দেহাবশেষ সংরক্ষিত
ইসরায়েলে লক্ষ বছরের পুরনো সমাধি আবিষ্কার, প্রাচীন মানুষ দিচ্ছে নতুন ধারণা
সম্প্রতি ইসরায়েলে অবস্থিত একটি গুহায় একটি প্রাচীন সমাধিস্থলের সন্ধান পেয়েছেন প্রত্নতাত্ত্বিকরা। সেখানে প্রায় এক লাখ বছর আগের প্রাচীন মানবজাতির দেহাবশেষ বেশ ভালোভাবে সংরক্ষিত ও সুশৃঙ্খলভাবে সাজিয়ে রাখা হয়েছে বলে দাবি করেছেন তারা।
চলতি বছরের মার্চ মাসে মধ্য ইসরায়েলের টিনশেমেত গুহায় ওই সমাধিস্থানটি আবিষ্কার করা হয়ে বলে নেচার হিউম্যান বিহেভিয়ার নামের একটি জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে।
এই আবিষ্কার প্রাচীন মানুষদের দেহাবশেষ ও কবর নিয়ে চলমান গবেষণাকে আরও সমৃদ্ধ করবে বলে ধারণা করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
প্রত্নতাত্ত্বিকরা জানান, দেহাবশেষের পাশে কিছু বস্তু পাওয়া গেছে। সেগুলো মৃতদের সম্মান জানাতে আচার-অনুষ্ঠানে ব্যবহৃত হয়ে থাকতে পারে বলে ধারণা করছেন তারা।
প্রাচীনকালের মানুষদের আধ্যাত্মিকতা ও পরকাল সম্পর্কে কী ভাবতেন এ ধরনের বস্তু থেকে জানার চেষ্টা করা হতে পারে বলে আশা প্রকাশ করেছেন প্রত্নতাত্ত্বিকরা।
টিনশেমেত গুহার খনন কাজে অংশ নেওয়া জেরুজালেমের হিব্রু ইউনিভার্সিটির প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ইয়োসি জেইডনার বলেন, মানব প্রজাতির জন্য এই কবরস্থান আবিষ্কার একটি অসাধারণ ও বিপ্লবাত্মক উদ্ভাবন।
২০১৬ সাল থেকে টিনশেমেতে কাজ করা প্রত্নতাত্ত্বিকরা বিভিন্ন প্রযুক্তির মাধ্যমে প্রায় ১ লাখ ১০ হাজার থেকে ১ লাখ বছর আগের পাঁচজন প্রাচীন মানবদেহের অবশেষ আবিষ্কার করেছেন।
জেইডনার বলেন, কঙ্কালগুলো গর্তে পাওয়া গেছে। সেগুলো প্রচলিত সমাধিস্থ করার রীতিতে ভ্রূণাকৃতি অবস্থায় সাজানো ছিল। অনেক কঙ্কালের সঙ্গেই ব্যাসল্ট পাথরের নুড়ি, প্রাণীর দেহাবশেষ বা গেরুয়া রঙের খনিজ পদার্থের টুকরো পাওয়া গেছে। এসব খনিজ লৌহসমৃদ্ধ শিলা থেকে তৈরি এক ধরনের লালচে রঞ্জক।
এসব বস্তু প্রাত্যহিক জীবনে ব্যবহার উপযোগী নয়। এগুলো মৃতদের সম্মান জানাতে আচার বা ধর্মীয় অনুষ্ঠানের অংশ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল বলে ধারণা করছেন প্রত্নতাত্ত্বিকরা।
আরও পড়ুন: মাথা-ঘাড়ের ক্যানসারে দ্বিগুণ কার্যকরী ওষুধ আবিষ্কার
কী জানা গেল এই সমাধি থেকে
টিনশেমেত গুহাটি হলো মধ্য ইসরায়েলের পাহাড়ি ঢালের মধ্যে একটি অন্ধকার ফাটলের মতো। গুহাটিতে শোনা যায় অসংখ্য বাদুরের চেঁচামেচি। গুহার ভেতর ও চারপাশে রয়েছে একটি সাধারণ পাথরের ঢিবি। এই গুহাটিকে মানব বিবর্তন ও প্রাগৈতিহাসিক যুগে মানুষের আচরণ বোঝার জন্য বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তিন-চারটি স্থানের একটি বলে অভিহিত করেছেন প্রত্নতত্ত্ববিদ ইয়োসি জেইডনার।
