আবুল কালাম আজাদ মজুমদার
তিন সাংবাদিকের চাকুরিচ্যুতিতে সরকারকে দায়ী করা অনভিপ্রেত: উপ-প্রেস সচিব
সম্প্রতি সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরওয়ার ফারুকীর সংবাদ সম্মেলনে প্রশ্ন করার পর পৃথক তিনটি টেলিভিশন চ্যানেলের তিনজন সাংবাদিকের চাকুরিচ্যুতি এবং একটি টেলিভিশন চ্যানেলের সংবাদ প্রচার সাময়িক বন্ধ ঘোষণার ঘটনায় সরকারের কোনো ভূমিকা ছিল না বলে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টার উপ-প্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ মজুমদার।
তার মতে, ‘সংবাদ সম্মেলনের পর সরকার এ ঘটনায় কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। তবুও সরকারের ওপর দায় চাপিয়ে অনেকে পরোক্ষভাবে চ্যানেলগুলোর অন্যায় চাকুরিচ্যুতিকে ন্যায্যতা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন, যা অনাকাঙ্ক্ষিত।’
বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস উপলক্ষে শুক্রবার (২ মে) সকালে চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের জুলাই বিপ্লব স্মৃতি হলে আয়োজিত এক আলোচনা সভায় তিনি এসব কথা বলেন।
চট্টগ্রাম প্রেসক্লাব ও চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন সাংবাদিক ইউনিয়ন আয়োজিত ‘জুলাই বিপ্লব-পরবর্তী বাংলাদেশ: গণমাধ্যমের চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক আলোচনা সভায় ধারণাপত্র উপস্থাপন করেন তিনি।
উপ-প্রেস সচিব বলেন, ‘সাম্প্রতিক একটি ঘটনায় আপনারা দেখেছেন, তিনটি পৃথক টেলিভিশন চ্যানেলের তিনজন সাংবাদিক চাকুরিচ্যুত হয়েছেন। একটি চ্যানেল অল্প কিছু সময়ের জন্য তাদের সংবাদ প্রচার বন্ধ রেখেছে। যদিও কোনো চ্যানেলেই এসবের আনুষ্ঠানিক কোনো কারণ জানায়নি।’
‘সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকেই এ ঘটনায় সরকারকে দায়ী করে বক্তব্য দিয়েছেন। আমরা মনে করি, এই ঘটনায় সরকারকে দায়ী করা অনভিপ্রেত।’
তিনি বলেন, ‘সরকারের কোনো কর্তৃপক্ষ চ্যানেলেগুলোকে তাদের সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ করেনি। এই ঘটনার এক দিন আগে ওই তিন সাংবাদিক একজন উপদেষ্টাকে এমন কিছু প্রশ্ন করেছেন যা অনেকের কাছেই মনে হয়েছে উদ্দেশ্যমূলক। এসব প্রশ্নের জবাব সংবাদ সম্মেলনেই দেওয়ার চেষ্টা করেছেন উপদেষ্টা মোস্তফা সরওয়ার ফারুকি।’
‘সংবাদ সম্মেলনের পর সরকার এ ঘটনায় কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। তবুও সরকারের ওপর দায় চাপিয়ে অনেকে পরোক্ষভাবে চ্যানেলগুলোর অন্যায় চাকুরিচ্যুতিকে ন্যায্যতা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন, যা অনাকাঙ্ক্ষিত। সরকারের পক্ষে এই চাকুরিচ্যুতিকে ঠেকানো সম্ভব ছিল না, কেননা চ্যানেলগুলো সিদ্ধান্ত নিয়েছে স্বাধীনভাবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘এটিকে সেলফ সেন্সরশিপের সংজ্ঞায়ও ফেলা কঠিন। কারণ যে ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে এই পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে, তা ইতোমধ্যে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। উপদেষ্টা মোস্তফা সরওয়ার ফারুকিকে করা তিন সাংবাদিকের প্রশ্নের ন্যায্যতা-অন্যায্যতা বিচারের সুযোগ গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের সুবাদে সবাই পাচ্ছেন।’
আরও পড়ুন: আমাকে প্রশ্ন করায় সাংবাদিকদের চাকরি গেছে, এটি হাস্যকর: ফারুকী
