাজে ছিল’। অর্জনের পর বাজে খেলা, স্পষ্টতই একটি ব্যাধি- যা আমরা ভালো ভাবেই জানি যখন বাংলাদেশের ক্রিকেটের কথা আসে।
আরও পড়ুন: হিরো আলম: আসল ঝামেলাটা কি গান না শ্রেণি?
জঘন্য ব্যাটিং
টস হেরে ব্যাট করতে নেমে বাংলাদেশ ৮ উইকেট হারিয়ে ৭০ রান করে। সালমা খাতুন সর্বোচ্চ ২৪ রান করেন এবং মাত্র অন্য দুইজন খেলোয়াড় দুই অঙ্কে পৌঁছেতে পারেন। আমাদের ‘ভয়ঙ্কর’ ব্যাটিং সম্পর্কে ভালো জানান দেয়। যারা ম্যাচটি দেখেছেন তারা প্রায় সবাই বলেছেন একটি কথা। খেলাটা জেতার ইচ্ছাটা অভাব ছিল যেন। হয় তারা ম্যাচটিকে হালকাভাবে নিয়েছে বা কীভাবে এটিকে সিরিয়াসলি নিতে হবে তা জানে না।
বাংলাদেশ দলের অধিনায়ক নিগার সুলতানা যথারীতি অজুহাত দিলেও সেগুলো অন্তঃসারশূন্য শোনায়। ‘টপ অর্ডার ভেঙে পড়েছে এবং উইকেট স্লো হওয়ায় আমরা আমাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে পারিনি। আমরা ভেবেছিলাম এটা ব্যাটিং করার জন্য ভালো পিচ। কিন্তু পিচটি ছিল স্যাঁতসেঁতে। বোলাররা সঠিক জায়গায় বল করতে পারেনি। আমি মনে করি আমাদের কিছু বিষয়ে কাজ করতে হবে এবং আরও শক্তিশালী হয়ে ফিরে আসতে হবে।’
অবশ্যই পিচটি স্যাঁতসেঁতে ছিল, এটি ক্রিকেট জীবনের অংশ। কিন্তু কীভাবে একজন আঠালো পিচে ব্যাট করেন তা বেড়ে ওঠার প্রক্রিয়ার অংশ। দুর্ভাগ্যবশত, এই ম্যাচে বাংলাদেশ সেই প্রবণতা বা অভিপ্রায় দেখিয়েছে বলে মনে হয় না।
আরও পড়ুন: ভারতে এতো ঝামেলা হচ্ছে কেন?
পাকিস্তান ছিল বিধ্বংসী
পাকিস্তান একই পিচে খেলেছে এবং তাদের স্পিনাররা খুব বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে বাংলাদেশের ব্যাটার দের মাথা নত করিয়ে দেয়। তারা বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের এমনভাবে নিয়ন্ত্রণ করেছিল যে আমাদের মেয়েদের অযোগ্য দেখায়। পাকিস্তান যখন ব্যাট করতে শুরু করে তখন উইকেটের কিছুটা উন্নতি হয়েছিল কিন্তু দলটি স্পষ্টতই আরও আত্মবিশ্বাসী এবং জয়ের অভিপ্রায় নিয়ে খেলে এবং মাত্র ১২ ওভারে তা করেছিল। পুরো ম্যাচে বাংলাদেশ কখনোই চ্যাম্পিয়নদের মতো দেখতে মনে হয়নি।
পাকিস্তান দলের পারফরম্যান্স নিয়ে এমনটাই বলেছেন পাকিস্তান অধিনায়ক বিসমাহ মারুফ। ‘বোলারদের কাছ থেকে খুবই ক্লিনিক্যাল সাফল্য পেয়েছি। প্রথম দিকের উইকেট হারাবার পর তাদের চাপে ফেলে দেয় আমাদের বোলাররা I আমরা আমাদের স্পিন নিয়ে কাজ করছি। আমরা আমাদের পরিকল্পনা ভালোভাবে বাস্তবায়ন করেছি। তারা একটি ভাল টিম। আমাদের বিরোধী দলকে সম্মান দিতে হবে। তবে আমাদের আজকের পারফরম্যান্স ভালো ছিল।’ এটি এমন একটি দলের কাছ থেকে একটি অত্যন্ত নম্র প্রতিক্রিয়া ছিল যারা মূলত ‘চূর্ণ’- বিডি মিডিয়ার পরাজয় বর্ণনা করার জন্য প্রিয় শব্দ - করেছে ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়নদের এবং টেবিলের শীর্ষে চলে গেছে।
বিসিবি প্রধান পাপন তাদের জিততে দেখে এবং তাদের পারফরম্যান্সের প্রশংসা করার পর দলটি কুফা লেগেছে বলে যে গুজব চলছে, সেটা গুজব , সত্য নয় তা আমরা তা নিশ্চিত করতে পারি।
(প্রকাশিত মতামতের দায় লেখকের, ইউএনবির নয়)
আরও পড়ুন: বাংলাদেশে বিরোধী দলের বন্ধ্যাত্ব
মিডিয়া: মরিয়ম মান্নান, শাকিব খান, বুবলী...
