আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস
মে দিবসের ১৩৫ বছর পরও আট শ্রমঘণ্টা কতটা যৌক্তিক?
শ্রমঘণ্টা কমানোর দাবিতে ১৮৮৬ সালের ১ মে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরে হাজারো শ্রমিক রাস্তায় নেমে এসেছিলেন। তাদের ‘আট ঘণ্টা কাজ, আট ঘণ্টা বিশ্রাম ও আট ঘণ্টা নিজের জন্য’—দাবিতে করা রক্তক্ষয়ী আন্দোলন পরবর্তীতে বিশ্বব্যাপী শ্রমিক অধিকার প্রতিষ্ঠার ইতিহাসে মাইলফলক হয়ে ওঠে। সেই আন্দোলনের স্বীকৃতি দিয়েই ১৯৯০ সাল থেকে প্রতি বছর ১ মে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস বা মে দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।
শুধু তা-ই নয়, বিশ্বজুড়ে শ্রমিকদের সময়ের মর্যাদা দিতে আট কর্মঘণ্টাকেই আদর্শ হিসেবে ধরে পরিচালিত হয়ে আসছে তাবৎ কর্মযজ্ঞ। তবে অতীতের তুলনায় প্রযুক্তি, উৎপাদনশীলতা ও কাজের ধরনে অভাবনীয় পরিবর্তন এলেও আজও বহু দেশে এই আট কর্মঘণ্টা সময়-কাঠামো অপরিবর্তিত থেকে গেছে। বর্তমান বিশ্বে যেখানে দূরবর্তী কাজ (রিমোট ওয়ার্ক), হাইব্রিড ওয়ার্ড মডেল, অটোমেশন ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মতো প্রযুক্তির প্রভাব ক্রমবর্ধমান, সেখানে প্রশ্ন ওঠে— আট ঘণ্টার শ্রমঘণ্টা এখন কতটা যৌক্তিক?
ইতিহাস ও প্রেক্ষাপট
১৮ শ’ শতকের শেষের দিকে শিল্প বিপ্লবের যুগে নতুন সৃষ্টিশীলতায় মেতে ওঠেন উৎপাদকরা। তাদের চিন্তা-চেতনায় তখন শুধু কাজ আর কাজ। ফলে দিনরাত এক করে পণ্য উৎপাদন ও হিসাবের খাতায় অঙ্কের সংখ্যা বাড়ানোয় বিভোর হয়ে যান শিল্পপতিরা। আলোস্বরূপ লাভের সবটুকু তারা পকেটে পুরে নিজেদের জীবন প্রাচুর্যে ভরিয়ে তুললেও পাদপ্রদীপের অন্ধকারের মতোই দুর্বিষহ হয়ে ওঠে শিল্প-কারখানাগুলোর চালিকাশক্তি—শ্রমিকদের জীবন।
সেই সময় শ্রমিকদের জীবনের মূ্ল্যায়ন হতো না বললেই চলে। অনেক সময় দিনে ১৪ থেকে ১৬ ঘণ্টাও কাজ করতে হতো তাদের। ফলে একপর্যায়ে মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে এই শোষণের বিরুদ্ধে শ্রমঘণ্টা সীমিত করার দাবি ওঠে।
ব্রিটেনে ১৮১৭ সালে সমাজ সংস্কারক রবার্ট ওয়েন প্রথম ‘আট ঘণ্টা শ্রম, আট ঘণ্টা বিনোদন ও আট ঘণ্টা বিশ্রাম’ স্লোগানটি দেন। তার দীর্ঘ সময় পর ১৮৮৬ সালে শিকাগোর হে মার্কেটের ঘটনার মধ্য দিয়ে এই দাবিটি সর্বজনীন রূপ নেয়।
এরপর ১৮৮৯ সালে প্যারিসে ফরাসি বিপ্লবের শতবার্ষিকীতে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক কংগ্রেস নামে সমাজতান্ত্রিক ও শ্রমিক সংগঠনের একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ওই সম্মেলনে হে মার্কেট কাণ্ডে নিহতদের স্মরণে এবং আট ঘণ্টার কর্মদিবসের দাবিকে এগিয়ে নিতে প্রতি বছরের ১ মে-কে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
১৮৯০ সালের ১ মে প্রথমবার ইউরোপ, আমেরিকা ও বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলের শ্রমিকরা এই দিনটি পালন করেন। এরপর থেকে মে দিবস শ্রমিকদের ঐক্য, সংগ্রাম ও অধিকারের প্রতীক হয়ে ওঠে। পরবর্তীতে ১৯১৯ সালে গঠিত আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) তাদের প্রথম কনভেনশনেই আট ঘণ্টা কর্মদিবসের পক্ষে সিলমোহর দেয়।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার দৃষ্টিভঙ্গি
আইএলওর মতে, ৮ ঘণ্টার কর্মদিবস মানে একজন শ্রমিকের শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা নিশ্চিত করা এবং কাজ ও জীবনের মধ্যে সঠিক ভারসাম্য (ওয়ার্ক-লাইফ ব্যালেন্স) বজায় রাখা। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সংস্থাটি স্বীকার করেছে যে, প্রযুক্তির প্রভাবে কাজের ধরনে পরিবর্তন এসেছে এবং সেই অনুযায়ী কাজের সময় নিয়েও পুনর্বিবেচনার জায়গা তৈরি হয়েছে।
