মহেশখালী-মাতারবাড়ি সমন্বিত উন্নয়ন প্রকল্প (মিডা) সফলভাবে বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ বাণিজ্যিক কেন্দ্রে রূপান্তরের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
বুধবার (৩ সেপ্টেম্বর) প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে প্রকাশিত মিডা স্ট্র্যাটেজিক ভিশনের তথ্য অনুযায়ী, এই প্রকল্পটির মাধ্যমে লজিস্টিকস, শক্তি ও বিদ্যুৎ, উৎপাদন এবং মৎস্য শিল্পকে এক স্থানেই একীভূত করা হবে।
এই প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য হলো গভীর সমুদ্রবন্দর সুবিধা, এনার্জি টার্মিনাল, বিদ্যুৎ কেন্দ্র ও অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোকে সংযুক্ত করা, যাতে শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো জ্বালানী উৎস ও লজিস্টিকসের কাছাকাছি অবস্থানে থেকে নিজেদের কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারে।
বেশ কিছু সুবিধার কারণে মাতারবাড়ি-মহেশখালী এলাকাকে এই বহুমুখী প্রকল্পের জন্য নির্বাচিত করা হয়েছে। সুবিধাগুলো হলো— সমুদ্রবন্দরের জন্য প্রয়োজনীয় গভীরতা, জ্বালানি, বিদ্যুৎ, উৎপাদন ও ভারী শিল্প, মেরিন ও মৎস্য খাতের জন্য উপযুক্ত স্থলভাগ।
এই অর্থনৈতিক কেন্দ্রটির লক্ষ্য আন্তর্জাতিক শিপিং লাইনের সরাসরি প্রবেশের সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ব্যবসা ও বিনিয়োগ বৃদ্ধি এবং প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ সৃষ্টি করা।
জাইকার একটি গবেষণা অনুযায়ী, আগামী ২০-৩০ বছরের মধ্যে এই প্রকল্পে ৬ হাজার থেকে সাড়ে ৬ হাজার কোটি মার্কিন ডলারের বিনিয়োগ আসবে, যার মধ্যে প্রায় ৪ হাজার ৭০০ থেকে ৪ হাজার ৮০০ কোটি ডলার বেসরকারি বিনিয়োগ এবং ৪ হাজার ৮০০ কোটি ডলার সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই)।
সম্পূর্ণ প্রকল্পের মাধ্যমে দেশের মোট জিডিপিতে প্রায় ১৫ হাজার কোটি ডলারের প্রভাব পড়বে, যার মধ্যে সরাসরি জিডিপি প্রভাব হবে প্রায় ৭ হাজার থেকে সাড়ে ৭ হাজার কোটি ডলার।
প্রকল্পটি দীর্ঘমেয়াদে দেড় লাখ সরাসরি ও প্রায় ২৫ লাখ পরোক্ষ কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে।
এই অঞ্চল কক্সবাজারের অর্থনীতির জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। পর্যটকদের সংখ্যা বর্তমানে থেকে দেড় গুণ বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে।
এই উদ্যোগের চারটি প্রধান স্তম্ভ রয়েছে: বন্দর ও লজিস্টিকস, উৎপাদন, বিদ্যুৎ ও শক্তি, এবং মৎস্য খাত।
মিডা স্ট্র্যাটেজিক ভিশনের আলোকে ভৌগোলিক সুবিধাকে সঠিকভাবে কাজে লাগানোর জন্য এই স্তম্ভগুলো নিয়ে সংশোধন ও পরামর্শ চলছে।
চারটি স্তম্ভকে ধরে রাখার জন্য শারীরিক ও সামাজিক অবকাঠামোর পাশাপাশি মাতারবাড়িতে একটি পর্যটন অঞ্চলও সমর্থন করা হবে।
প্রতিটি স্তম্ভেরই সংক্ষিপ্ত ও দীর্ঘমেয়াদী কৌশল রয়েছে, পাশাপাশি অর্থনৈতিক প্রভাব, যা নিচে সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো।
এই উদ্যোগের প্রথম স্তম্ভ হলো গভীর সমুদ্রবন্দর এবং এর সংযুক্ত লজিস্টিক্স সিস্টেম। প্রকল্পটির এই অংশটি এমনভাবে ডিজাইন করা হয়েছে যেই সুবিধা বাংলাদেশের বাকি বন্দরগুলোতে নেই— বাল্ক কার্গো ও কনটেইনার উভয়ই পরিচালনা করবে।