অনেকেই ক্লিক বাজ খবর পড়ে না যেমন আমি ও আরো কয়েকজন। তবে আমরা বয়স্ক মানুষ তাই চটুল খবরের অজুহাতে এদের এড়িয়ে যাই। কিন্তু প্রায় সবাই পড়ে এবং এটাই স্বাভাবিক কারণ মিডিয়ায় যা আসে তার ভোক্তা আছে বলেই আসে। যে মিডিয়া আউটলেট এদের অস্বীকার করে যাবে, তাকে মূলধারা মিডিয়ায় কি বলা যাবে? তবে এটা ঠিক কিছু মিডিয়ায় থাকবে যাদের পদচারণা বাজারের বাইরে হবে। এদের অর্থায়ন সমস্যা নাই তাই সেটা করতে পারে কিন্তু তারা কি সবল ও প্রভাবশালী? বাকিদের জন্য ওই কয়েকটা নাম কি বাস্তবতার প্রকৃত চেহারার প্রতিচ্ছবি?
২
রাহিমা খাতুন ও মরিয়মের সংবাদটা অন্তর্ধান, অপহরণ, লুকিয়ে যাওয়া কেন্দ্রিক। সেই অর্থে কেলেঙ্কারি বিষয়ক নয়। তবে এক দিক থেকে বিষয়টা তাই। তাদের বিরুদ্ধে চার্জ হচ্ছে তারা মিথ্যাচার করেছে, সাজানো নাটক করে সবাইকে বোকা বানাতে চেয়েছে। এর ফলে কিছু নিরপরাধ মানুষ জেলে গেছে। কিন্তু কে করেছে, কিভাবে করেছে এবং কেন করেছে এখনো পরিষ্কারভাবে জানা যায়নি। পুলিশ বলেছে রহিমাকে অপহরণ করা হয়নি। মরিয়ম বলছে সে নিশ্চিত না। তাকে মেয়ে নিয়ে গেছে মানসিক হাসপাতালে। দেখা যাক শেষ পর্যন্ত কি হয়। কিন্তু মিডিয়া জগতে তারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে নেতিবাচক চরিত্রে, হয়তো আরো বেশি কিছু।
৩
শাকিব খান, বুবলী, অপু বিশ্বাস, পূজা চেরি, সবাই সিনেমা জগতের নাম এবং ব্যক্তিগত সম্পর্কের মাধ্যমে একে অন্যের সাথে জড়িত। শাকিবের প্রথম গোপন সম্পর্কে-অপু বিশ্বাস থেকে এক সন্তানের জন্ম, দ্বিতীয় গোপন সম্পর্ক-বুবলী-থেকে আর এক সন্তান আর মিডিয়ার অভ্যাস তার থার্ড গোপন সম্পর্ক চলছে পূজা চেরির সাথে, সন্তানও নাকি হতে পারে আবার। বিষয়টা বিষয় নয় কারণ তাবৎ দুনিয়ার এন্টারটেইনমেন্ট জগতে এসব হয়, খবর হয় , পাঠক দর্শক, দেখে পড়ে। কিন্তু এদেরকে বিষয় হিসেবে অস্বীকার করা স্রেফ অদ্ভুত অন্ধ হওয়ার সাধ জাগার মতো মিডিয়ার জন্য। কে কিভাবে এই সব কভার করছে সেটাই বিষয়, কভার করছে কি করছে না, সেটা নয়।
পড়ুন: শেহজাদ খান বীর আমার এবং বুবলীর সন্তান: শাকিব খান
হিরো আলম: আসল ঝামেলাটা কি গান না শ্রেণি?