সংস্থাটি ২০১৯ সালে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে ভবিষ্যতের কর্মপরিবেশ কেমন হওয়া উচিত, তা নিয়ে একটি রূপরেখা তুলে ধরে। ওয়ার্ক ফর অ্যা ব্রাইট ফিউচার শিরোনামের ওই প্রতিবেদনে যে কর্মপরিকল্পনা দেখানো হয়, তাতে তিনটি মূল বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়—মানবিক মূল্যবোধকে প্রাধান্য দেওয়া, সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা এবং ভবিষ্যত কর্মের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, জনসংখ্যা, প্রযুক্তি ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বৈশ্বিক শ্রমবাজারে কাজের ধরন দ্রুত বদলে যাচ্ছে। এই পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মেলাতে হলে কর্মক্ষেত্রে সময় ব্যবস্থাপনাকে আরও নমনীয় করতে হবে।
সংস্থাটি তাই কর্মঘণ্টার পুনর্বিন্যাস, সপ্তাহে আরও কম দিন কাজের সুবিধা ও রিমোট ওয়ার্কের মতো নমনীয় কর্মব্যবস্থার পরামর্শ দেয়। উদাহরণ হিসেবে তারা নমনীয় কর্মঘণ্টা (ফ্লেক্সিবল ওয়ার্কিং আওয়ারস), সঙ্কুচিত কর্মসপ্তাহ (কম্প্রেসড ওয়ার্কউইক) ও দূরবর্তী কর্মপদ্ধতির (টেলিওয়ার্ক) মতো কার্যকর মডেলের কথা তুলে ধরে, যা কাজ ও জীবনের ভারসাম্য রক্ষায় সহায়ক হতে পারে।
কর্মঘণ্টা নিয়ে গবেষণা ও কর্মীর স্বাস্থ্য সুরক্ষা
কর্মঘণ্টা কমানো হলে উৎপাদশীলতায় নেতিবাচক প্রভাব পড়ে কিনা, তা নিয়ে গবেষণা চলছে বেশ কয়েক বছর ধরেই। তবে এসব গবেষণা চমকপ্রদভাবে কর্মীবান্ধব ফল উপস্থাপন করেছে।
একাধিক গবেষণায় আইএলও দেখিয়েছে যে, অতিরিক্ত কর্মঘণ্টা কর্মীর শুধু শারীরিক ও মানসিক ক্ষতিই করে না, বরং এটি অর্থনৈতিকভাবেও খুব বেশি কার্যকর মডেল নয়।
সংস্থাটির ২০২২ সালে করা এক গবেষণায় বলা হয়েছে, কর্মঘণ্টা কমালে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শ্রমিকদের উৎপাদনশীলতা বাড়ে। সেইসঙ্গে তাদের মানসিক স্বাস্থ্যেরও উন্নতি ঘটে। ফলে এটি তাদের ব্যক্তিজীবনকে আরও সমৃদ্ধ করে।
২০২৩ সালে কর্মঘণ্টা ও ওয়ার্ক-লাইফ ব্যালেন্স নিয়ে আরও একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে আইএলও। তাতে বলা হয়, কোভিড-১৯ মহামারি-পরবর্তী বাস্তবতায় ‘ফ্লেক্সিবল ওয়ার্ক’ কর্মীদের মানসিক সুস্থতা ও উৎপাদনশীলতা বাড়ায়, যা সামগ্রিকভাবে প্রতিষ্ঠানের জন্য লাভজনক ফল বয়ে আনে।
সারা বিশ্বের শ্রমিকদের অধিকার রক্ষায় নিয়োজিত এই সংস্থাটি এমন একটি কর্মপরিবেশ চায়, যেখানে কাজ ও ব্যক্তিজীবনের মধ্যে ভারসাম্য বজায় থাকবে এবং কর্মীর স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা ও দক্ষতার প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হবে।
আইএলওর এই দৃষ্টিভঙ্গি আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা ওইসিডির বেটার লাইফ ইনডেক্স ও জাতিসংঘের উন্নয়ন সংস্থা ইউএনডিপির মানব উন্নয়ন প্রতিবেদনেও প্রতিফলিত হয়।
ওইসিডির সূচকে ‘ওয়ার্ক-লাইফ ব্যালেন্স’ একটি গুরুত্বপূর্ণ মানদণ্ড, যেখানে কম কর্মঘণ্টা, পরিবারকে পর্যাপ্ত সময় দেওয়া ও জীবনের সন্তুষ্টির মতো বিষয়গুলো বিবেচনায় নেওয়া হয়। অপরদিকে, ইউএনডিপির মানব উন্নয়ন সূচকে কেবল আয় নয়, বরং শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও জীবনমানের সঙ্গে কাজের পরিবেশকেও গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
ফলে শ্রমঘণ্টা ও কাজের ধরন নিয়ে নতুন ভাবনার প্রয়োজনীয়তা এই উন্নয়ন সূচকগুলোতেও স্পষ্টভাবে উঠে আসে।
আইএলও ২০২২ সালে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার সঙ্গে যৌথভাবে যে নীতিমালা প্রকাশ করে, তাতেও এসব গবেষণা থেকে প্রাপ্ত ফলাফল প্রতিফলিত হয়। এতে নেতিবাচক কর্মসংস্কৃতি, অতিরিক্ত সময় কাজ করা এবং কাজের চাপে মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতির দিকগুলো তুলে ধরা হয়। সেই সঙ্গে স্বাস্থ্যবান্ধব কর্মপরিবেশ গড়ে তুলতে মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক প্রশিক্ষণ ও সহায়তামূলক নীতি প্রণয়ন করা জরুরি বলেও সুপারিশ করা হয়।
আট ঘণ্টার কর্মদিবসের যৌক্তিকতা
