গুজব প্রতিরোধ
৪ আগস্ট রাতে যেভাবে গুজব রুখে দিয়েছিল একটি ছবি
২০২৪ সালের ঐতিহাসিক জুলাই গণঅভ্যুত্থান ছিল প্রথমে কোটা সংস্কারের আন্দোলন। কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে ধাপে ধাপে এ আন্দোলন গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয়। দেশের কৃষক, শ্রমিক, শিক্ষার্থীসহ সর্বস্তরের মানুষের অভিন্ন আন্দোলনে পরিণত হয় এটি।
তবে এই আন্দোলন রুখতে তৎকালীন ক্ষমতাসীনদের চেষ্টার কমতি ছিল না। শুধু তা-ই নয়, আন্দোলন যতটা খাটো করে বিশ্বমঞ্চে উপস্থাপন করা যায়, তার প্রচেষ্টাও ছিল অবিরত। একটা পর্যায় থেকে তো ইন্টারনেট সেবাই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল।
আন্দোলনের সেই সময়টায় ছাত্রজনতাকে বিভ্রান্ত করতে তৎকালীন সরকারপক্ষের একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হয়ে উঠেছিল গুজব। ৫ আগস্ট আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ নেওয়ার আগের রাতে, অর্থাৎ ৪ আগস্ট রাতে তেমনভাবেই আরও একবার গুজব ছড়িয়ে শিক্ষার্থীদের বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করা হয়েছিল। তবে একটি ছবি সেই সময় গুজবের বিরুদ্ধে হাতিয়ার হয়ে উঠেছিল।
সেদিন রাতে আমরা কয়েকজন সাংবাদিক বন্ধু মিলে তোলা একটি ছবি তাই আজ হয়ে গিয়েছে ইতিহাসের অংশ।
গণঅভ্যুত্থান চলাকালে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করা আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন সাংবাদিক টিএসসির অতিথি কক্ষে অবস্থান নিয়ে সারা দেশে মানুষের কাছে ন্যায় ও নিষ্ঠার সঙ্গে সংবাদ পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টায় ব্রতী ছিলাম।
এর মাঝে ৩ আগস্ট শহীদ মিনারে সরকার পতনের এক দফা ঘোষণা করা হয়। তখন থেকে আমাদের ব্যস্ততা আরও বেড়ে যায়। পরের দিন ৪ আগস্ট সারা দিনের প্রোগ্রাম কভার করে রাতে ক্লান্ত শরীরে গিয়েছিলাম বিশ্রাম নিতে। এ সময় ফেসবুক স্ক্রল করতে গিয়ে দেখি, আওয়ামী লীগ–ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের গুজবমূলক পোস্টে সয়লাব ফেসবুকের ফিড।
সেসবের মধ্যে অন্যতম ছিল— সারা দেশ থেকে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের লাখ লাখ নেতাকর্মী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার রাজু ভাস্কর্য, টিএসসি ও শাহবাগে অবস্থান নিয়ে পুরো এলাকার দখল নিয়েছে। ওই দাবির সত্যতা প্রমাণে পুরনো একটি ভিডিও শেয়ার করে তারা, যার শিরোনাম ছিল, ‘৭ মিনিটে টিএসসি-শাহবাগ দখল।’
এসব ভিডিও দেখে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পরিচিত ও শুভাকাঙ্ক্ষীরা ফোন দিয়ে ঘটনার সত্যতা জানতে চান। দীর্ঘ সময় ধরে স্বৈরাচারের শাসনে অতিষ্ট এসব মানুষের মনে মুক্তির যে সম্ভাবনার কুঁড়ি পাপড়ি মেলতে শুরু করেছিল, তা বিনষ্ট হয়ে যাওয়ার ভয়েই একের পর এক ফোন দিচ্ছিলেন নানাজন।
অথচ, সারা দিন বাইরে ঘুরে সন্ধ্যা পেরিয়ে রাতে হোস্টেলের কক্ষে ফেরার আগে আমি যা দেখেছি, সেই সত্যের পুরোপুরি বিপরীত ছিল উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ওইসব পোস্ট ও ভিডিও। পুরো বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় সেই রাতে কোনো মানুষ ছিল না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতায় ছিল পিনপতন নীরবতা।