আজাদ মজুমদার বলেন, ‘রাষ্ট্র বা অন্যান্য শক্তিশালী সত্তা বা ব্যক্তির কাছ থেকে প্রভাব বা প্রতিশোধের ভয় ছাড়াই যদি একজন সাংবাদিক তথ্য সরবরাহ করতে পারেন, তবেই তাকে আমরা বলতে পারি মুক্ত সাংবাদিকতা। শক্তিশালী গণতান্ত্রিক পরিবেশের জন্য এই মুক্ত বা স্বাধীন সাংবাদিকতা অপরিহার্য একটি বিষয়। মুক্ত সাংবাদিকতার পরিবেশটি হবে এমন যেখানে একজন সাংবাদিক সহজেই ক্ষমতাকে—সেটি হোক সরকার কিংবা রাজনৈতিক দল—প্রশ্ন করতে পারবেন এবং কারো দ্বারা ব্যবহৃত হবেন না।’
‘তিনি যে তথ্য সংগ্রহ, বিশ্লেষণ ও প্রচার করবেন, তা কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তি বা গোষ্টি স্বার্থে ব্যবহার করা হবেনা না—এটা নিশ্চিত করতে পারা সাংবাদিকের নৈতিক কর্তব্য।’
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে এখন সাংবাদিকতা কতটা মুক্ত এই প্রশ্ন অনেকের মনেই আছে। সরকারের দায়িত্বশীল পদে থেকে এই প্রশ্নের জবাব দেওয়া সহজ কোনো বিষয় নয়। একটি দেশ, যেখানে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নকে পেশাদারত্বের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে টানা দেড় দশক, সেখানে যখনই আপনি মুক্ত সাংবাদিকতার পরিবেশ নিশ্চিত করতে যাবেন, তখনই একদল সুযোগসন্ধানী মানুষ এই যাত্রাকে নানা উপায়ে ভেস্তে দিতে চাইবে। তাই সাংবাদিকতাসহ গণতান্ত্রিক সকল প্রতিষ্ঠান ভেঙে পড়া একটি দেশে চাইলেও রাতারাতি মুক্ত সাংবাদিকতার পরিবেশ শতভাগ নিশ্চিত করা সম্ভব নয়।’
মুক্ত সাংবাদিকতার পরিবেশ সৃষ্টি করার ক্ষেত্রে সরকারের বাইরেও প্রতিষ্ঠানের মালিক ও রাজনৈতিক অংশীজনদের একটি বড় ভূমিকা আছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘অতীত ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, মুক্ত সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে প্রথম এবং সবচাইতে বড় বাধা হিসেবে কাজ করেছে সরকারই। জুলাই-আগস্ট গণবিপ্লবের পর গঠিত অন্তবর্তীকালীন সরকার এইসব বাধা অপসারণের নানা উদ্যোগ নিয়েছে। সরকার সমালোচনাকে উন্মুক্ত করে দিয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে সবাইকে মন খুলে সরকারের সমালোচনা করার আহ্বান জানিয়েছেন; সমালোচনা হচ্ছেও। এমনকি রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমেও সরকারের সমালোচনা করে দেদারসে বক্তব্য দেওয়া হচ্ছে, নিকট অতীতে যা ছিল অকল্পনীয় বিষয়।’
‘বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলের আলোচনা অনুষ্ঠানগুলোতে দেখা গেছে, অনেককেই শালীন-অশালীন নানা ভাষায় সরকার প্রধানকে আক্রমণ করেছেন। কিন্তু এসব সমালোচনার কারণে সরকার কোনো আলোচক বা চ্যানেলের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। গোয়ন্দো সংস্থার কেউ কোনো চ্যানেলের ব্যবস্থাপককে ফোন করে হুমকি দেয়নি।’
আরও পড়ুন: সাংবাদিকতার দায়িত্ব ও নৈতিকতাবিষয়ক আইন হওয়া প্রয়োজন: তথ্য উপদেষ্টা