বিশ্ব অর্থনীতির জটিলসব পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে মানব সভ্যতা একবিংশ শতকের দুই যুগ অতিক্রান্ত করে বর্তমান সময়ে উপনীত হয়েছে। ফলে দিনে আট ঘণ্টা কাজ করা একসময় প্রগতিশীল ধারণা থাকলেও এখন প্রগতি পেয়েছে নতুন ধারণা। নতুন অর্থনীতির এই প্রেক্ষাপটে এখন কর্মীদের মূল্যায়ন হয় কাজের মান, দক্ষতা ও ফলাফলের ভিত্তিতে। তাই কর্মঘণ্টার সংজ্ঞাকেও নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করার প্রয়োজনীয়তা এসেছে।
২০২২ সালের জুন থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত যুক্তরাজ্যের ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় ও বোস্টন কলেজ চার দিনের কর্মসপ্তাহের ওপর বিশ্বের বৃহত্তম গবেষণা পরিচালনা করে। ওই যৌথ গবেষণায় ৬১টি প্রতিষ্ঠানের অন্তত ২ হাজার ৯০০ কর্মী অংশ নেন। তাতে দেখা যায়, দীর্ঘ কর্মঘণ্টা মানেই বেশি আউটপুট—এই ধারণা একেবারেই বুজরুকি।
২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত ওই গবেষণায় দেখা যায়, এতে অংশ নেওয়া কর্মীরা সপ্তাহে ৩২ থেকে ৩৫ ঘণ্টা কাজ করেও সর্বোচ্চ উৎপাদনশীলতা দেখিয়েছেন। শুধু তা-ই নয়, সপ্তাহে ৩২-৩৫ ঘণ্টাই শ্রমিকরা সবচেয়ে বেশি উৎপাদনশীল থাকেন বলে গবেষণায় উঠে আসে।
চলুন, গবেষণার ফলাফলের সংক্ষিপ্তসারের ওপর চোখ বোলানো যাক:
মানসিক ও শারীরিক সুস্থতা: ৭১ শতাংশ কর্মীর বার্নআউটের মাত্রা কমেছে এবং ৩৯ শতাংশ কর্মী কম চাপ অনুভব করেছেন। সামগ্রিকভাবে, তাদের মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের উন্নতি হয়েছে।
ওয়ার্ক-লাইফ ব্যালেন্স: ৬০ শতাংশ কর্মীর জন্য পারিবারিক কাজের সমন্বয় সহজ হয়েছে এবং কর্মীদের ৬২ শতাংশ সামাজিক জীবনের সঙ্গে কাজের ভারসাম্য বজায় রাখতে পেরেছেন।
উৎপাদনশীলতা ও আয়: প্রতিষ্ঠানগুলোর আয় গড়ে ১.৪ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। কিছু প্রতিষ্ঠানের আয়ে আগের বছরের তুলনায় ৩৫ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তে দেখা যায়।
কর্মী ধরে রাখা: কর্মীদের প্রতিষ্ঠান ছাড়ার হার ৫৭ শতাংশ কমেছে। এছাড়া অসুস্থতার কারণে অনুপস্থিতির হারও কমেছে ৬৫ শতাংশ।
কর্মসংস্কৃতির পরিবর্তন: প্রতিষ্ঠানগুলোতে দীর্ঘ ও অপ্রয়োজনীয় মিটিং কমানো সত্ত্বেও কর্মীরা স্বয়ংক্রিয়ভাবে উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর উপায় খুঁজে নিয়েছেন।
গবেষণার শেষে, ৯২ শতাংশ প্রতিষ্ঠান চার দিনের কর্মসপ্তাহের মডেলটি চালু রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। এর মধ্যে ১৮টি প্রতিষ্ঠান এটিকে স্থায়ী নীতি হিসেবে গ্রহণ করে।
বিশ্বজুড়ে কর্মঘণ্টা কমানোর উদাহরণ ও ফলাফল
গত কয়েক দশকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ পরীক্ষামূলকভাবে কর্মঘণ্টা কমিয়েছে এবং তাতে নানা ইতিবাচক প্রভাব পরিলক্ষিত হয়েছে:
আইসল্যান্ড: ২০১৫ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত দুটি বৃহৎ পরীক্ষামূলক প্রকল্প চালায় আইসল্যান্ড, যেখানে প্রায় আড়াই হাজার সরকারি কর্মচারী সপ্তাহে চার দিন কাজ করেন। এতে দেখা যায়, কর্মীদের উৎপাদনশীলতা তো কমে না-ই, বরং কিছু ক্ষেত্রে বেড়ে যায়। এর পাশাপাশি তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি হয় এবং ওয়ার্ক-লাইফ ভারসাম্য উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায়। এই প্রকল্পের সফলতার পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমানে দেশটির প্রায় ৮৬ শতাংশ কর্মক্ষেত্রেই সংক্ষিপ্ত কর্মঘণ্টা চালু হয়েছে।
জাপান: ২০১৯ সালে জাপানে কর্মীদের ওপর একটি পরীক্ষামূলক কর্মসূচি চালায় মাইক্রোসফট। এই কর্মসূচির আওতায় কর্মীদের সপ্তাহে চার দিন কাজ করতে দেওয়া হয়। ফলাফলে দেখা যায়, তাদের কর্মক্ষমতা প্রায় ৪০ শতাংশ বেড়েছে।
