ত্রাণকেন্দ্র
খাবার নিতে গিয়ে নিহত আরও ৯৩ ফিলিস্তিনি, ‘বর্বরতা’ বন্ধের আহ্বান পোপের
গাজায় ত্রাণকেন্দ্রে খাবার নিতে গিয়ে ইসরায়েলি হামলায় আরও ৯৩ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। পাশাপাশি মধ্য গাজা থেকে নতুন করে ফিলিস্তিনিদের সরে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছে ইসরায়েল, যেখানে বিপুলসংখ্যক বাস্তুচ্যুত মানুষ আশ্রয় নিয়েছিলেন। ইসরায়েলের এসব কার্যকলাপকে ‘বর্বরতা’ ও ‘নির্বিচারে ক্ষমতার প্রয়োগ’ আখ্যা দিয়ে তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন পোপ লিও চতুর্দশ।
স্থানীয় সময় রবিবার (২০ জুলাই) গাজার উত্তরের জিকিম সীমান্ত দিয়ে জাতিসংঘের ত্রাণবাহী ট্রাক প্রবেশের সময় সেগুলোর জন্য অপেক্ষারত মানুষের ওপর ওই হামলার ঘটনা ঘটেছে বলে জানিয়েছে গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
দ্য গার্ডিয়ানকে গাজার সিভিল ডিফেন্স সংস্থার মুখপাত্র মাহমুদ বাসাল জানিয়েছেন, গাজার দক্ষিণের রাফাহ শহরের কাছাকাছি একটি ত্রাণ বিতরণকেন্দ্রের কাছে আরও ৯ জন গুলিতে নিহত হয়েছেন। একইভাবে খান ইউনিসে আরেকটি ত্রাণকেন্দ্রের কাছে আরও ৪ জন প্রাণ হারিয়েছেন ইসরায়েলি হামলায়।
এদিকে, ত্রাণকেন্দ্রের কাছে চালানো হামলার বিষয়ে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী জানিয়েছে, হুমকি মনে করে উত্তর গাজায় জড়ো হওয়া মানুষের ওপর গুলি ছুড়েছে তারা। তবে নিহতের যে সংখ্যা গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, তা তাদের প্রাথমিক তদন্তে পাওয়া সংখ্যার তুলনায় অনেক বেশি বলে দাবি করেছে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী।
গাজার আল-শিফা হাসপাতালের পরিচালক মোহাম্মদ আবু সালমিয়া জানান, রবিবার সকাল থেকে তারা ৪৮টি লাশ ও ১৫০ জন আহত ফিলিস্তিনিকে এই হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। জিকিম সীমান্ত থেকে এসব হতাহতদের আনা হয়েছে বলে জানান তিনি।
জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, মানবিক সহায়তা নিতে আসা মানুষের ওপর যেকোনো ধরনের হামলা পুরোপুরি অগ্রহণযোগ্য।
গাজায় বর্বরতা বন্ধের আহ্বান পোপের
ইসরায়েলের সর্বশেষ হামলার খবর প্রকাশের আগেই অবিলম্বে গাজা যুদ্ধের বর্বরতা বন্ধ করে শান্তিপূর্ণ সমাধানের আহ্বান জানিয়েছেন পোপ লিও চতুর্দশ। রোমের ক্যাসেল গানদলফোতে অ্যাঞ্জেলাস প্রার্থনার শেষে তিনি এসব বলেন।
এ সময় গাজার একমাত্র ক্যাথলিক গির্জায় ইসরায়েলের চালানো হামলা নিয়েও ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি।
পোপ বলেন, ‘দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই হামলা গাজার বেসামরিক জনগণ ও তাদের প্রার্থনাস্থলের ওপর চালানো হামলার একটি নতুন সংযোজন মাত্র।’
এ সময় মানবাধিকার আইন মেনে চলার পাশাপাশি বেসামরিক মানুষের সুরক্ষা, সামগ্রিকভাবে শাস্তি দেওয়া বন্ধ করা, নির্বিচারে বলপ্রয়োগ ও জোরপূর্বক জনগণকে উচ্ছেদ করার মতো কার্যকলাপ বন্ধ করতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
এদিকে, ইসরায়েলে জাতিসংঘের মানবিক সহায়তা সমন্বয় কার্যালয়ের (ওসিএইচএ) প্রধান জোনাথন হুইটলের আবাসনের অনুমতিপত্র (রেসিডেন্সি পারমিট) বাতিল করেছে তেল আবিব। জোনাথন গাজার মানবিক পরিস্থিতি বারবার নিন্দা জানিয়েছিলেন।
