ভূমিহীন ও গৃহহীন মানুষের আবাসন নিশ্চিত করতে আশ্রয়ণ প্রকল্প-২ এর আওতায় কুমিল্লার চান্দিনায় নিমার্ণ করা অনেক ঘরের বরাদ্দ নিয়ে কেউ থাকছেন না। অভিযোগ আছে, বরাদ্দের সময় বিভিন্ন মহলের তদবিরে কিছু সংখ্যক মানুষ ঘর বাগিয়ে নিয়েছেন। ফলে বঞ্চিত হয়েছেন প্রকৃত ভূমিহীনরা।
আশ্রয়ণ প্রকল্পের পরিত্যক্ত ওইসব ঘরে এখন মানুষের পরিবর্তে কোথাও লাকড়ির স্তুপ আবার কোথাও রয়েছে হাঁস-মুরগী! কেউ আবার ঘরের বৈদ্যুতিক তারসহ গুরুত্বপূর্ণ সরঞ্জাম নিয়ে হয়েছন উধাও। বরাদ্দকৃত ঘরের এক তৃতীয়াংশই এখন ফাঁকা পড়ে আছে। এমতাবস্থায় তাদের বরাদ্দ বাতিল করে প্রকৃত গৃহহীনদের নামে বরাদ্দ দিতে সরকারের কাছে দাবি জানাচ্ছেন স্থানীয়রা।
আরও পড়ুন: ড্যাপ ও ইমারত নির্মাণ বিধিমালায় সংশোধন চান আবাসন খাতের ব্যবসায়ীরা
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পতিত আওয়ামী লীগ সরকার ২০১৮ সালে টানা তৃতীয়বার ক্ষমতায় আসার পর আশ্রয়ণ প্রকল্প-২ হাতে নেয়। ওই কর্মসূচির আওতায় সরকারি খাস জমিতে নির্মাণ করা হয় দৃষ্টিনন্দন পাকা ঘর। এসব ঘরে সংযুক্ত শৌচাগাড় সুবিধা এবং বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করা হয়। জমির বন্দোবস্তসহ আশ্রয় দেওয়া হয় গৃহহীনদের।
ওই কর্মসূচির আওতায় কুমিল্লার চান্দিনায় পাঁচ ধাপে উপজেলার মাইজখার ইউনিয়নের ভোমরকান্দি, কেরণখাল ইউনিয়নের ছয়ঘড়িয়া, বাড়েরা ইউনিয়নের বাড়েরা, মহিচাইল ইউনিয়নের অম্বরপুর গ্রামসহ বিভিন্ন স্থানে ২১৬টি গৃহ নির্মাণের মধ্য দিয়ে প্রতিটি ঘরে গৃহহীনদের আবাসন নিশ্চিত করা হয়। কিন্ত পরবর্তীতে ওই ঘরগুলোর অকেগুলোতে থাকছেন না অনেক পরিবার। ঘর বরাদ্দপ্রাপ্ত সুবিধাভোগীরা কেউবা কর্মের তাগিদে পরিবার নিয়ে শহরে থাকেন, আবার কেউবা ঘর বরাদ্দ নিয়ে পূর্বের ঠিকানায় ফিরে গেছেন। এর আগে বরাদ্দ পেতে রাজনৈতিক বিবেচনায় তদবির, উপজেলা প্রশাসনের দপ্তরের চাকুরির সুবাদে প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের সুপারিশ, আবার কেউ কেউ টাকার বিনিময়ে বরাদ্দ নেন ওইসব ঘরের।
উপজেলার মাইজখার ইউনিয়নের ভোমরকান্দি গ্রামের খাস জমিতে একত্রে ৪০টি ঘর নির্মাণ করে সেখানে ৪০টি পরিবারকে আশ্রয় দেওয়া হয়। গত শনিবার (৮ মার্চ) দুপুরে সরজমিনে দেখা যায়, সেখানকার ৫, ৭, ১১, ১৪, ২৪, ২৯, ৩০, ৩৫, ৩৬ ও ৪০নম্বর ঘরগুলোর কোনোটিতে তালা ঝুলছে, আবার কোনটির দরজা খোলা ফেলেই চলে গেছে বরাদ্দপ্রাপ্তরা। তালাবদ্ধ ঘরগুলোর কোনটির সামনে রয়েছে পাশের ঘরের বাসিন্দাদের লাকড়ি ও পাতার স্তুপ। আর দরজা খোলা রেখে ফেলে যাওয়া ঘরগুলোর ভিতরে রয়েছে পাশের ঘরের বাসিন্দাদের লাকড়ি, খড়কুটো। আবার কোনোটিতে হাঁস মুরগি পালন করা হচ্ছে। সেখানকার ৪০ নম্বর ঘরটি যার নামে বরাদ্দ ওই ব্যক্তি ঘর বরাদ্দ পাওয়ার কয়েকদিন পর ঘরের বৈদ্যুতিক তারসহ মূল্যবান জিনিসপত্র খুলে নিয়ে গেছে। কোনো কোনো ঘরে দুই বছরেও কোন মানুষ বসবাস না করায় বকেয়া বিলের দায়ে বৈদ্যুতিক লাইন বিচ্ছিন্ন করেছে পল্লী বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষ। আবার কোনো ঘরে একদিনও বৈদ্যুতিক আলো না জ্বলায় দুই বছরে মিটার রিডিং শুন্যের কোঠায়!