স্পেন: স্পেন ২০২১ সালে পরীক্ষামূলকভাবে সপ্তাহে চার দিন কাজের প্রকল্প চালু করে, যেখানে কিছু ক্ষেত্রে দৈনিক কর্মঘণ্টা কমানো হয়। প্রাথমিক ফলাফলে দেখা যায়, কর্মীদের মধ্যে চাপ কমে, স্বাস্থ্য ভালো থাকে এবং উদ্ভাবনী শক্তি বাড়ে।
দক্ষিণ কোরিয়া: অতিরিক্ত ওভারটাইম ও কর্মজীবনের ভারসাম্যহীনতার মতো সংকট মোকাবিলায় ২০১৮ সালে প্রথমবার কর্মঘণ্টা সীমিত করার পদক্ষেপ নেয় দক্ষিণ কোরিয়া। ৪০ ঘণ্টা নিয়মিত কাজ এবং অতিরিক্ত ১২ ঘণ্টা ওভারটাইমের সুযোগ রেখে সাপ্তাহিক সর্বোচ্চ কর্মঘণ্টা ৬৮ থেকে কমিয়ে ৫২ ঘণ্টা করে দেশটি।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে উদ্যোগটি দেশটির জনশক্তির কাছে সমাদৃত হয়। পরবর্তীতে ২০২৩ সালে তা ৫২ থেকে বাড়িয়ে ৬৯ ঘণ্টা করার প্রস্তাব দেওয়া হলেও ব্যাপক সমালোচনা ও গণআন্দোলনের মুখে প্রস্তাবটি স্থগিত করতে বাধ্য হয় সরকার।
এআইয়ের যুগে শ্রমঘণ্টা নিয়ে নতুন ভাবনা
প্রযুক্তি ও অটোমেশনের এই যুগে কাজের ধরনও অভূতপূর্ব পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এই রূপান্তরকে আরও নাটকীয় গতি দিয়েছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই। প্রযুক্তির উপযুক্ত ব্যবহারের মাধ্যমে এখন অনেক পুনরাবৃত্তিমূলক, সময়সাপেক্ষ ও নিয়মিত কাজ নিমেষেই করে ফেলা যাচ্ছে, আগে যা ছিল শ্রম ও সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। শ্রমিকের কর্মপন্থায়ও তাই এসেছে অভাবনীয় পরিবর্তন। কায়িক শ্রমের বদলে সৃজনশীল চিন্তা, জটিল সমস্যার সমাধান ও মানসম্পন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণের মতো বিষয়ই হয়ে উঠছে কর্মীর মূল দায়িত্ব।
এমন বাস্তবতায় ‘ঘণ্টাভিত্তিক কাজ’ নয় বরং ‘ফলাফলভিত্তিক কাজ’ই আরও বেশি যৌক্তিক হয়ে উঠছে। আগে যেখানে নির্দিষ্ট সময় অফিসে উপস্থিত থাকাটা জরুরি ছিল, এখন সেখানে ক্লাউড প্রযুক্তি, রিমোট টুলস ও এআইয়ের সহযোগিতায় কর্মীরা যেকোনো স্থান থেকেই অপেক্ষাকৃত কম সময়ে অধিকতর কার্যকর ফল দিতে পারছেন।
এই প্রেক্ষাপটে ‘ফিক্সড টাইম’ ধারণার পরিবর্তে ‘ফ্লেক্সিবল টাইম’ ও ‘আউটপুট-ভিত্তিক মূল্যায়ন’ ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। এর পাশাপাশি কর্মীদের মানসিক প্রশান্তি ও সৃজনশীলতা নিশ্চিত করার মতো নীতিমালা প্রতিষ্ঠানগুলোতে গুরুত্ব পাচ্ছে।
গবেষণা বলছে, প্রযুক্তি ব্যবহারে শ্রমঘণ্টা ২০ শতাংশ পর্যন্ত হ্রাস করেও উৎপাদনশীলতা একই রাখা অথবা বাড়ানো সম্ভব।
২০২২ সালে প্রকাশিত আন্তর্জাতিক নিরীক্ষা সংস্থা ডেলয়েটের ‘গ্লোবাল হিউম্যান ক্যাপিটাল ট্রেন্ডস’ শীর্ষক প্রতিবদেন বলা হয়, ‘ফ্লেক্সিবিলিটি ইজ দ্য নিউ ইনসেনটিভ’, অর্থাৎ সময়ের স্বাধীনতা কর্মীদের কাছে বেতন বা এ ধরনের সুবিধার মতোই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ
ওয়াশিংটন কনভেনশনে আইএলও দৈনিক সর্বোচ্চ কাজের সময় ৮ ঘণ্টা এবং সাপ্তাহিক ৪৮ ঘণ্টা নির্ধারণ করে। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ এই কনভেনশনে সই করলেও দেশের বহু খাতে এখনও এই নিয়ম মানা হয় না।
দেশের সরকারি চাকরিতে দৈনিক সর্বোচ্চ আট কর্মঘণ্টা এবং সপ্তাহে দুদিন ছুটির ব্যবস্থা থাকলেও বেসরকারিখাতের বেশিরভাগ জায়গায় এই নিয়ম যেন সোনার হরিণ।
এ ক্ষেত্রে তৈরি পোশাক, নির্মাণ ও পরিবহন খাতের শ্রমিকদের দৈনিক কর্মঘণ্টার পরিসর আরও বেশি। বিশেষ করে বেতন, বোনাস, ওভারটাইমের দেওয়া হয় না বলে অভিযোগ তুলে মালিকপক্ষের বিরুদ্ধে পোশাকশ্রমিকদের অবরোধ-বিক্ষোভ প্রদর্শন এ দেশে নৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বাংলাদেশ শ্রম গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইএলএস) ২০১৭ সালে পরিচালিত এক গবেষণা থেকে দেখা যায়, বাংলাদেশে অনেক কারখানাই আইএলও নির্ধারিত কর্মঘণ্টা ও কর্মক্ষেত্রের নিরাপত্তা সংক্রান্ত মান মেনে চলে না। দেশের শ্রমিকরা প্রতিদিন গড়ে ১২ ঘণ্টা কাজ করেন, যেখানে পরিবহন খাতে কর্মরত শ্রমিকদের অনেকেই ১৯ শতকের মতো দিনে ১৫ ঘণ্টারও বেশি সময় কাজ করে থাকেন।