উপ-প্রেস সচিব বলেন, ‘বিগত বছরগুলোতে সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে একটা বড় প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করেছে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট, যা জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে সমালোচনার পর কোনো ধরনের মৌলিক পরিবর্তন ছাড়াই সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্ট নামে আবির্ভূত হয়েছে। অন্তবর্তীকালীন সরকার এই সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্ট বাতিলের নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই আইনের অধীনে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে করা সব মামলা বাতিল করা হয়েছে। নতুন করে আর কোনো সাংবাদিকের বিরুদ্ধে কোনো মামলা এই আইনে করা হয়নি। আমরা আশা করছি আগামী সপ্তাহে উপদেষ্টা পরিষদের সভায় নতুন সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্ট অনুমোদিত হয়ে যাবে।’
তিনি জানান, প্রস্তাবিত নতুন আইনে, আগের আইনের নিবর্তনমূলক ৯টি ধারা বাদ দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। আগের আইনের আওতায় করা ৯৫ শতাংশ মামলাই এসব ধারায় করা। ধারাগুলো বাতিল হলে এসব ধারায় করা কোনো মামলা থেকে গেলেও তা সয়ংক্রিয়ভাবে খারিজ হয়ে যাবে। প্রস্তাবিত নতুন আইনে গুরুতর সাইবার হ্যাকিং ছাড়া অন্যান্য অপরাধের ক্ষেত্রে পরোয়ানা ছাড়াই গ্রেপ্তারের বিধান বাতিল করা হচ্ছে। অন্তবর্তীকালীন সরকার বিশ্বাস করে নতুন এই আইন প্রণয়ন করা হলে দেশে সাংবাদিকদের আইনের মাধ্যমে হয়রানি অনেকটাই কমে আসবে। দেশে মুক্ত সাংবাদিকতার পরিবেশ সৃষ্টির ক্ষেত্রে এটি হবে একটি বড় অগ্রগতি।
সাংবাদিকের অ্যাক্রেডিটেশন কার্ড বাতিলের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর ১৬৮ জন সাংবাদিকের অ্যাক্রেডিটেশন কার্ড বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অনেকেই সরকারের এই সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেছেন। যদিও অ্যাক্রেডিটেশন কার্ড বাতিল এবং ইস্যু একটি নিয়মিত বিষয়। সাংবাদিকদের জন্য অ্যাক্রেডিটেশন কার্ড প্রথা চালু করার পর ৭ হাজার ৮৬৬টি অ্যাক্রেডিটেশন কার্ড ইস্যু করা হয়েছে। এর মধ্যে বিভিন্ন সময়ে নানা কারণে বাতিল হয়ে গেছে ৪ হাজার ৯৩৫টি কার্ড। তবু এই বিষয়টিতে সরকারের সমালোচনা হওয়ায় সরকার এটি পর্যালোচনা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।’
‘যাদের কার্ড বাতিল হয়েছে তাদের আবার আপিল করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, মাত্র সাত জন আপিলের মাধ্যমে তাদের কার্ড ফেরত চেয়েছেন। সচিবালয়ে অগ্নি দুর্ঘটনার পর অ্যাক্রেডিটেশন কার্ড ব্যবহার করে সচিবালয়ে প্রবেশাধিকার সীমিত করা হলে, সাংবাদিকদের বিশেষ পাশ ইস্যু করে সেখানে প্রবেশ করার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে।’
‘ইতোমধ্যে প্রায় ৫৭০জন সাংবাদিকের জন্য এ ধরনের পাশ ইস্যু করা হয়েছে। অতীতে অনেক দলীয় কর্মীদেরও অ্যাক্রেডিটেশন কার্ড দেওয়া হয়েছিল। যার ফলে সচিবালয়ে সাংবাদিক নামধারী কিছু দালালের দৌরাত্ম্যে পেশাদার সাংবাদিকদের কাজ করাই কঠিন হয়ে পড়েছিল। এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণের উপায় হিসেবে সরকার নতুন করে সবার জন্য অ্যাক্রেডিটেশন কার্ড প্রণয়নের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘জুলাই-আগস্টের আন্দোলনের সময় তাদের ভূমিকার কারণে গত আট মাসে অনেক সাংবাদিককে দেশের বিভিন্ন এলাকায় হত্যা মামলায় অভিযুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু আপনারা জেনে থাকবেন এসব মামলা একটিও সরকারের কোনো কর্তৃপক্ষ দায়ের করেনি। কোনো ঘটনায় সংক্ষুদ্ধ কোনো পক্ষ মামলা দায়ের করলে তা গ্রহণে পুলিশের আইনি বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে পুলিশকে পরিষ্কার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে তদন্ত কালে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ না পাওয়া গেলে কোনো সাংবাদিককে যেন গ্রেপ্তার বা হয়রানি না করা হয়।’
