নড়াইলের নদী-খালের পানিতে ক্রমেই লবণাক্ততা বাড়ছে। এই পানি সেচ কাজে ব্যবহার করতে পারছেন না কৃষকরা। বাধ্য হয়ে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন করে চাষাবাদ করতে হচ্ছে তাদের। এতে বোরো আবাদসহ বিভিন্ন ফসল উপাদনে সেচ খরচ বাড়ছে দ্বিগুণেরও বেশি। ফলে বেশিরভাগ তিন ফসলি জমি এখন আস্তে আস্তে এক ফসলিতে পরিণত হচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে প্রান্তিক কৃষকরা।
যশোর মৃত্তিকাসম্পদ উন্নয়ন ইন্সিটিটিউটের প্রধান বৈজ্ঞানি কর্মকর্তা ড. মো. মোতাসীম আহম্মেদ বলেন, নড়াইল জেলার মধুমতি নদীর লোহাগড়া উপজেলার কালনাঘাট, কালিয়া উপজেলার নবগঙ্গা নদীর বাড়ইপাড়া, নড়াইল সদর উপজেলার চিত্রা নদীর আউড়িয়া এবং আফরা নদীর তুলারামপুর পর্যন্ত এই নদীর পানি বছরের একটা সময়ে লবণাক্ত থাকে।
তিনি আরও বলেন, নড়াইল জেলায় ২০০০ সালে একটি জরিপ প্রতিবেদনে পানিতে প্রথম লবণাক্ততার বিষয়টি উঠে আসে। তখন এর এরিয়া ছিল ১৬ হাজার হেক্টর জমি। পরে ২০০৯ সালের জরিপে প্রায় ১৯ হাজার হেক্টর জমিতে লবণাক্ততা ধরা পড়ে। এরপর গত বছর একটি জরিপ করা হলেও এর ফলাফল এখনো প্রকাশ করা হয়নি।
তিনি মনে করেন, ফারাক্কা দিয়ে পানি প্রবাহ যত বেশি থাকবে এ অঞ্চলের নদ ও খালের পানিতে লবণাক্ততার পরিমাণ তত কম থাকবে। ফারাক্কার পানি প্রবাহ কম থাকলে নদী ও খালের পানিতে লবণের মাত্রা বেড়ে যাবে। এছাড়া বৃষ্টিপাত যত বেশি হবে পানিতে লবণের মাত্রা তত কম হবে। যে বছরে বৃষ্টি কম হয় সেই বছর লবণাক্ততার মাত্রা বেড়ে যায়।
তিনি আরও বলেন, সেচ উপযোগী পানিতে লবণের স্বাভাবিক মাত্রা ধরা হয় ০.৭৫ ডি/এস মিটার। পানিতে লবণের মাত্রার বেশি হলে সেচ অনুপযোগী হয়ে পড়ে। জেলার বিভিন্ন নদী ও খালের পানিতে লবণের মাত্রা ১.৭৫ ডি/এস মিটার পর্যন্ত দেখা গেছে।
আরও পড়ুন: সেচ সংকটে শান্তিগঞ্জের কয়েকশ হেক্টর জমি, হুমকিতে বোরো ফসল
জেলা কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, নড়াইল জেলার আয়তন ৯৬৮ বর্গ কিলোমিটার। আট লাখ মানুষ এই জেলায় বসবাস করেন। এখানে শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে না ওঠায় এই জেলার ৮২ শতাংশ মানুষ কৃষি এবং মৎস শিকারের ওপর নির্ভরশীল। প্রতি বছর জেলার প্রান্তিক কৃষক বোরো আবাদ করেন।
এমন বেশ কয়েকজন কৃষকের সঙ্গে কথা হয়। সদর উপজেলার বাশভিটা গ্রামের কৃষক পবিত্র মজুমদার বলেন, এ বছর তিনি দুই একর জমিতে বোরো আবাদ করেছেন। ১৫ বছর আগে নদী কিংবা খালের পানি দিয়ে জমিতে সেচ দিয়েছি। কিন্তু এখন আর দিতে পারছি না।
জানতে চাইলে তিনি বলেন, নদী-খালের পানিতে লবণের মাত্রা বেশি। বাধ্য হয়ে স্যালোমেশিন দিয়ে মাটির নিচ থেকে পানি উত্তোলন করে জমিতে সেচ দিতে হচ্ছে। এ বছর সেচ খরচ বাবদ তাকে গুণতে হচ্ছে ২২ হাজার টাকা। খাল কিংবা নদী থেকে পানি দিতে পারলে এই টাকাটা সাশ্রয় হতো।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, শুধু পবিত্র মজুমদারই নন। জেলার বিভিন্ন নদী-খাল-বিল ও জলাশয়ের পানিতে লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাওয়ায় সেচ কাজে ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। বিপাকে পড়েছেন তার মতো কয়েক লাখ কৃষক।
কালিয়া উপজেলার কাঞ্চনপুর গ্রামের কৃষক পিকুল শেখ বলেন, আগে এক বিঘা (৩৩ শতাংশ) জমিতে সেচ দিতে খরচ হয়েছে দুই হাজার পাচশত টাকা। নদী-খালের পানি ব্যবহারের অনুপযোগী হওয়ায় স্যালোমেশিন দিয়ে মাটির নিচ থেকে পানি তুলে জমিতে সেচ দিতে খরচ পড়ছে ৭ থেকে ৮ হাজার টাকা।
তিনি আরও বলেন, যে জমিতে লবণ পানি ঢোকে সেই জমির ফসল নষ্ট হয়ে যায় এবং সারও বেশি লাগে। আগে একই জমিতে তিন ফসল ফলাতাম। এখন বেশি টাকা খরচ এবং লবণের পানিতে জমি নষ্ঠ হওয়ার ভয়ে এক ফসলও ফলাতে পারছি না।
নড়াইল সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ মো. রোকনুজ্জামান বলেন, যে এলাকায় লবণ পানি ঢুকছে সে সকল এলাকার কৃষকরা তাদের জমিতে বাধ্য হয়ে সার বেশি ব্যবহার করছেন। এতে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন তারা। তিনি দাবি করেন, এ সকল এলাকার কৃষকদের লবণ সহিঞ্চু ফসল চাষাবাদের জন্য উৎসাহিত করা হচ্ছে।
আরও পড়ুন: ফসলি জমির মাটিকাটায় ২ স্কেভেটর অকেজো ও ৪ ট্রাক জব্দ
নড়াইল কৃষি অধিদপ্তর খামার বাড়ি উপপরিচালক কৃষিবিদ মো. জসিম উদ্দীন বলেন, বিভিন্ন বিল এলাকায় যে সমস্ত খাল ভরাট হয়ে জোয়ার-ভাটা কমে গেছে সেগুলো পুনঃখনন করতে হবে। জোয়ার-ভাটার মাধ্যমে মিষ্টি পানির প্রবাহ বাড়াতে হবে। কৃষকরা নদী ও খালের পানি ব্যবহার করতে পারলে তাদের আর্থিক সাশ্রয় হবে। তখন আবারো তিন ফসলি ফলাতে পারবে কৃষকরা। তিনি দাবি করেন ধানের পাশাপাশি গম, ভুট্টা,সূর্যমুখিসহ বিভিন্ন লবণ সহিঞ্চু ফসল চাষাবাদে উৎসাহিত করা হচ্ছে কৃষকদের। মাঠ পর্যায়ে কৃষি কর্মকর্তারা সে লক্ষ্যে কাজও করে যাচ্ছেন।