২০২৩ সালে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) এক জরিপে দেখা যায়, দেশের প্রায় ৬৫ শতাংশ পোশাককর্মী দিনে গড়ে ১০ ঘণ্টা বা তার বেশি সময় কাজ করেন।
এ দেশে এখনও সপ্তাহে ৫ দিন কর্মদিবস পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি। সরকারি খাতে এই ব্যবস্থা থাকলেও বেসরকারি খাতের অনেক ক্ষেত্রেই সপ্তাহে ৬ দিন কাজ চলে। ফলে, বিশ্বব্যাপী কর্মঘণ্টা হ্রাসের যে ধারা তা থেকে অনেক পিছিয়ে বাংলাদেশ।
অবশ্য প্রযুক্তি খাতের কিছু প্রতিষ্ঠানকে সম্প্রতি ‘ফ্লেক্সিবল ওয়ার্ক আওয়ার’-এর মতো পদক্ষেপ নিতে দেখা যাচ্ছে, যা দেশের কর্ম পরিমণ্ডলে আশার সঞ্চার করেছে।
তবে দেশের শিল্পকারখানাগুলোতে আধুনিক প্রযুক্তি স্থাপনের অপ্রতুলতা, প্রযুক্তি পরিচালনায় দক্ষ জনগোষ্ঠীর অভাবের মতো চ্যালেঞ্জও রয়েছে, যা বিজ্ঞানের এই আশীর্বাদকে কাজে লাগিয়ে শ্রমঘণ্টা কমিয়ে আনার পথে বড় বাধা।
করণীয় ও সুপারিশ
বৈশ্বিক শ্রম-অঙ্গন ও বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে দেশের শ্রমবাজারের ইতিবাচক সংস্কারের জন্য কয়েকটি সুপারিশ দেওয়া যেতে পারে:
নীতি ও আইনগত সংস্কার: শ্রম আইনে নির্ধারিত কর্মঘণ্টার বাস্তব প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। কর্মক্ষেত্রে অতিরিক্ত সময় কাজ করানোর ক্ষেত্রে কর্মীদের সম্মতি ও উপযুক্ত পারিশ্রমিক পরিশোধের বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে।
ফলাফল-ভিত্তিক মূল্যায়ন: সময়ের বদলে কাজের গুণমান ও ফলাফলের ভিত্তিতে কর্মীদের মূল্যায়ন ব্যবস্থা চালু করা সময়ের দাবি। বিশেষ করে প্রযুক্তিনির্ভর ও সৃজনশীল পেশাগুলোতে যেকোনো মুহূর্তেই এটি বাস্তবায়ন করা যেতে পারে।
নমনীয় কর্মপরিবেশ: কর্মীদের মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নয়ন ও কাজের প্রতি আগ্রহ বজায় রাখতে ফ্লেক্সিবল ওয়ার্কিং আওয়ার, হাইব্রিড ওয়ার্ক মডেল ও রিমোট ওয়ার্কের মতো সুযোগের সম্প্রসারণ করা প্রয়োজন।
কর্মদিবস পুনর্বিন্যাস: সপ্তাহে পাঁচদিন অফিস চালু করতে সকল বেসরকারি খাতকে উৎসাহিত করা যেতে পারে। একই সঙ্গে কর্মদিবস কমিয়ে দৈনিক কর্মঘণ্টা পুনর্বিন্যাস করে পাইলট প্রকল্প হাতে নেওয়া যায়।
প্রযুক্তি ব্যবহার ও দক্ষতা উন্নয়ন: এআই ও অটোমেশনের যুগে শ্রমিকদের প্রযুক্তিগত দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য প্রশিক্ষণ ও একাধিক বিষয়ে দক্ষ করে গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। এতে করে তারা পরিবর্তিত কর্মপরিবেশে টিকে থাকার পাশাপাশি আধুনিক প্রযুক্তিভিত্তিক কাজগুলোও এগিয়ে নিতে পারবেন।
নারী কর্মীদের জন্য সহায়ক নীতি: নারী কর্মীদের জন্য মাতৃত্বকালীন ছুটি, ডে-কেয়ার সুবিধা, নমনীয় কর্মঘণ্টা ও নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিতে আরও বেশি মনোযোগ দিতে হবে। এর ফলে কর্মক্ষেত্রে তাদের দীর্ঘমেয়াদি অংশগ্রহণ বাড়বে।
গবেষণায় জোর: জাতীয় পর্যায়ে কর্মঘণ্টা, ওয়ার্ক-লাইফ ব্যালেন্স ও উৎপাদনশীলতা নিয়ে বেশি বেশি গবেষণা হওয়া জরুরি। এর ফলে সামগ্রিকভাবে উৎপাদনশীলতা বাড়বে, সমস্যার জায়গাগুলো চিহ্নিত করে তা সমাধানও করা যাবে। এতে কর্মীর ব্যক্তিগত উন্নয়নের পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানের আয় বাড়বে, যা মোটের ওপর দেশের অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখবে।
বহু বছর আগে শ্রমিক অধিকার আন্দোলনের অন্যতম সাফল্য ছিল আট ঘণ্টার কর্মদিবস। কিন্তু বর্তমান বাস্তবতায় এই সময়-কাঠামো নতুন করে বিন্যাসের বিষয়ে ভাবার সময় এসেছে। এটি শুধু সময় কমানোর প্রশ্ন নয়, বরং কাজের মান, কর্মীর সুস্থতা ও জীবনমান উন্নয়নের প্রশ্ন। আর নীতিনির্ধারক, মালিকপক্ষ ও শ্রমিকদের সম্মিলিত উদ্যোগেই এর যথাযথ বাস্তবায়ন সম্ভব।
২১৮ দিন আগে
আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস: ইতিহাস ও তাৎপর্য