সোশ্যাল মিডিয়া না থাকলে হইতো হিরো আলমকে নিয়ে এতো সব যে ঘটছে তার কিছুই ঘটতো না। হইতো কেউ জানতোও না তার কথা। বড় জোর মফস্বল পর্যায়ের হাস্য-রস উদ্রেককারী একজন মানুষ হিসেবেই থাকতেন তিনি। কিন্তু পাল্টে গেছে দুনিয়া, বিশেষ করে সোশ্যাল মিডিয়ার কারণে। এতেই হিরো আলম জাতীয় পর্যায়ের একজন ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছেন।
২
কেউ তাকে নিয়ে হাসে। কিন্তু অনেকেই আবার তাকে পছন্দ করে, বিশেষ করে তার ফলোয়াররা। তারা আমার-আপনার মতো সুশীল ভদ্রলোক না, তাদের বলা যায় নিম্ন পদস্থ মানুষ। তাদের কোনোদিনই আমাদের সাথে দেখা হওয়ার কথা নয়। কিন্তু গণযোগাযোগ মাধ্যম এমনি বাস্তবতা, (আমরা না চাইলেও) আমাদের ঘরে অনেক মেহমান এনে দেয়।
আরও পড়ুন: ভারতে এতো ঝামেলা হচ্ছে কেন?
যেমন- হিরো আলম। আমি অনেক কিছুই সহ্য করি এসবের মধ্যে এটাও একটা। কিন্তু ডিবি পুলিশের কাছে অভিযোগ দেই না। তবে কয়েকজন দিয়েছেন। তাই রবীন্দ্র-নজরুলের গান গাইবেন না- এই মর্মে তার (আলম) কাছ থেকে মুচলেকা নিয়েছে পুলিশ।
৩
সবই ঠিক ছিল। তবে এখানেও এসে দাঁড়ায় সোশ্যাল মিডিয়া। একজন গায়ককে পুলিশ দিয়ে শাসানো অনেক ফেসবুক ব্যবহারকারীর পছন্দ হয়নি। বিশেষ করে পুলিশ দিয়ে গান বন্ধ করা। আর এতেই শুরু হলো গালি বর্ষণ, ব্যঙ্গ, বিদ্রুপ, তিরস্কার। যারা তাকে মুচলেকা দিয়ে অপমানিত করে মুখ বন্ধ করতে চেয়েছিল তাদের চেষ্টার ফল হলো উল্টো। হিরো আলম বর্তমানে বাংলাদেশের প্রায় সকল রাজনীতিবিদ ও সংস্কৃতি-কর্মীর চেয়ে পরিচিত ও জনপ্রিয়। এখন তিনি প্রতিবাদের প্রতীক। তার রবীন্দ্র-নজরুল দরকার নেই। আজ হিরো আলম একাই যথেষ্ট।
৪
যারা তাকে ঝামেলায় ফেললো শোনা যাচ্ছে তারা শিল্প সংগীতের মানুষ। আবার তাদের মধ্যে টেলিফোনে এক নারীকে হেনস্তার অভিযোগে পদ হারানো সাবেক প্রতিমন্ত্রী মুরাদও রয়েছেন। তার একাধিক ভিডিও আছে যেখানে তিনি বলেন, ‘কী করে সাহস হয় এই লোকের আমার সামনে গান গাইবার? যখন তার কোনো সংগীত জ্ঞান নাই। আল্লাহ যে একখান গলা ও চেহারা দিয়েছে তাকে। তার গান নিচু শ্রেণির মানুষেরা শোনে। সে তাদের জন্য গাক। কিন্তু গুলশানে এসে গাইবে কেন?’
আরও পড়ুন: স্বাধীনতার ইতিহাসে তাদের স্থান কি হবে?
৫
অতএব শ্রেণির বিষয়টা পরিষ্কার। ওপর তলা চায় না নিচের শ্রেণির মানুষ একই পরিসরে সংস্কৃতি চর্চা করুক। কিন্তু কপাল এমনি যে সোশ্যাল মিডিয়ার কারণে নিম্নদের কালচার তাদের ঘরের ভেতর ঢুকে পড়ছে। এটা সহ্য না হবারই কথা!