জোনাথন কোনো প্রমাণ ছাড়াই গাজা যুদ্ধ নিয়ে মিথ্যা তথ্য প্রচার করছিলেন বলে অভিযোগ করেছেন ইসরায়েলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী গিদিওন সার।
মাথা গোঁজার ঠাঁই নিয়ে দিশেহারা ফিলিস্তিনিরা
নতুন করে মধ্য গাজার বাসিন্দাদের সরে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী। এতে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন অসহায় মানুষগুলো। ওই এলাকায় বহু বাস্তুচ্যুত মানুষ আশ্রয় নিয়েছিলেন। তাছাড়া সেখানকার খুব কম স্থানই রয়েছে যেখানে স্থল অভিযান চালায়নি ইসরায়েল। এ ছাড়া, ওই এলাকাগুলোতে বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থাগুলো ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনার চেষ্টা করে থাকে।
আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলোর খবরে বলা হয়েছে, মধ্য গাজার দেইর আল-বালাহ শহরের তিনটি আবাসিক ভবনে বিমান হামলা চালিয়েছে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী। এরপরই সেখান থেকে পালাতে শুরু করেছেন বাসিন্দারা।
এক স্থানীয় বলেন, ‘তারা (ইসরায়েলি সেনাবাহিনী) লিফলেট ছুড়ে আমাদের সরে যেতে বলেছেন। কিন্তু আমরা জানি না কোথায় যাব, আমাদের জন্য কোনো আশ্রয় বা কিছুই নেই।’
এই নির্দেশ গাজা উপত্যকার মানুষগুলোর জীবন রক্ষায় যে সামান্য নাজুক কিছু অবলম্বন এখনো টিকে আছে, তার ওপর আরও একটি ভয়াবহ আঘাত বলে মন্তব্য করেছে ওসিএইচএ।
এদিকে, গাজায় খাদ্যসংকট ক্রমেই ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। পর্যাপ্ত ত্রাণ থাকার পরও তা গাজাবাসীর কাছে পৌঁছে দিতে পারছে না বলে জানিয়েছে জাতিসংঘের ফিলিস্তিনিদের জন্য কাজ করা সংস্থা ইউএনআরডব্লিউএ। ইসরায়েল ১০ লাখ শিশুসহ গাজার বেসামরিক মানুষদের ‘অনাহারে মারছে’ বলে অভিযোগ করেছে সংস্থাটি।
এসব অসহায় মানুষকে সহায়তা করতে অবরোধ তুলে নিয়ে ইউএনআরডব্লিউএ-কে গাজায় প্রবেশের অনুমতি দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে সংস্থাটি।
হামাসের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে গাজায় এই সংস্থাটির প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দেয় ইসরায়েল। যদিও এই অভিযোগের স্বপক্ষে কোনো প্রমাণ তারা দেখায়নি।এই সংস্থাটিই ছিল গাজায় প্রধান ত্রাণ বিতরণকারী এবং ফিলিস্তিনিদের জন্য স্বাস্থ্য ও শিক্ষাসহ মৌলিক সেবার অন্যতম প্রধান সরবরাহকারী। ইসরায়েলের অভিযোগ বরাবরই অস্বীকার করে আসছে সংস্থাটি।
তবে ইউএনআরডব্লিউএ’র ওপর থেকে এখনো নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়নি ইসরায়েল। পরিবর্তে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় চালু করেছে গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন (জিএইচএফ)।
মে থেকে চালু হওয়া এই জিএইচএফ-এর ত্রাণকেন্দ্র থেকে খাবার নিতে গিয়ে এরই মধ্যে আট শতাধিক ফিলিস্তিনি প্রাণ হারিয়েছেন বলে জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
১৩৬ দিন আগে
ত্রাণ নিতে গিয়ে মে থেকে প্রায় ৮০০ ফিলিস্তিনি নিহত
টানা তিন মাসের অবরোধের পর গত ২০ মে থেকে গাজায় পুনরায় ত্রাণ প্রবেশের অনুমতি দেয় ইসরায়েল। তবে এই মানবিক সহায়তা ফিলিস্তিনিদের জন্য আরেক মরণফাঁদ হয়ে উঠেছে। মে মাসের শেষ থেকে এ পর্যন্ত ত্রাণ নিতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ৭৯৮ জন।