সঠিক কর্মঘণ্টা, ন্যায্য মজুরি, নিরাপদ কাজের শর্ত এবং সম্মিলিতভাবে সংগঠিত ও দর কষাকষির সুযোগের সঙ্গে আবর্তিত হয় শ্রম অধিকার। এই অধিকারগুলো শোষণ ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে শ্রমজীবীদের মর্যাদা, সমতা এবং সুরক্ষার প্রতীক। এই প্রতীকের পতাকা বিশ্বের প্রতিটি ভূ-খণ্ডে গেড়ে দেওয়ার জন্যই মে দিবস বা শ্রমিক দিবসের আবির্ভাব। এই দিবসের শিকড়ে রয়েছে শ্রমিক আন্দোলনের শত শত অর্জন, যেখানে প্রাণ পেয়েছে সংহতি এবং সামাজিক ন্যায়বিচার। এই প্রেক্ষাপটে চলুন জেনে নেওয়া যাক আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবসের ইতিহাস ও তাৎপর্য সম্পর্কে।
আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবসের ইতিহাস
১৮৫৬ সালের ২১ এপ্রিল ভিক্টোরিয়ায় অস্ট্রেলিয়ান পাথর শ্রমিকরা ৮ ঘণ্টা কর্মদিবসের দাবিতে সম্মিলিতভাবে কাজ বন্ধ রাখে। ঘটনাটি সে সময় একটি বার্ষিক স্মারক হয়ে ওঠে, যা আমেরিকান কর্মীদের অনুপ্রাণিত করেছিল প্রথমবারের মতো আন্দোলনে যেতে।
১৮৮৬ সালের মে মাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন রাজ্যে ৪ লাখ শ্রমিক ৮ ঘণ্টা কর্মদিবসের দাবিতে ধর্মঘটের ডাক দেন। শুরুটা শান্তিপূর্ণভাবে হলেও বিক্ষোভের তৃতীয় দিনে শিকাগোতে কিছুটা সহিংসতা হয়। পুলিশ নিরস্ত্র শ্রমিকদের উপর গুলি চালানোয় বেশ কয়েকজন শ্রমিক নিহত হন। ফলশ্রুতিতে পরের দিন বিক্ষোভের মাত্রা আরও বেড়ে যায়।
আরও পড়ুন: শ্রমিক অধিকার লঙ্ঘনের জরিমানার অংক বাড়ানো হয়েছে: আইনমন্ত্রী
বিক্ষোভকারীরা পুলিশের দিকে একটি বোমা ছুঁড়ে মারে। একই সঙ্গে পুলিশের গুলি বর্ষণও চলছিল। এভাবে দুপক্ষের পাল্টা আঘাতে ৭ পুলিশ কর্মকর্তা ও ৪ জন শ্রমিক নিহত হন। বোমাটি ছুঁড়ে মারা মূল ব্যক্তিকে শনাক্ত না করা গেলেও ৮ শ্রমিককে গ্রেপ্তার করা হয়। এদের মধ্যে ৭ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় এবং একজন ১৫ বছরের কারাদণ্ড পান।
দ্য হেমার্কেট অ্যাফেয়ার নামে পরিচিত এই ঘটনাটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমিকদের আন্দোলনে যাওয়ার জন্য ছিল যথেষ্ট উৎসাহব্যাঞ্জক।
হেমার্কেট ঘটনাটি ক্রমেই শ্রমিকদের অধিকারের সংগ্রামের একটি আন্তর্জাতিক প্রতীক হয়ে ওঠে। এই পটভূমিতেই মে মাসের ১ তারিখকে বেছে নেওয়া হয় আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস হিসেবে।
১৮৮৯ সালে সমাজতান্ত্রিক দল ও শ্রমিক জোটের মিলিত সংগঠন সেকেন্ড ইন্টারন্যাশনালের প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হয় প্যারিসে। এই সভায় ঠিক হয় ১৮৯০ সালে সেই হেমার্কেট বিক্ষোভের ৪র্থ বার্ষিকীতে আন্তর্জাতিক বিক্ষোভ হবে।
১৮৯০ সালের ১ মে এই আহ্বানের রেশ ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের অধিকাংশ দেশগুলোতে মে দিবসের বিক্ষোভ হয়। অতঃপর ১৮৯১ সালে সেকেন্ড ইন্টারন্যাশনালের দ্বিতীয় কংগ্রেসে আনুষ্ঠানিকভাবে একটি বার্ষিক অনুষ্ঠান হিসেবে স্বীকৃতি পায় মে দিবস।
১৮৯২ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শ্রমিকদের জন্য ৮ ঘণ্টা কর্মদিবস আইন হয়ে ওঠে। তারপর থেকে সারা বিশ্বে শ্রমিক আন্দোলন অব্যাহত থাকে।
সেগুলোর মধ্যে সব থেকে তাৎপর্যবহুল ঘটনা ছিল ১৮৯৪ সালের মে দিবসের দাঙ্গা। এর পাল্টা জবাব দিতে সেকেন্ড ইন্টার্ন্যাশনালের ৬ষ্ঠ কংগ্রেসে দেশের সমস্ত সমাজতান্ত্রিক গণতান্ত্রিক দল ও ব্যবসায়িক সঙ্ঘগুলো একত্রিত হয়। এখানে সিদ্ধান্ত হয় মে মাসের ১ তারিখে ৮-ঘণ্টা দিবসের আইনী প্রতিষ্ঠার দাবিতে বিক্ষোভ প্রদর্শন হবে। এ সময় প্রতি বছর পহেলা মে’তে শ্রমিকদের কাজ বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
আরও পড়ুন: মে দিবস পালিত হবে সংক্ষিপ্ত পরিসরে: প্রতিমন্ত্রী
বিশ্বজুড়ে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস উদযাপন
ভিন্ন ভিন্ন নামের মধ্যে লেবার ডে এবং ওয়ার্কাস ডে- এই দুটি নামই বিশ্বজুড়ে সর্বাধিক পরিলক্ষিত হয়। এছাড়া বেশ কিছু দেশে সময়েরও ভিন্নতা রয়েছে। এর মধ্যে শ্রমিক দিবস হিসেবে উদযাপন করার অধিকাংশ দেশ পহেলা মে’কেই বেছে নিয়েছে।
