সুন্দরবনকে বাঁচানোর উপায় বরাবরই কেবল কথা নয়, বরং তার চেয়েও বেশি কিছুর দাবি রাখে। এর জন্য প্রয়োজন হয় ঘর্মাক্ত শরীর, ফোসকা পড়া পা ও এমন একগুঁয়েমি, যাতে সূর্যের প্রখর রোদে শরীর পুড়লেও যাত্রা ব্যাহত হবে না; কঠিন পরিস্থিতিতেও চলবে অগ্রযাত্রা।
গত ২৮ থেকে ৩০ মার্চ এমন কিছুই করে দেখিয়ে দিলেন বাংলাদেশে নিযুক্ত নেদারল্যান্ডসের রাষ্ট্রদূত আন্দ্রে কারসটেন্স। কূটনীতির করিডোর ছেড়ে সাইকেলে চেপে তিনি বেরিয়ে পড়েন ধুলি ওড়া, কঠিন পথে। বরিশাল থেকে বাঘের ডেরা সুন্দরবনের জয়মণিতে অবস্থিত ওয়াইল্ডটিমের কনজারভেশন বায়োলজি সেন্টার ‘টাইগারহাউস’ পর্যন্ত ১৬৩ কিলোমিটার পথ সাইকেলে পাড়ি দিয়েছেন এই কূটনীতিক।
ছেলে কারস্টেন্স ইয়াকোবাস হেরমানাস ও দুই বন্ধু নিলস ফন ডেন বের্গে (নেদারল্যান্ডস পার্লামেন্টের সাবেক সদস্য) ও ইয়ংমান কারিনকে সঙ্গে নিয়ে এই যাত্রা করেন তিনি। এ সময় আড়ম্বর করে প্রতিনিধি দল কিংবা গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে নেননি এই কূটনীতিক; এটি ছিল নীরব-নিভৃতে সচেতন এক অভিযাত্রা।
আরও পড়ুন: সিঙ্গাপুর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের এনআইসি সদস্য হলেন এনায়েতউল্লাহ খান
তার এই কর্মকাণ্ড এক যুগ আগের এমনই আরেকটি যাত্রার কথা মনে করিয়ে দেয়। তখন রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণবিদ, কূটনীতিক ও শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন পেশার মানুষের একটি দল দেশজুড়ে রিকশা চালিয়েছিলেন। সেই সময়ের লক্ষ্য ছিল বাঘের অস্তিত্ব সংকটকে জনসমক্ষে তুলে ধরা।
আর এবারের মিশন ছিল সুন্দরবনের হৃদস্পন্দন—এর উত্তাপ, কানাকানি ও নাজুক অস্তিত্বের ভার সরেজমিনে অনুভব করা।
গত ১০ ও ১১ জানুয়ারি ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) প্রতিনিধি দলের উপপ্রধান ড. বেয়ার্ন্ড স্পানিয়েরের সঙ্গে প্রথমবার ওয়াইল্ডটিমস কনজারভেশন বায়োলজি সেন্টার পরিদর্শন করেন কারসটেন্স। এরপর ৮০ দিনেরও কম সময়ের ব্যবধানে তিনি সেখানে ফিরে যান। তবে এবার শুধু রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার, তাদের আবাসস্থল ও স্থানীয় সম্প্রদায়ের বিদ্যমান চ্যালেঞ্জগুলো নিজে অনুভব করে এসব বিষয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিসরে সচেতনতা বৃদ্ধিই ছিল তার লক্ষ্য।
আন্দ্রের মতে, ‘মানুষ ভাবে সুন্দরবন শুধুই একটি বন, কিন্তু সত্যিকার অর্থে এটি বাংলাদেশের শ্বাস-প্রশ্বাস নেওয়া জীবন্ত রক্ষাকবচ। আপনি যখন এর ভেতর দিয়ে সাইকেল চালিয়ে যাবেন, তখন বুঝতে পারবেন—এটি আমাদের কত কিছু দিচ্ছে এবং ঠিক কতটা হারাচ্ছে।’
নিলস ফন ডেন বের্গে নেদারল্যান্ডসের সংসদ সদস্যই শুধু ছিলেন না, ডাচ ওয়াখেনিনগেন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি পরিবেশবিদ হিসেবে স্নাতকও সম্পন্ন করেছেন। বিশ্বব্যাপী বিলুপ্তপ্রায় এই বাঘের একটি উল্লেখযোগ্য অংশের আবাসস্থল বাংলাদেশের সুন্দরবন বলে উল্লেখ করেন তিনি।
বের্গে বলেন, ‘ঘনবসতিপূর্ণ এই দেশটি যেভাবে এই বনটিকে আগলে রেখেছে, তা দেখে আমি অভিভূত। ওয়াইল্ডটিমের মতো সংস্থা ও কমিউনিটি—যারা এটি সম্ভব করেছে, তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা।’
‘আমার প্রিয় লেখক অমিতাভ ঘোষের ‘হাংরি টাইডের’ এই ভূখণ্ডে এটি আমার তৃতীয় ভ্রমণ। অর্থাৎ তৃতীয়বারের মতো আমি সুন্দরবন এসেছি। কিন্তু সাইকেল চালিয়ে এটিই আমার প্রথম সুন্দরবন ভ্রমণের অভিজ্ঞতা। অসাধারণ এক যাত্রা ছিল এটি। যেখানেই গিয়েছি, সেখান থেকেই সহযোগিতা পেয়েছি। গ্রামের ছেলেরা সরু অস্থায়ী সেতুর ওপর দিয়ে সাইকেল নিয়ে যেতে আমাদের সহযোগিতা করেছে। এর সঙ্গে ছিল রেস্তোরাঁয় বিনামূল্যের চা ও চমৎকার সব আড্ডা,’ বলেন তিনি।
‘দ্য হাংরি টাইড’ ভারতীয় লেখক অমিতাভ ঘোষের চতুর্থ উপন্যাস। সুন্দরবনের প্রেক্ষাপটে এটি লেখেন তিনি। কথা সাহিত্যের জন্য ২০০৪ সালে ‘হাচ ক্রসওয়ার্ড বুক অ্যাওয়ার্ডে’ ভূষিত হয় বইটি।
আরও পড়ুন: ওএএনএ সাধারণ অধিবেশনে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করলেন এনায়েতউল্লাহ খান
টাইগারহাউসে সাইক্লিস্টরা পৌঁছানোর পর পুরোনো বন্ধুদের মতো সম্ভাষণ জানান টাইগারস্কাউটরা—স্থানীয় তরুণ সংরক্ষণবাদী, যারা সচেতনতা বৃদ্ধিতে কাজ করে থাকেন। এছাড়া ভিলেজ টাইগার রেসপন্স টিমও (ভিটিআরটি) তাদের স্বাগত জানায়। মানুষ ও বাঘের সংঘাত নিরসনে কাজ করতে এই টিমকে প্রশিক্ষণ দেয় ওয়াইল্ডটিম।
এই কেন্দ্রটি আইইউসিএনের সমন্বিত বাঘের আবাসস্থল সংরক্ষণ কর্মসূচির (আইটিএইচসিপি) অধীনে ওয়াইল্ডটিমের কাজের প্রাণকেন্দ্র। জার্মানি ও কেএফডব্লিউ উন্নয়ন ব্যাংকের সহযোগিতায় এটি পরিচালিত হয়। এটি এমন একটি কেন্দ্রস্থল যেখানে বিজ্ঞানের সঙ্গে টিকে থাকার লড়াইয়ের মিলন ঘটে।