সম্প্রতি জাতিসংঘের মানবাধিকার দপ্তর থেকে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এই ভয়াবহ তথ্য উঠে এসেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের সমর্থনে পরিচালিত গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন (জিএইচএফ) ও অন্যান্য ত্রাণ কেন্দ্র থেকে খাবার আনতে গিয়ে এসব প্রাণহানি ঘটেছে বলে প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে।
স্থানীয় সময় শুক্রবার (১১ জুলাই) জেনেভায় এক ব্রিফিংকালে এই প্রতিবেদনের তথ্য তুলে ধরেন জাতিসংঘের মুখপাত্র রাভিনা শামদাসানি।
এর আগে, জাতিসংঘের তত্ত্বাবধায়নে গাজায় ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনা হতো। পরে জাতিসংঘের সহায়তা ব্যবস্থার বিকল্প হিসেবে জিএইচএফের প্রস্তাব আনে ইসরায়েল। তবে এই সংস্থাটি কার্যক্রম শুরু করার পর থেকেই মানবিক সহায়তায় নিরপেক্ষতা লঙ্ঘনের অভিযোগে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর কড়া সমালোচনার মুখে পড়ে। এমনকি সম্ভাব্য যুদ্ধাপরাধে সহযোগিতার অভিযোগও তোলা হয় সংস্থাটির বিরুদ্ধে।
শুক্রবার রাভিনা শামদাসানি বলেন, ‘৭ জুলাই পর্যন্ত আমরা মোট ৭৯৮টি হত্যাকাণ্ড নথিভুক্ত করেছি, যার মধ্যে ৬১৫টি ঘটেছে জিএইচএফের আশপাশে এবং বাকি ১৮৩টি ঘটেছে ত্রাণকেন্দ্রে যাওয়ার পথে।’
ইসরায়েলের অভিযোগ, জাতিসংঘ পরিচালিত সহায়তা ব্যবস্থার মাধ্যমে হামাস ত্রাণের অপব্যবহার করছে। অন্যদিকে জাতিসংঘের দাবি, এই দাবির পক্ষে কোনো প্রমাণ নেই।
জিএইচএফ বর্তমানে চারটি খাদ্য বিতরণকেন্দ্র পরিচালনা করছে, যেখানে মার্কিন ভাড়াটে সৈন্যরা নিরাপত্তা রক্ষায় নিয়োজিত। অথচ জাতিসংঘ পরিচালিত আগের ব্যবস্থায় ৪০০টি বেসামরিক বিতরণকেন্দ্র ছিল।
এদিকে, জাতিসংঘের পরিসংখ্যানকে ‘মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর’ দাবি করে জিএইচএফের এক মুখপাত্র বলেন, ‘তাদের সহায়তাকেন্দ্রে কোনো প্রাণহানির ঘটনা ঘটেনি। বরং সবচেয়ে প্রাণঘাতী হামলাগুলো হয়েছে জাতিসংঘের ত্রাণকেন্দ্রের ওপর।’
আরও পড়ুন: খাবার নিতে আসা শিশুদের ওপর ইসরায়েলের ‘অমার্জনীয়’ হামলা
জিএইচএফ আরও দাবি করেছে, তাদের পরিচালিত কোনো স্থানে কেউ আহত হয়নি। বরং দক্ষিণ ও মধ্য গাজার চারটি সহায়তাকেন্দ্রে পৌঁছাতে যাওয়া ফিলিস্তিনিদের ওপর গুলি চালানোর জন্য তারা ইসরায়েলি সেনাদের দোষারোপ করেছে।
১৪৬ দিন আগে
ত্রাণকেন্দ্র থেকে ক্যাফে, কোথাও নেই ফিলিস্তিনিদের প্রাণের নিরাপত্তা
গাজা উপত্যকার প্রতিটি স্থানই ফিলিস্থিনিদের জন্য মরণফাঁদ হয়ে উঠেছে। ত্রাণকেন্দ্রগুলোর পাশাপাশি কোনো সতর্কতা ছাড়া এবার ক্যাফেতেও হামলা চালিয়েছে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী।
স্থানীয় সময় সোমবার (৩০ জুন) ইসরায়েলি বাহিনীর বিমান হামলা ও গুলিতে কমপক্ষে ৭৪ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছেন প্রত্যক্ষদর্শী ও স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা।
