জালের মতো অলিগলিতে পরিপূর্ণ ঢাকা বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহরের একটি। উন্নয়নের জোয়ারে দূষণে হাবুডুবু খাচ্ছে এই নগরীর বাসিন্দারা। কবে যে সতেজ বাতাসে তারা প্রাণভরে শ্বাস নিয়েছেন, অনেকেই তা ইয়াদ করতে পারবেন না। এর ফলে শহরে প্রাণঘাতী বিভিন্ন রোগ বাড়ছে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
ঢাকায় লাখো প্রাইভেটকার, বাস, মোটরসাইকেল, সিএনজি, অটোরিকশা, ভ্যান ও ডবল ডেকার বাসসহ হরেক রকমের গাড়ি প্রতিটি মুহূর্তে সামনে এগিয়ে যাওয়ার প্রতিযোগিতায় ব্যস্ত। এসব গাড়ি থেকে কালো মেঘের মতো বেরিয়ে আসে ধোঁয়া।
এর পাশাপাশি নির্মাণকাজ, ইটভাটা ও কলকারখানার দূষণ ঢাকার বাতাসকে আরও অস্বাস্থ্যকর করে তুলেছে। এসবের সঙ্গে এসে মিশছে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর দূষিত বায়ু।
বাংলাদেশের মোট বায়ুদূষণের ৩৫ শতাংশই আশপাশের দেশগুলো থেকে আসছে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু আন্তঃদেশীয় এই দূষণ রোধে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যাচ্ছে না।
সব মিলিয়ে ঢাকায় এমন এক পরিবেশ তৈরি হয়েছে, যা বাসিন্দাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ভয়াবহ হয়ে উঠছে।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ শহরের একটিতে রূপান্তরিত হয় ঢাকা। বর্তমানে এই শহরে গড় গাড়ি চালানোর গতি ঘণ্টায় সাড়ে চার কিলোমিটার, যা মানুষের হাঁটার গতির কাছাকাছি।
বায়ুমান সূচক (একিউআই) অনুসারে, ঢাকার বাতাস সবসময়ই বিশ্বের সবচেয়ে অস্বাস্থ্যকর তালিকার উপরের দিকে থাকে। কখনও কখনও তা ঝুঁকিপূর্ণও হয়ে ওঠে।
এই প্রতিবেদন লেখার সময় বুধবার (১৯ ফেব্রুয়ারি) রাত ৯টায় ২০৯ একিউআই স্কোর নিয়ে বিশ্বের দূষিত শহরগুলোর শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশের রাজধানী। শুধু তা-ই নয়, দূষণের স্কোরে ডবল সেঞ্চুরি পার করেছে বিশ্বের একটিমাত্র শহর—ঢাকা। ঢাকার এই বাতাস নাগরিকদের জন্য ‘খুবই অস্বাস্থ্যকর’।
দূষণ-সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে গবেষণা প্রতিষ্ঠান ক্যাপসের এক জরিপে দেখা গেছে, ডিসেম্বরে বায়ুদূষণের যে সার্বিক অবস্থা ছিল, তা গত ৯ বছরে সর্বোচ্চ। আবার এ বছরের জানুয়ারিতে দূষণের মান ছিল ৯ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। ঢাকায় জানুয়ারিতে একাধিক দিন বায়ুদূষণের মান ৩০০-এর বেশি হয়েছে।
২০২৩ সালে বাংলাদেশে পিএম ২.৫ মাইক্রোনের গড় ঘনত্ব ছিল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) বার্ষিক বায়ুমান নির্দেশনার চেয়ে ১৬ গুণ বেশি।
আন্তঃদেশীয় বায়ুদূষণ কী?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. আবদুস সালাম জানান, সীমান্ত পাড়ি দিয়ে পার্শ্ববর্তী দেশগুলো থেকে যে দূষণ বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়ে এবং বিপরীতে বাংলাদেশ থেকে সেইসব দেশে যে দূষণ যায়, সেটিই হচ্ছে আন্তঃদেশীয় বায়ুদূষণ।
আন্তঃসীমান্ত দূষণের বিবরণ দিয়ে তিনি বলেন, ‘হিমালয় থেকে, আবার ভারত, পাকিস্তান, নেপাল ও চীনের একটি অংশ থেকে দূষণ বাংলাদেশে আসে। এতে পুরো বাংলাদেশের ওপর দূষণ ছড়িয়ে পড়ে। শীতকালে এটা বেশি আসে।’