পড়ুন: সমুদ্রই হবে বিশ্বের পথে আমাদের মহাসড়ক: প্রধান উপদেষ্টা
বন্দর ও লজিস্টিকস স্তম্ভের আওতায় মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর গড়ে তোলা হবে, যা বাংলাদেশে অন্যান্য বন্দরগুলোর চেয়ে বৃহত্তর এবং আধুনিক ধাঁচের। এই বন্দর প্রায় ১৮.৫ মিটার গভীর, যার ফলে বড় বড় জাহাজ সরাসরি বন্দরে নোঙর করতে সক্ষম হবে। এটি চট্টগ্রাম বন্দরের তুলনায় বড় ধরণের সুবিধা।
চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজ থেকে পণ্য খালাসে ছোট জাহাজের প্রয়োজন হয় এবং পণ্য বহন করতে কয়েকটি ধাপ পার করতে হয়।
কয়েকধাপের জটিলতা কমায় অর্থ সাশ্রয় হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এই সাশ্রয় অন্যান্য আবশ্যকীয় পণ্যের খরচেও প্রভাব ফেলবে। উদাহরণস্বরূপ, শিপিং খরচ কমার ফলে ১২ কেজি এলপিজি সিলিন্ডারের দাম প্রায় ৫০ টাকা কমিয়ে আনা সম্ভব হবে।
সমুদ্রের প্রাকৃতিক গভীরতার সুবিধা নিয়ে মাতারবাড়ি বাংলাদেশের মোট বাল্ক কার্গোর ২৫ শতাংশ এবং কন্টেইনার কার্গোর ৪৫ শতাংশ বহন করবে বলে আশা করা হচ্ছে।
সামগ্রিক বন্দর সক্ষমতা আগামী ৩০ বছরে প্রায় ৫০ শতাংশ বাড়বে।
এছাড়া, বৃহৎ আকারের পণ্যগুলোর জন্য আরও খুচরা কার্গো স্টেশন, চার লেন সড়ক, চকরিয়ায় ইন্টারমডাল কনটেইনার ইয়ার্ড থেকে ঢাকা পর্যন্ত ডাবল-লাইন রেল সংযোগের পরিকল্পনাও করা হয়েছে।
মাতারবাড়ির গভীর সমুদ্র বন্দর থেকে বাল্ক ও কন্টেইনারাইজড পণ্যের ক্ষেত্রে খরচ প্রতিযোগিতামূলক হওয়ায় বড় পরিসরের জাহাজ নির্মাণ, পুনর্ব্যবহার এবং ইস্পাত উৎপাদনের সুযোগগুলোও বিবেচনায় আনা হচ্ছে। উৎপাদন কেন্দ্রের এ ধরনের সমন্বয় স্বাভাবিকভাবে সৃষ্টি হবে।
মাতারবাড়ি বন্দরের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ শিল্পজাত পণ্য বাণিজ্য করা হবে, যা প্রস্তুতকারকের জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামাল হিসেবে কাজ করবে।
তিন ধাপের যাচাই-বাছাই শেষে ইস্পাত, কৃষি ও খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ, অটোমোবাইল, ইলেকট্রনিক্সসহ নয়টি উপযুক্ত শিল্প নির্ধারণ করা হয়েছে। এছাড়া রপ্তানি বৈচিত্র্যের জন্য ফার্মাসিউটিক্যালস ও এপিআই, সিন্থেটিক ফাইবার এবং জাহাজ নির্মাণকেও নির্দিষ্ট করা হয়েছে।
দীর্ঘমেয়াদে প্রায় ৬০০ কোটি ডলারের সমপরিমাণ পেমেন্ট ব্যালেন্স সাশ্রয় অর্জন সম্ভব।
গভীর সমুদ্র লজিস্টিক্স এবং নিজস্ব ব্যবহারের জন্য বিদ্যুৎ উৎপাদনসহ একটি প্যাকেজ ডিলের মাধ্যমে সঠিক বিনিয়োগ আকর্ষণ করে। এই কেন্দ্র আগামী ৩০ বছরে বাংলাদেশের মোট উৎপাদনের প্রায় ১০ শতাংশের সরাসরি অবদান রাখবে বলে আশা করা হচ্ছে।
তৃতীয় স্তম্ভ তৈরির ক্ষেত্রে বিদ্যুৎ চাহিদার গড় বার্ষিক বৃদ্ধির হার প্রায় ৬.৭ শতাংশ বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে।
আমদানি নির্ভরশীলতা ও বিশ্ববাজারের মূল্য ওঠানামার প্রভাবিত হওয়া বাংলাদেশ দীর্ঘমেয়াদে চাহিদার ৯০ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে চায়।
এই লক্ষ্য অনুসারে একটি বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে, যেখানে প্রচলিত এবং নতুন শক্তির উৎসের সমন্বয়ে দ্রুত গড়ে তোলা হবে।