‘মামলার অভিযোগগুলো পর্যালোচনার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে উচ্চ পর্যায়ের একটি কমিটিও করে দেওয়া হয়েছে, যাতে তারা সরকারকে প্রয়োজনীয় সুপারিশ করতে পারেন।’
এছাড়া, চারজন সাংবাদিক এই মুহূর্তে কারাবন্দি রয়েছেন যাদের বিরুদ্ধে গণহত্যায় প্ররোচনা দেওয়ার সরাসরি অভিযোগ রয়েছে। আদালত চাইলে তাদের বিষয়েও যেকোনো সিদ্ধান্ত দিতে পারেন বলেও জানান তিনি।
তিনি বলেন, ‘দুর্নীতি, অন্যায় ও অপশাসন প্রতিরোধে জনগণের তথ্য জানার অধিকার প্রয়োজনীয় অনুষঙ্গ। বর্তমান অন্তর্বর্তীকলীন সরকার শুরু থেকেই মানুষের এই অধিকারের ব্যাপারে সচেতন। তবে সরকার সবসময় আশা করে, গণমাধ্যমগুলোও এ ব্যাপারে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করবে।’
২১৭ দিন আগে
এক প্রতিবেশীকে খুশি রাখতে অন্যের সঙ্গে দূরত্ব পররাষ্ট্রনীতি হতে পারে না: উপ-প্রেস সচিব
প্রধান উপদেষ্টার উপ-প্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ মজুমদার বলেছেন, ঐতিহাসিক অমীমাংসিত ইস্যুগুলো সমাধানের সবচেয়ে ভালো বিকল্প অবশ্যই আলোচনা, আর ঠিক সেটিই করার চেষ্টা করছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।
পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে ওঠা প্রশ্নের ব্যাখ্যায় শুক্রবার (১৮ এপ্রিল) নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক আইডিতে এক দীর্ঘ পোস্টে তিনি এ কথা বলেন।
আবুল কালাম আজাদ লিখেছেন, ‘প্রাক্তন শত্রুদের মিত্রে পরিণত হওয়ার বহু দৃষ্টান্ত আছে। ফ্রান্স ও ইংল্যান্ড শত শত বছর ধরে অসংখ্য যুদ্ধ করলেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে তারা একসঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে লড়েছে। একই যুদ্ধে আমেরিকা জাপানে বোমা মেরেছিল; কিন্তু পরে দেশটিকে মিত্রে পরিণত করে।’
‘সেদিন এক সাংবাদিক প্রশ্ন করলেন, বাংলাদেশ কি তার পররাষ্ট্রনীতি পরিবর্তন করে পাকিস্তানপন্থী হচ্ছে? এতে আমরা মোটেও অবাক হইনি। সবসময়ই কিছু মানুষ থাকবে, যারা বাংলাদেশের স্বাধীন পরিচয়ে বিশ্বাস করতে চাইবে না।’
তিনি বলেন, ‘দেশের পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে অতীতে যা-ই হয়ে থাকুক না কেন, এখন থেকে আমাদের পররাষ্ট্রনীতি হবে বাংলাদেশকেন্দ্রিক, যা আমাদের নিজেদের স্বার্থেই পরিচালিত হবে। এক প্রতিবেশীকে খুশি রাখতে গিয়ে আরেক প্রতিবেশী থেকে দূরত্ব বজায় রাখা—এটা কোনো স্বাধীন দেশের পররাষ্ট্রনীতি হতে পারে না।’
উপ-প্রেস সচিব বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকারের ২৪ ঘণ্টারও কম সময় লেগেছে পাকিস্তানের সফররত পররাষ্ট্রসচিব আমনা বালুচকে দুই দেশের মধ্যে অমীমাংসিত বিষয়গুলো স্মরণ করিয়ে দিতে এবং একই সঙ্গে পারস্পরিক সুবিধার জন্য একসঙ্গে কাজ করতে সম্মত হতে।’
তার মতে, ‘বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি আবেগঘন সমস্যা হলো, বাংলাদেশ চায় ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর চালানো গণহত্যা ও নৃশংসতার জন্য পাকিস্তান ক্ষমা প্রার্থনা করুক।’