ড. আবদুস সালাম বলেন, ‘পার্টিকেল যত ফাইনেস্ট (সূক্ষ্ম) হবে, তত বেশি সময় ধরে তা বাতাসে ভেসে বেড়াতে ও দ্রুত ভ্রমণ করতে পারবে।’
গত ২৫ বছর ধরে বায়ুদূষণ নিয়ে গবেষণা করে আসছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের এই অধ্যাপক।
তিনি আরও বলেন, ‘শীতকালে প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে এ দূষণ বাংলাদেশে আসে। বর্ষাকালে কিছু জিনিস বাংলাদেশ থেকে ভারতে যায়। বাংলাদেশে যদি ১০০ শতাংশ বায়ুদূষণ থাকে, তার ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ আসে বাইরের দেশ থেকে।’
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আইনুন নিশাত বলেন, ‘বাতাসের যে গতিবেগ, তাতে ভারত থেকে দূষণ আসাটা স্বাভাবিক। একসময় উত্তর দিক থেকে, আবার একসময় দক্ষিণ দিক থেকে বাতাস (বাংলাদেশে) আসে। এই প্রক্রিয়ায় দক্ষিণ-পশ্চিম, উত্তর-পূর্ব দিক থেকেও বাংলাদেশের ওপর দিয়ে বাতাস প্রবাহিত হয়। এই সময়ে আমাদের পাশের দেশ ভারতের দূষিত বায়ুর কিছু অংশ আমাদের এখানে আসে।’
তিনি বলেন, ‘এটা আসে প্রাকৃতিকভাবে, তারা যে জোর করে দূষণ পাঠায়—এমন না। এ অঞ্চলের সবাই যদি বায়ুদূষণ রোধ করে, তাহলে স্বাভাবিকভাবেই সব ঠিক হয়ে যাবে।’
রাস্তার ধুলা বায়ুদূষণ নয়!
অধ্যাপক আব্দুস সালাম বলেন, ‘অনেকে মনে করেন, রাস্তার ধুলাই বায়ুদূষণ, কিন্তু সেটা ঠিক নয়। রাস্তার ধুলা বেড়ে যাওয়া কিংবা কমে যাওয়া বায়ুদূষণ নয়। রাস্তার ধুলা বড় বড় পার্টিকেল (কণা), এগুলো নাকের ভেতরে ঢুকতে পারে না। যেগুলো নাকের মধ্যে ঢুকতে পারে না, সেগুলো মানুষের কোনো ক্ষতি করে না।’
বিষয়টি ব্যাখ্যা করেন তিনি এভাবে, ‘পার্টিকেলের (কণা) আকার যত ক্ষুদ্র হবে, সেটা ততই ক্ষতিকর হবে। বড় পার্টিকেলগুলো নাকের মধ্যে ঢোকে না, যে কারণে মানুষের তত ক্ষতি করে না। রাস্তার ধুলা পাবলিক ন্যুইসন্স (অস্বস্তি) তৈরি করে মাত্র, এটা সত্যিকারের বায়ুদূষণ নয়।’
তার মতে, বাতাসের মান নির্ভর করে ভাসমান সূক্ষ্ম ধূলিকণা (পার্টিকুলেট ম্যাটার বা পিএম-১০) ও অতিসূক্ষ্ম ধূলিকণার পরিমাণের (পিএম ২.৫) ওপর, যা পরিমাপ করা হয় প্রতি ঘনমিটারে মাইক্রোগ্রাম (পার্টস পার মিলিয়ন-পিপিএম) এককে।
তিনি বলেন, ‘পার্টিকুলেট ম্যাটার (পিএম) দুই দশমিক পাঁচ কিংবা তার চেয়ে ছোট এক মাইক্রোমিটারের সমান, যেটাকে আল্ট্রাফাইন পার্টিকেল বলে। সেগুলো মানুষের মধ্যে ঢুকে পড়ে। আল্ট্রাফাইন পার্টিকেল একেবারে ছোট আকারের। এর মধ্যে কিছু আছে, যেগুলো আজকে গ্যাস থাকে, কাল পার্টিকেলে রূপান্তরিত হয়—সেগুলো মানুষের ক্ষতি করে।’
‘সিএনজি মেশিন ট্রিলিয়নের বেশি আল্ট্রাফাইন পার্টিকেল তৈরি করে। তারপর বড় বড় গাড়ি থেকে ব্ল্যাক কার্বন, ব্রাউন কার্বন ও পার্টিকেলসহ সবকিছু নির্গত হয়। পুরোনো প্রাইভেটকার থেকেও এসব দূষণ বের হয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘দুই কারণে এটা বের হয়। তার একটা হচ্ছে, এগুলো পুরনো, আরেকটা হচ্ছে এগুলোর কলকব্জা ঠিকমতো কাজ করে না।’
‘গাড়ি যত পুরোনো হয়, তত তার কানভার্শন এফিশিয়েনসি (রূপান্তর ক্ষমতা) কমে যায়। এতে দূষণ বাড়তে থাকে।’