চলুন, শুধু মে মাসের ১ তারিখকে শ্রমিক দিবস হিসেবে পালনকারী বিভিন্ন মহাদেশের দেশগুলো এক নজরে দেখে নেওয়া যাক।
আমেরিকান দেশগুলো হলো:
আর্জেন্টিনা, বলিভিয়া, ব্রাজিল, চিলি, কলম্বিয়া, কোস্টারিকা, কিউবা, ডোমিনিকান প্রজাতন্ত্র, ইকুয়েডর, এল সালভাদর, গুয়াতেমালা, হাইতি, হন্ডুরাস, মেক্সিকো, পানামা, প্যারাগুয়ে, পেরু, উরুগুয়ে এবং ভেনেজুয়েলা।
ইউরোপীয় দেশগুলোর তালিকায় রয়েছে:
আলবেনিয়া, বেলজিয়াম, ক্রোয়েশিয়া, সাইপ্রাস, চেক প্রজাতন্ত্র, এস্তোনিয়া, ফিনল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানি, গ্রীস, হাঙ্গেরি, ইতালি, লিথুয়ানিয়া, লাটভিয়া, লুক্সেমবার্গ, মাল্টা, মন্টিনিগ্রো, নেদারল্যান্ডস, নরওয়ে, পোল্যান্ড, পর্তুগাল রোমানিয়া, রাশিয়া, স্লোভাকিয়া, স্পেন, সুইডেন, সুইজারল্যান্ড, তুরস্ক, ইউক্রেন এবং যুক্তরাজ্য।
আফ্রিকার দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে:
আলজেরিয়া, অ্যাঙ্গোলা, ইথিওপিয়া, মিশর, ঘানা, কেনিয়া, লিবিয়া, মরিশাস, মরক্কো, মোজাম্বিক, নামিবিয়া, নাইজেরিয়া, সোমালিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, তানজানিয়া, তিউনিসিয়া, উগান্ডা এবং জিম্বাবুয়ে।
এশীয় দেশগুলো হলো:
হংকং, তাইওয়ান, উত্তর কোরিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, পাকিস্তান, কম্বোডিয়া, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, মায়ানমার, মালদ্বীপ, ফিলিপাইন, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, বাহরাইন, ইরান, ইরাক, জর্ডান, লেবানন এবং ইয়েমেন।
আরও পড়ুন: ঐতিহাসিক মে দিবস আজ
বসনিয়া ও হার্জেগোভিনা, উত্তর মেসিডোনিয়া, সার্বিয়া এবং স্লোভেনিয়ায় মে মাসের ১ ও ২ তারিখ শ্রমিক দিবস পালিত হয়। আর চীনে উদযাপিত হয় মে মাসের ১, ২ ও ৩ তারিখ টানা ৩ দিন।
এবার চলুন দেখে নেই মে মাস ছাড়াও ভিন্ন তারিখে শ্রমিক দিবস উদযাপনকারী দেশগুলোর তালিকা।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমিক দিবস প্রতি সেপ্টেম্বরের প্রথম সোমবার। কানাডার জন্যও একই দিনকে অনুসরণ করা হয়।
অস্ট্রেলিয়ার রাজধানী এলাকা, নিউ সাউথ ওয়েল্স এবং দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ায় মে দিবস পালিত হয় অক্টোবরের প্রথম সোমবার। ভিক্টোরিয়া এবং তাসমানিয়াতে শ্রমিক দিবস মার্চ মাসের দ্বিতীয় সোমবার, তবে নিউজিল্যান্ডে অক্টোবরের চতুর্থ সোমবার।
বাহামাসে ৭ জুন, জ্যামাইকায় ২৩ মে, জাপানে ২৩ নভেম্বর, ত্রিনিদাদ এবং টোবাগোতে ১৯ জুন, এবং কাজাখাস্তানে সেপ্টেম্বরের শেষ রবিবার পালিত হয় শ্রমিক দিবস।
বাংলাদেশে রানা প্লাজা ভবন ধসে নিহত শ্রমিকদের স্মরণে ২৪ এপ্রিলকে শ্রম নিরাপত্তা দিবস হিসেবে পালন করা হয়।
আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবসের শিক্ষা
মে মাসের ১ তারিখ শুধু একটি বার্ষিকী বা দিবস নয়। এটি গোটা বিশ্ববাসীর সম্মুখে উপস্থাপন করেছে অধিকার আদায়ের উপাখ্যান। এই আন্দোলনের পরিক্রমায় শিল্পপতি, পেশাদার, শ্রমিক, এবং তরুণ প্রজন্মের জন্য উন্মুক্ত হয়েছে কতগুলো শিক্ষণীয় বিষয়। চলুন, সেগুলোর স্বতন্ত্র বিশ্লেষণ করা যাক।
আরও পড়ুন: যে কোনো কারখানায়ই শ্রমিক ইউনিয়ন গঠন করা যাবে: আইনমন্ত্রী
শিল্পপতিদের জন্য শিক্ষা
কর্মীদের প্রতি ন্যায্য আচরণ এবং নিরাপদ কাজের পরিবেশ নিশ্চিত করা আবশ্যক। সুস্থ ও সন্তুষ্ট শ্রমিকগণ অধিক উৎপাদনশীল এবং কোম্পানির প্রতি অনুগত হয়।
শুধু তাই নয়; পরিবেশগত দায়িত্ব ও নৈতিক ব্যবসায়িক অনুশীলন একটি কোম্পানির সুনাম এবং দীর্ঘমেয়াদী সাফল্য বৃদ্ধি করতে পারে।
পেশাদারদের জন্য শিক্ষা