‘এমনকি পাকিস্তানের সুশীল সমাজ, মিডিয়া এবং বুদ্ধিজীবীদের অনেকেই বিশ্বাস করেন যে এই ক্ষমা চাওয়াটা হবে সদিচ্ছা ও সৌজন্যের বহিঃপ্রকাশ। তবে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র দপ্তর এবং সামরিক আমলাতন্ত্র সব সময়ই এ ধরনের ধারণার বিরোধিতা করেছিল এবং তাই কখনো আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চায়নি পাকিস্তান।’
বাংলাদেশ পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পদ বিভাজনের বিষয়টিও জোরালোভাবে উত্থাপন করেছে উল্লেখ করে তিনি লিখেছেন, ‘যা অতীতের সরকারগুলোর কাছে একপ্রকার ভুলে যাওয়া বিষয় ছিল, কারণ তারা আলোচনা নয়, বিচ্ছিন্নতাকেই বেশি প্রাধান্য দিয়েছিল।’
বিষয়টির ব্যাখ্যা করেছেন তিনি এভাবে, ‘১৯৭৪ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ কমপক্ষে ৪.৩২ বিলিয়ন ডলারের দাবি করতে পারে। অভ্যন্তরীণ মূলধন সৃষ্টি, বৈদেশিক ঋণ নিষ্পত্তি ও বৈদেশিক আর্থিক সম্পদের মালিকানা ধরে রাখার ভিত্তিতে এই হিসাব করা হয়েছে।’
‘বাংলাদেশের প্রায় ২০০ মিলিয়ন ডলারের আরও একটি দাবি আছে, ১৯৭০ সালের নভেম্বরে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ঘূর্ণিঝড়-দুর্গতদের জন্য বিভিন্ন বিদেশি দেশ ও সংস্থা অনুদান হিসেবে এই অর্থ দিয়েছিল। এই টাকা তখন ঢাকায় পাকিস্তান স্টেট ব্যাংকের দপ্তরে জমা ছিল, যা ১৯৭১ সালে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে স্থানান্তর করে পাকিস্তান স্টেট ব্যাংকের লাহোর শাখায় পাঠানো হয়।
তার মতে, ‘দুই দেশের সম্পর্কের প্রতিবন্ধকতার আরেকটি বড় বিষয় হলো, (বাংলাদেশে) আটকে পড়া পাকিস্তানিদের প্রত্যাবাসন। অতীতে পাকিস্তান মাত্র ১ লাখ ২৫ হাজার নাগরিককে ফেরত নিয়েছে। অথচ এখনও প্রায় ৩ লাখ ২৫ হাজার মানুষ বাংলাদেশের ১৪টি জেলার ৭৯টি ক্যাম্পে বসবাস করছে।’
এই বিষয়গুলোই দুই দেশের মধ্যে একটি সুস্থ ও ভবিষ্যৎমুখী দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক গড়ে তোলার পথে দীর্ঘদিন ধরে বাধা হিসেবে রয়ে গেছে বলে মন্তব্য করে তিনি জানিয়েছেন, এই সমস্যাগুলোর সমাধানের সবচেয়ে ভালো উপায় নিঃসন্দেহে আলোচনা—আর অন্তর্বর্তী সরকার ঠিক এটিই করার চেষ্টা করছে।
তিনি আরও বলেন, ‘অনেক বছর পর পাকিস্তানকে আলোচনার টেবিলে আনা হয়েছে এবং আলোচনার সময় যথাযথভাবে এই বিষয়গুলো তুলে ধরা হয়েছে। একই সঙ্গে পারস্পরিক সুবিধার জন্য বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সম্ভাবনাও অনুসন্ধান করা হচ্ছে।’
উপ-প্রেস সচিব স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস চলতি বছরের শুরুতে মিসরে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফের সঙ্গে বৈঠকে দ্বিপাক্ষিক অমীমাংসিত বিষয়গুলো সমাধানের প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করেছিলেন এবং বৃহস্পতিবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় আমনা বালুচের সঙ্গে বৈঠকের সময় তিনি আবারও সেই আহ্বান পুনর্ব্যক্ত করেন।’
‘তবে একই বৈঠকে অধ্যাপক ইউনূস জোর দিয়ে বলেন, এই অঞ্চলের বিশাল অর্থনৈতিক সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে পাকিস্তানসহ প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে একটি দৃঢ় সম্পর্ক গড়ে তোলার প্রয়োজন আছে।’
‘সম্ভবত এখনই সময়, ভবিষ্যতের স্বার্থে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের অতীতের বিষয়গুলো নিরসন করে একসঙ্গে কাজ করার,’ বলেন তিনি।
২৩১ দিন আগে