ফলে এমন একটি আন্দোলন গুজবে বিভ্রান্ত হয়ে তার পথ হারাবে, গতি হারাবে, তা মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছিল ভীষণ। তাই সহকর্মী-বন্ধুদের সঙ্গে সঙ্গে বিষয়টি জানাই এবং এ বিষয়ে মানুষকে সতর্ক করার বিষয়টি আমাদের আলোচনায় উঠে আসে। আমরা সিদ্ধান্ত নিই, ফেসবুকের ওই গুজবকে উন্মোচন করে আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগের ষড়যন্ত্র রুখে দেব।
এরপর আজকের পত্রিকার ঢাবি প্রতিনিধি ছিদ্দিক ফারুক, দৈনিক সমকালের বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি যোবায়ের আহমদ, দৈনিক নয়া দিগন্তের হাসান আলী, আমাদের সময়ের আশিকুল হক রিফাত, ইত্তেফাক পত্রিকার নেসার উদ্দিনকে সঙ্গে নিয়ে আমি টিএসসিতে আসি। এরপর দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসের প্রতিনিধি জোবায়ের হোসেনের তোলা ছবিটি আমরা নিজেদের প্রোফাইল থেকে শেয়ার করি। সেইসঙ্গে লিখে দিই, আমরা ছাড়া টিএসসিতে আর কেউ নেই। পাশাপাশি, কেউ যেন গুজবে বিভ্রান্ত না হয়, সেই আহ্বান জানাই।
মুহূর্তের মধ্যে ছবিটি ভাইরাল হয়ে যায়। বিভিন্ন গ্রুপ, পেজ ও প্রোফাইলে ছবি ছড়িয়ে যায়। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমেও এ নিয়ে খবর বের হয়।
আমাদের ওই ছবিটি শেয়ার করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা দেশের সকল স্তরের মানুষকে ভয় না পেয়ে রাস্তায় নেমে আসার ঘোষণা দেন।
ফেসবুকে এ ছবি দেওয়ার পর বিভিন্নজনের কাছ থেকে সাধুবাদ পেলেও আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের কাছ থেকে আমরা পাই নানা ধরনের হুমকি। ছবিটি আপলোড করার পর থেকেই গণহারে আমাদের আইডিগুলোকে রিপোর্ট করা শুরু হয়। মৃত্যুর হুমকিসহ অসংখ্য গালাগালপূর্ণ মেসেজে ভরে যায় ইনবক্স।
তবে এতকিছু করেও সত্যকে চাপা দিতে পারেনি তারা। স্বতঃস্ফূর্তভাবে মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। তারপর গণভবন অভিমুখে জনস্রোত শুরু হলে একপর্যায়ে দেশে ছেড়ে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা। এর মাধ্যমে দীর্ঘ ১৭ বছরের স্বৈরাচারী শাসনের অবসান ঘটে।
মুক্তিকামী মানুষের মনোবল জোগাতে আমদের সেই ছবিটি যে একটি মাইলফলক ছিল, গণঅভ্যুত্থানের অংশীদার অনেকেই তা স্বীকার করেন আজও। গণঅভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেওয়া সমন্বয়করা, অংশগ্রহণকারীরা দেখা হলেই ছবিটির প্রসঙ্গ তোলেন; আমাদের উপস্থিত বু্দ্ধির প্রশংসা করেন। নিজেদের আত্মবিশ্বাস ফিরে পাওয়ার গল্প বলেন।
শুধু এই ছবিটি নয়, এমন অনেক ছবি, গল্প ও ভিডিও জুলাই গণঅভ্যুত্থানকে এগিয়ে নিয়েছিল, দিয়েছিল পূর্ণতা।
তবে শহীদদের রেখে যাওয়া আমনত রক্ষা, তাদের আত্মত্যাগের যথাযথ মূল্যায়নই গণঅভ্যুত্থানের সত্যিকারের ফসল ঘরে তুলতে পারার মহৌষধ হিসেবে কাজ করবে। আজ জুলাই অভ্যুত্থানের প্রথম বর্ষপূর্তি উপলক্ষে আমাদের চাওয়াও কেবল সেটিই।
১২১ দিন আগে