মার্কিন বার্তা সংস্থা অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের (এপি) খবরে বলা হয়েছে, নিহতদের মধ্যে সমুদ্রতীরবর্তী ক্যাফে আল-বাকাতে ৩০ জন এবং খাবারের সংগ্রহ করতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে ২৩ জন প্রাণ হারিয়েছেন। জাওয়াইদা শহরের কাছে একটি ভবনে চালানো আরেক হামলায় ছয়জন নিহত হন বলে জানিয়েছে আল-আকসা হাসপাতাল।
এ ছাড়া, গাজা শহরের একটি সড়কে আরও দুটি বিমান হামলায় ১৫ জন নিহত হন বলে জানানো হয়েছে।
অন্যদিকে, কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরার খবরে বলা হয়েছে, সোমবারের ইসরায়েলি হামলায় গাজায় অন্তত ৯৫ জন নিহত হয়েছেন, আহত হয়েছেন অনেকে। এরমধ্যে আল-বাকা ক্যাফেতে ৩৯ জন নিহত হয়েছেন। তাছাড়া, ত্রাণকেন্দ্র ও হাসপাতালেও হামলা চালিয়েছে ইসরায়েলি বাহিনী।
ক্যাফেতে হামলা
আল-বাকা ক্যাফেটি ছিল যুদ্ধ শুরুর পর গত ২০ মাস ধরে খোলা থাকা গুটিকয়েক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের একটি। এটি ছিল ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ ও মোবাইল ফোন চার্জ দেওয়ার স্থান হিসেবে মানুষের একটি ভরসার জায়গা।
পড়ুন: রাতভর ইসরায়েলি হামলায় গাজায় নিহত ৭২
আল জাজিরা জানায়, ক্যাফেতে নিহতদের মধ্যে সাংবাদিক ইসমাইল আবু হাতাব ছাড়াও নারী ও শিশুরাও রয়েছেন। সেখানে একটি জন্মদিনের অনুষ্ঠানে জড়ো হয়েছিলেন তারা।
এই হামলার প্রত্যক্ষদর্শী ইয়াহিয়া শরীফ বলেন, ‘আমরা ক্যাফেতে ছিন্নবিচ্ছিন্ন দেহ খুঁজে পেয়েছি। এই জায়গার কোনো রাজনৈতিক বা সামরিক সম্পৃক্ততা ছিল না। এটি মানুষে ভরা ছিল, শিশুরাও ছিল একটি জন্মদিন পালনের জন্য।’
এপিতে দেওয়া সাক্ষাৎকারে আরেক প্রত্যক্ষদর্শী আলি আবু আতেইলা জানান, গাজা সিটির আল-বাকা ক্যাফে লক্ষ্য করে যখন বিমান হামলা চালানো হয়, তখন তিনি সেখানে অবস্থান করছিলেন।
আলি আবু বলেন, ‘কোনো সতর্কতা ছাড়াই, হঠাৎ একটি যুদ্ধবিমান এসে জায়গাটি লক্ষ্য করে হামলা চালায়, ভূমিকম্পের মতো কাঁপিয়ে তোলে পুরো এলাকাটি।’
বিস্ফোরণে ক্যাফেটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয় এবং স্থানে একটি বিশাল গর্ত সৃষ্টি হয়।
কোনো সতর্কতা ছাড়াই হামলা
গাজা শহর থেকে আল-জাজিরার সাংবাদিক হানি মাহমুদ জানান, ক্যাফেতে হামলার আগে কোনো ধরনের সতর্কতা দেওয়া হয়নি। এই এলাকা অনেক বিপর্যস্ত ও বাস্তুচ্যুত মানুষের জন্য নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছিল। এখানকার তাঁবুগুলোর মধ্যে ভীষণ গরম থেকে কিছুটা মুক্তির সুযোগ ছিল। বিস্ফোরণের তীব্রতার কারণে রক্তের দাগ এখনো মাটিতে ছড়িয়ে রয়েছে। অনেক লাশ ও শরীরের অংশ খণ্ড খণ্ড অবস্থায় এখান থেকে উদ্ধার করা হয়েছে।
সোমবার গাজা শহরের জয়তুন এলাকায় একটি খাদ্য বিতরণ গুদামেও হামলা চালানো হয়। সেখানে খাবার নিতে আসা অন্তত ১৩ জন নিহত হন। এ ছাড়াও গাজা শহরের ইয়াফা স্কুলেও হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। স্কুলটিতে বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনিরা বসবাস করতেন।
সেখানে হামলার আগে মাত্র পাঁচ মিনিট সময় দিয়ে এলাকাটি ছেড়ে দিতে বলা হয়েছিল বলে জানান হামাদা আবু জারাদেহ নামে এক ব্যক্তি। তিনি হামলার আগে পালাতে সক্ষম হন।
হামদা বলেন, ‘আমরা জানি না কী করব, কোথায় যাব? ৬৩০ দিনের বেশি সময় ধরে আমরা পুরো পৃথিবী থেকে বিমুখ। প্রতিদিন মৃত্যুই আমাদের একমাত্র সঙ্গী।’
ত্রাণকেন্দ্রগুলোতে হামলা