পেশাদার নৈতিকতা মালিক পক্ষ ও শ্রমিক শ্রেণী উভয়ের সঙ্গেই পেশাদারদের সুসম্পর্ক বজায় রাখতে সাহায্য করে। তাছাড়া এটি কার্যকর ভাবে সমস্যা সমাধানের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। এতে করে পেশাদার ব্যক্তি কেবল আরও দক্ষই হন না, সেই সঙ্গে নিয়োগকর্তা ও অধীনস্থ শ্রমিকদের নিকট পরম আস্থাভাজন হয়ে ওঠেন। এটি দীর্ঘ মেয়াদে তার ক্যারিয়ারের উন্নতির জন্যও অপরিহার্য।
শ্রমিকদের জন্য শিক্ষা
ঐক্য ও সংহতির মাধ্যমে বড় বড় শক্তিকেও পরাস্ত করা সম্ভব। একত্রিত থাকা শুধু কর্মজীবনেই নয়, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই সচেতন থাকার জন্য দরকার।
তাছাড়া মে দিবস শ্রমিকদের নিজেদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করে। ন্যায্য মজুরি, সঠিক কর্মঘণ্টা এবং নিরাপদ কাজের পরিবেশের ব্যাপারে জানার উপায় তৈরি হয়। এটি শুধু অধিকার আদায়ের জন্যই নয়, ক্রমাগত আত্মন্নোয়ন এবং প্রযুক্তির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার জন্যও জরুরি।
আরও পড়ুন: শ্রমিকের অধিকার সুরক্ষিত রাখতে কাজ করব: শ্রম প্রতিমন্ত্রী
তরুণ প্রজন্মের জন্য শিক্ষা
শ্রমিক দিবসের ইতিহাস বর্তমান তরুণ প্রজন্মের জন্য এক বিস্তৃত মাইলফলক। এই দিনটির তাৎপর্য বোঝা মানেই একে ঘিরে আন্দোলনের ত্যাগ ও যাবতীয় অর্জনের মাহাত্ম্য উপলব্ধি করা।
সেই সঙ্গে আসে সর্বদা সক্রিয় ও সজাগ থাকার শিক্ষা। এর ফলে মেধা ও মননের মাধ্যমে শ্রম অধিকার সম্পর্কে মালিক শ্রেণী বা নিয়ন্ত্রণকারী ব্যবস্থাকে তারা দায়বদ্ধ রাখতে পারে।
শেষাংশ
ভিন্ন নাম বা ভিন্ন তারিখে হলেও আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবসের মুল উদ্দেশ্য এক ও অভিন্ন। প্রতিটি স্লোগানের মূল কথা শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায় এবং সাম্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা। আন্দোলন মুখর ঐতিহাসিক প্রতিটি ঘটনা শিল্পপতি ও পেশাদারদের বারবার সতর্ক করে শ্রম আইন ও তার সঠিক চর্চার ব্যাপারে। হাজারও আত্মত্যাগের স্তম্ভে গত এক শতাব্দি ধরে যে সংগ্রামী স্থাপনা গড়েছে, তা বর্তমান সময়ের শ্রমিকদের পথ চলার পাথেয়। যে মাইলফলক ধরে অবলীলায় সামনে এগিয়ে যেতে পারে এ যুগের তরুণ প্রজন্ম। গড়ে তুলতে পারে শ্রমজীবীদের জন্য শর্তহীন সাম্যের পৃথিবী।
আরও পড়ুন: ‘শ্রমিক সংগঠনের প্রক্রিয়া আরও সহজ করা হবে’
৫৮৩ দিন আগে
ঐতিহাসিক মে দিবস আজ
শ্রমিক অধিকার প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার নিয়ে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও শনিবার পালিত হচ্ছে ঐতিহাসিক মে দিবস।
শ্রমঘণ্টা কমিয়ে দৈনিক আট ঘণ্টা করার দাবিতে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগোতে রাস্তায় নেমে আসা শ্রমিকদের ঐতিহাসিক আন্দোলনের স্মরণে প্রতি বছর মে দিবস বা আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংহতি দিবস পালন করা হয়।
দিনটি সরকারি ছুটির দিন।
দিনটির গুরুত্ব তুলে ধরে টেলিভিশন ও রেডিও স্টেশনগুলোতে বিশেষ অনুষ্ঠানমালা প্রচার এবং পত্রিকাগুলোতে বিশেষ নিবন্ধ প্রকাশ করা হয়।
আরও পড়ুন: মহান মে দিবস শনিবার
১৮৮৬ সালের ১ মে দৈনিক ১২ ঘণ্টার পরিবর্তে আট ঘণ্টা কাজের দাবিতে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগোতে শ্রমিকরা ফুঁসে উঠেন। হে মার্কেটের কাছে তাদের বিক্ষোভে পুলিশ গুলিবর্ষণ করলে ১০ শ্রমিক নিহত হন। উত্তাল সেই আন্দোলনের মুখে কর্তৃপক্ষ শ্রমিকদের দাবি মেনে দিতে বাধ্য হয় এবং বিশ্বব্যাপী দৈনিক আট ঘণ্টা কাজের সময় চালু করা হয়।
১৮৮৯ সালের ১৪ জুলাই প্যারিসে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক শ্রমিক সমাবেশে ১ মে’কে আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংহতি দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। পরের বছর থেকে বিশ্বব্যাপী এ দিনটি পালিত হচ্ছে।
ঐতিহাসিক মে দিবস উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণী দিয়েছেন।
তবে, বৈশ্বিক করোনাভাইরাস মহামারির কারণে এ বছর দিবসটি উপলক্ষে কোনো কর্মসূচি পালন করা হচ্ছে না।
১৬৭৯ দিন আগে