প্রস্তরযুগ হিসেবে পরিচিত প্যালিওলিথিক যুগ শুরু হয়েছিল প্রায় ৩৩ লাখ বছর আগে এবং তা স্থায়ী ছিল আনুমানিক ১০ হাজার বছর আগ পর্যন্ত। টিনশেমেত গুহাটি মধ্য-প্যালিওলিথিক যুগের, যা প্রায় ২ লাখ ৫০ হাজার থেকে ৩০ হাজার বছর আগের সময়কালকে নির্দেশ করে।
ওই গুহায় আবিষ্কারের মধ্যে ছিল পাঁচজন প্রাচীন মানুষের দেহাবশেষ। এর মধ্যে দুটি সম্পূর্ণ কঙ্কাল এবং তিনটি বিচ্ছিন্ন খুলি যেগুলোর সঙ্গে অন্যান্য হাড় ও দাঁতও ছিল।
আরও গুরুত্বপূর্ণ বন্তুর মধ্যে ছিল— বিভিন্ন আকারের শতাধিক লাল ও কমলা রঙের গেরুর টুকরো। সেগুলো লৌহসমৃদ্ধ পাথর যা নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় গরম করে তৈরি রঞ্জক পদার্থ। এটি প্রমাণ করে যে প্রাচীন মানুষেরা অলঙ্কার বা সাজসজ্জার বস্তু তৈরির কৌশল জানত।
জেইডনারের ভাষ্যে, এখানে আমরা মানুষের এমন একটি জটিল আচরণ দেখতে পাচ্ছি যেটি শুধু খাদ্য বা বেঁচে থাকার সঙ্গে সম্পর্কিত নয়।
যুক্তরাষ্ট্রের কনেকটিকাট বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও স্মিথসোনিয়ান ইনস্টিটিউশনের হিউম্যান অরিজিনস প্রোগ্রামের গবেষণা সহযোগী ক্রিশ্চিয়ান ট্রায়ন বলেন, বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলে সময়ের সঙ্গে হারিয়ে গেলেও ইসরায়েলের এই অঞ্চলের জলবায়ুর কারণে টিনশেমেতে হাড়, সরঞ্জাম ও অলংকারের নিখুঁত সংরক্ষণ সম্ভব হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘প্রায়ই জ্বলে ওঠা অগ্নিকুণ্ড থেকে ছড়ানো ছাইয়ের কারণে দেহাবশেষ ও বস্তুগুলো এতো ভালোভাবে সংরক্ষিত হয়েছে।’
‘সম্ভবত ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের জন্য আগুন জ্বালানো হতো। এই বিপুল পরিমাণ ছাই বৃষ্টির পানি এবং ইসরায়েলের অম্লধর্মী চুনাপাথরের সঙ্গে মিশে সংরক্ষণের উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করেছে।’
এক খননকারী জানান, একটি কঙ্কাল এতটাই ভালো অবস্থায় ছিল যে গবেষকেরা দেখতে পেয়েছেন, দুই হাত মাথার নিচে রাখা অবস্থায় আঙুলগুলো কীভাবে একে অপরের ভেতরে গুঁজে রাখা ছিল।
আরও পড়ুন: বানরেরাও অপহরণ করে! বিজ্ঞানীদের অদ্ভুত আবিষ্কার
আগের গবেষণার ভিত্তি মজবুত করেছে এই গবেষণা
টিনশেমেতের আবিষ্কার উত্তর ইসরায়েলের স্কুল গুহা ও কাফজে গুহার আগের আবিষ্কারগুলোকে আরও মজবুত ভিত্তি দিচ্ছে বলে জানান ট্রায়ন। স্কুল গুহা প্রায় ১০০ বছর আগে এবং কাফজে প্রায় ৫০ বছর আগে খনন করা হয়েছিল।