আরেকটা বিষয় হলো সোশ্যাল মিডিয়াতে কিন্তু প্রায় সকলেই হিরো আলমের পক্ষে লিখেছেন, কিছু মানুষ ছাড়া। অর্থাৎ ‘রাবীন্দ্রিক’ নাক উঁচু শুদ্ধবাদী সুশীলের চেয়ে বিপক্ষ সুশীলের সংখ্যা অনেক বেশি। এদের পুরনো রক্ষণশীলতা নেই। ‘রবি-রক্ষা’ প্রথম অগ্রাধিকার না। বরং তারা মনে করে যে ভাবে গাক করুক না কেন সবার জায়গা আছে।
আগে গান হতো মজলিশে। কিন্তু সে দিন শেষ। ডিজিটাল দুনিয়ায় সবার জায়গা হয়। অধিকাংশই এটা মেনে নেয়, কয়েকজন ছাড়া।
(প্রকাশিত মতামতের দায় লেখকের, ইউএনবির নয়)
ভারতে এতো ঝামেলা হচ্ছে কেন?
দক্ষিণ এশিয়ায় অন্যদের তুলনায় ভারতের অবস্থা অনেক ভালোI তারা নিজেরাও এটা ভাবে ও বলেI এতো বড় দেশে, এতো সম্পদ, ভূমি, মানুষ ... ইন্ডিয়া নিজেকে একটা উঠতি পরাশক্তি ভাবে। কিন্তু ইদানীংকালের কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে যা চিন্তিত হওয়ার মতো। ভারতের রাজনৈতিক নেতারা কি পাবলিকের বাস্তবতা ও মন ধরতে পারছেন না?
তিনটি উদাহরণ
ভারতের কৃষি নীতি দারুণ সমালোচিত হয় বিশেষ করে তাদের খাদ্য উৎপাদনকারী পাঞ্জাবে। এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হয়ে ওঠে সেখানে প্রধান রাজনৈতিক বিষয়I শেষ পর্যন্ত মোদিকে পিছিয়ে আসতে হয়, নীতি পাল্টাতে হয়I এবং রাজনৈতিক দামও দিতে হয়েছে। এর জন্য যে ঝামেলা বিরোধী দলগুলা ফেলে তাতে মনে হয়েছে, এই কৃষি নীতি খুব একটা পরিপক্ক ভাবনার ফসল ছিল না।
দ্বিতীয়টা হচ্ছে, হযরত মোহম্মদকে নিয়ে শর্মা-জিন্দালের বক্তব্য। এটাতেও বিপাকে পড়ে ভারত, দেশের ভেতর ও বাইরেI যদিও বিজেপি জানে জনগণ এই বক্তব্যের পক্ষে এবং এতে তাদের রাজনৈতিক লাভ হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবতা ছিল কিছুটা আলাদাI এর বিরুদ্ধে সহিংস প্রতিবাদ হয়েছে এবং অনেক স্থানে তা ছড়িয়েছে। এতে অবশ্য বিজেপি'র লাভ। কারণ মুসলমান বিরোধী মনোভাব এই দলের অন্যতম সমর্থনের শক্তি। তারা এই দলকে ভোট দেয় না। কিন্তু দীর্ঘস্থায়ী কোনো দ্বন্দ্ব-সহিংসতা অর্থনীতির ওপর চাপ ফেলতে বাধ্য, যেটা তাদের হিসেবে ছিল না।
সেটা ছাড়া রয়েছে আন্তর্জাতিক ‘ইসলামী উম্মা’ বিশেষ করে আরব দেশসমূহ যার সঙ্গে ভারত সম্পর্ক রাখতে চায়। যেখানে ভারতীয় মালামাল ও ভারতীয়দের চাকরির বড় বাজার, সেখানে এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হয়েছে যা ভারতকে বিব্রত করেছেI এবং সেই কারণে এই দুই নেতাকে দল থেকে সাসপেন্ড করা হয়I কিন্তু তাদের সমর্থন ও প্রভাব বেড়েছে।