রবিবার (৯ মার্চ) উপজেলার কেরণখাল ইউনিয়নের ছয়ঘড়িয়া গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক সংলগ্ন অত্যন্ত সুন্দর পরিবেশে এক সঙ্গে ৩০টি গৃহ নির্মাণ করে সেগুলো বরাদ্দ দেওয়া হয়। বর্তমানে সেখানে ১৬টি পরিবার স্থায়ীভাবে বসবাস করলেও ১০টি পরিবারের কোনো খোঁজ নেই। ৪টি ঘরে প্রকৃত বরাদ্দপ্রাপ্তর না থাকলেও বাস করছেন অন্যরা।
আরও পড়ুন: সংশোধিত ড্যাপ বাতিলের দাবি আবাসন ব্যবসায়ীদের, আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত হবে মনে করছেন পরিকল্পনাবিদরা
অভিযোগ রয়েছে উপজেলা প্রশাসনে অস্থায়ী ভিত্তিতে চাকুরি করার সুবাদে লাইলি বেগম ঘর বরাদ্দ নিয়ে এ পর্যন্ত ওই ঘরে বসবাস করেননি। সুবিধাভোগী রিকশাচালক সুজন ঘর বরাদ্দ নিয়ে একদিনও থাকেনি।
লাইলি বেগম জানান, আমি মাঝে মধ্যে ওই ঘরে যাই। আর আমার মামার বাড়ি চান্দিনা উপজেলা সদরের মহারং গ্রামে, বেশির ভাগ সময় সেখানেই থাকি।
একই দিন শুহিলপুর ইউনিয়নের শুহিলপুর গ্রামে গিয়ে দেখা যায় ৮টি ঘরের মধ্যে ১টিতে বাসিন্দা নেই। ঘর বরাদ্দ পাওয়া বিমল শুরু থেকেই থাকছেন ওই ঘরে। অম্বরপুর গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে ২৫ ঘরের মধ্যে ৯টি ফাঁকা পড়ে আছে।
ভোমরকান্দি আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাসিন্দা ওসমান গণি জানান, সে সময়ে ঘরগুলো এলোমেলোভাবে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এক গ্রামের বা এক ইউনিয়নের বাসিন্দাকে অন্য গ্রামে অন্য ইউনিয়নে ঘর দেয়। যে কারণে অনেকেরই কোনো কাজ কর্ম নেই। এখানে অনেকে কর্ম না পেয়ে বাধ্য হয়ে অন্যত্র চলে গেছে।
আশ্রয়ণ প্রকল্পের একাধিক বাসিন্দা জানান, সে সময়ে (যখন ঘর বরাদ্দ দেওয়া হয়) চেয়ারম্যান মেম্বারসহ রাজনৈতিক নেতাদের সুপারিশে অনেক ঘর বরাদ্দ দেওয়া হয়। যাদের বাড়িতে জায়গা আছে, বা যারা চান্দিনাতে থাকেন না—এমন লোকদেরকেও ঘর বরাদ্দ দেওয়া হয়। ওইসময়ে প্রকৃত ভূমিহীন অনেকেই ঘর বরাদ্দ পায়নি। বর্তমানে সবগুলো ঘর যাচাই-বাছাই করে যারা ঘরে থাকছে না বা যাদের নিজস্ব জায়গা থাকার পরেও ঘর বরাদ্দ নিয়েছেন— তাদের বরাদ্দ বাতিল করে প্রকৃত ভূমিহীনদের তালিকা করে ঘরগুলো বরাদ্দ দেওয়ার অনুরোধ জানান তারা।
আরও পড়ুন: গণভবনে জাদুঘরের পাশাপাশি শহীদদের পরিবারের আবাসনের প্রস্তাব পার্থর