ট্রায়ন বলেন, ‘ওই স্থানগুলো নিয়ে বহু অনিশ্চয়তা ছিল। কিন্তু টিনশেমেত প্রমাণ করছে যে এটি একটি নির্দিষ্ট ধারা এবং গবেষকেরা এখন তারিখ নির্ধারণেও নির্ভুল হতে পারছেন।’
টিনশেমেত প্রত্নতত্ত্ববিদদের ধারণা, ওই সময় মানুষের মধ্যে কবর দেওয়ার রীতি অনেক বেশি ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। তাছাড়া প্রাচীন মানুষ কীভাবে মৃতদের সম্মান জানাতো সেক্ষেত্রে মৌলিক পরিবর্তনেরও ইঙ্গিত পাওয়া যায়।
কিছু প্রত্নতত্ত্ববিদ বিশ্বাস করেন, উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে সমাধি দেওয়ার প্রক্রিয়া আরও আগেই শুরু হয়েছিল। দক্ষিণ আফ্রিকায় হোমো নালেদি নামক এক প্রাচীন মানব প্রজাতি হয়তো ২ লাখ বছর আগেও গুহায় তাদের মৃতদের ইচ্ছাকৃতভাবে দাফন করত।
তবে এই দাবিকে ঘিরে বিতর্ক রয়েছে এবং অনেক গবেষক মনে করেন, এটি প্রমাণ করার মতো যথেষ্ট উপাত্ত এখনও পাওয়া যায়নি।
দুই মহাদেশের সংযোগস্থল ছিল ইসরায়েল
প্রাচীনকালে ইসরায়েল ছিল ইউরোপ থেকে আসা নিয়ান্ডারথাল এবং আফ্রিকা থেকে আসা হোমো সেপিয়েন্স প্রজাতির মানবজাতির মধ্যে এক সেতুবন্ধন। প্রত্নতত্ত্ববিদরা এই অঞ্চলে প্রাচীন মানব প্রজাতির আরও কিছু উপশাখা চিহ্নিত করেছেন। তারা একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ করত এবং এমনকি বিবাহবন্ধনেও আবদ্ধ হতে পারে বলে মনে করেন প্রত্নতত্ত্ববিদরা।
টিনশেমেত থেকে পাওয়া দুটি সম্পূর্ণ কঙ্কালের ওপর গবেষণা বহু বছর ধরেই চলছে। তবে তারা নিয়ান্ডারথাল নাকি হোমো সেপিয়েন্স, নাকি সংকর জনগোষ্ঠী কিংবা একেবারে অন্য কোনো প্রজাতির তা এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
জেইডনার বলেন, এই উপশাখাগুলোর মিশ্রণের ফলে বিভিন্ন মানবগোষ্ঠীর মধ্যে জ্ঞান বিনিময় বা নিজেদের পরিচয় প্রকাশের সুযোগ তৈরি হয়েছিল। এই সময় থেকেই প্রত্নতত্ত্ববিদরা প্রাথমিক অলঙ্কার বা শরীর রাঙানোর প্রমাণ দেখতে শুরু করেন যা সম্ভবত একধরনের সামাজিক চিহ্ন বা গোষ্ঠীভুক্তির ইঙ্গিত, অর্থাৎ ‘আমরা’ বনাম ‘তারা’— এই সীমারেখা তৈরির চিহ্ন।
আরও পড়ুন: গবাদিপশুর ম্যাসটাইটিস ভ্যাক্সিন আবিষ্কার করলেন বাকৃবির অধ্যাপক
ভূমির মালিকানা দাবি
তেল আবিব বিশ্ববিদ্যালয়ের শারীরবৃত্তীয় নৃতত্ত্ববিদ ও টিনশেমেত প্রকল্পের সহ-পরিচালক ইসরায়েল হার্শকোভিৎস বলেন, প্রাগৈতিহাসিক জীবনে সমাধির ধারণাটি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এটি একটি নিজস্ব এলাকাকে বোঝায়।
তিনি বলেন, ‘এই অঞ্চলে আজও পূর্বপুরুষের সমাধি যেখানে রয়েছে, সেই ভূমি নিজেদের দাবি করার ঐতিহ্য আমরা দেখি। এটি প্রতিবেশীদের প্রতি একধরনের বার্তা, ‘এই জমি আমার বাবার, দাদার, তারও আগের প্রজন্মের। অর্থাৎ, আমাদের পূর্বপুরুষদের।’
১২১ দিন আগে