তবে ধর্ম কেন্দ্রিক রাজনীতিকে হাতিয়ার হিসেবে প্রয়োগ করা যায় রাজনৈতিকভাবে। কিন্তু তার অসুবিধাও আছেI মুসলমানদের প্রান্তিক করলেই শুধু চলবে না, সে তুলনায় অন্যদের লাভ হতে হবেI সকল রাজনীতির প্রধান সূত্র অর্থনীতি এবং সেখানেই ভারত খেলেও তৃতীয় ধাক্কা।
অগ্নি-পরীক্ষা
এই তৃতীয় ধাক্কাটি সবচেয়ে বড় যদিও দেশের বাইরে এটা নিয়ে কম আলোচনা হচ্ছে। এটি ভারতের অগ্নিবীর প্রকল্প যার মাধ্যমে প্রশিক্ষণের পর সামরিক বাহিনীতে সাময়িকভাবে কন্ট্রাক্ট কর্মী নিয়োগ হওয়ার কথা। মেয়াদ শেষ হলে তাদের এক অংশ আর্মির পূর্ণ সদস্য হবেI এটি নিয়ে মোদির অনেক আশা গর্ব ছিল। কারণ সেনাবাহিনীর বৃদ্ধিকরণ দরকার এবং এরা কিছুদিনের জন্য কম খরচে অনেকে কাজে লাগবে তারI এছাড়া একটি প্রশিক্ষিত জনবল তৈরি হবে যারা সাচ্চা ভারতীয় দেশ প্রেমিক।
বিরাট উৎসাহের সঙ্গে এর ঘোষণা করা হয়। কিন্তু প্রায় সঙ্গে সঙ্গে তীব্র সহিংস প্রতিবাদে ফেটে পড়ে সেই সব এলাকা যেটা বিজেপি'র একাট্টা সমর্থক এলাকা হিসেবে পরিচিতI উত্তর প্রদেশ, বিহার, হরিয়ানা ও অন্য কয়েকটি জায়গার ওপর ভিত্তি করে বিজেপি দাঁড়িয়ে। এটি তারা আশা করেনি। কারণ উদ্দেশ্য ছিল এদের সহায়তা করা, সমর্থন আরও সবল করাI ফলে ধাক্কা লেগেছে।
প্রতিবাদ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে প্রকল্পে যাতে পরিস্থিতি ঠান্ডা হয়।
এছাড়া, দলের প্রধান নেতারা মাঠে নেমেছেন তরুণদের বোঝাতে। কারণ সরকার নিশ্চিত যারা হাঙ্গামা করছে তারা তাদের ভোটার।
পাবলিকের চাহিদা
যেটা মনে হচ্ছে সেটা হলো বিজেপি ভাবছে দেশের মানুষ রাজনীতিকে প্রধান স্থান দেয়, অর্থনীতিকে নয়। এই ধারণা খুবই সনাতনী, কলোনিয়াল যুগের চেয়ে পুরাতন। এটা দিয়ে বর্তমানে চলবে না যদিও এতদিন নির্বাচনে তাদের লাভ হয়েছেI নেতারা কি জনমতের আসল চাহিদা ধরতে পারছেন না? তারা কি ভাবছেন, ভারতের মানুষ স্লোগান শুনে ভোট দেবে আজীবন। কিন্তু মানুষ তো চায় রুজি, চায় বেতন ইত্যাদি। এটা ঠিক ভারতের মুসলমানদের প্রান্তিক করলে অন্যরা বেশি সুবিধা পাবে। কিন্তু যদি লাভ না হয় তাহলে প্রান্তিক করে কি লাভ? কৃষি নীতি, ধর্ম নীতি ও সামরিক নীতি তিনটায় প্রমাণ করলো বিজেপি পাবলিককে নিজেদের মতো ইডিওলজিকাল ভাবলেও পাবলিকের প্রধান ইডিওলজি পেট। ওটা ঠান্ডা করতে হবে।
রাজনীতির প্রধান কথাই অর্থনীতি
আরও পড়ুন: স্বাধীনতার ইতিহাসে তাদের স্থান কি হবে?
বাংলাদেশে বিরোধী দলের বন্ধ্যাত্ব
আন্দ্রে রাসেল একাই খেলা দেখাল কিন্তু পারল না কলকাতা