এপির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, খাবার সংগ্রহ করতে গিয়ে ইসরায়েলের হামলায় ১১ জন ফিলিস্তিনি প্রাণ হারিয়েছেন। এই তথ্য নিশ্চিত করেছে গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
পড়ুন: গাজায় আগ্রাসন: যুদ্ধবিরতির ‘খুব কাছাকাছি’ হামাস-ইসরায়েল
গাজার দক্ষিণাঞ্চলে খাবারের খোঁজে বের হওয়া আরও ১১ জনকে গুলি করে হত্যা করে ইসরায়েলি বাহিনী। এ তথ্য জানিয়েছেন প্রত্যক্ষদর্শী, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এবং গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
খান ইউনিসের নাসের হাসপাতাল জানিয়েছে, ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র-সমর্থিত গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফান্ডের (জিএইচএফ) একটি ত্রাণকেন্দ্র থেকে ফেরার পথে গুলিবিদ্ধদের লাশ তাদের কাছে এসেছে।
এপির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই বিতর্কিত ও বিশৃঙ্খল ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রমের কারণে গত এক মাসে পাঁচ শতাধিক ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন।
নাসের হাসপাতাল আরও জানায়, রাফাহ শহরেও ওই ফান্ডের একটি ত্রাণকেন্দ্রের কাছেও এক ব্যক্তি নিহত হয়েছেন। এ ছাড়া নেতজারিম করিডরের কাছে সাহায্যের জন্য অপেক্ষা করার সময় আরও একজন নিহত হয়েছেন।
মনজের হিশাম ইসমাইল নামে এক প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, জিএইচএফের খান ইউনিসের কেন্দ্র থেকে ফেরার পথে জনতার ওপর গোলাবর্ষণ করে ইসরায়েলি বাহিনী।
আরেকজন প্রত্যক্ষদর্শী ইউসুফ মাহমুদ মোকাইমার জানান, তিনি অন্যদের সঙ্গে হাঁটার সময় দেখতে পান ট্যাংক ও অন্যান্য যানবাহনে করে সেনারা দ্রুত ছুটে আসছে। তারা প্রথমে সতর্কমূলক গুলি ছুড়লেও পরে সরাসরি জনতার ওপর গুলি চালায়।
ইউসুফ বলেন, ‘তারা আমাদের লক্ষ্য করে এলোমেলোভাবে গুলি চালায়।’
তিনি পায়ে গুলিবিদ্ধ হন এবং তাকে উদ্ধার করতে আসা এক ব্যক্তিও গুলিবিদ্ধ হন। ইউসুফ আরও বলেন, ‘সেনারা ছয়জনকে ধরে নিয়ে গেছে, তার মধ্যে তিনটি শিশু। আমরা জানি না তারা এখনও বেঁচে আছে কি না।’
ইসরায়েলি সেনাবাহিনী জানিয়েছে, তারা এসব হামলার বিষয়ে তথ্য পর্যালোচনা করছে।
এর আগে তারা দাবি করে, কেউ সন্দেহজনকভাবে চলাফেরা করলে বা সেনাদের খুব কাছাকাছি চলে এলে তারা সতর্কতামূলক গুলি চালায়—যেটি ত্রাণ সংগ্রহের সময়ও হতে পারে।
আল জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গাজায় সীমিত ত্রাণ বিতরণ শুরু করার পর থেকে এসব কেন্দ্রে হামলায় এখন পর্যন্ত প্রায় ৬০০ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন।
ইসরায়েলি সেনাবাহিনী সোমবার স্বীকার করেছে, ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রে হামলায় ফিলিস্তিনি বেসামরিক নাগরিকরা হতাহত হয়েছেন। সেনাদের ‘পূর্বের অভিজ্ঞতা থেকে শেখার আলোকে’ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে তারা।
পড়ুন: ইসরায়েলি হামলার মাঝেই ৩ ইউরোপীয় পরাশক্তির সঙ্গে বৈঠকে বসছে ইরান
এর আগে, ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যম ‘হারেৎজ’ এক প্রতিবেদনে জানিয়েছিল, গাজায় ত্রাণকেন্দ্রের কাছে দায়িত্ব পালনরত সেনাদের জনতার ওপর ইচ্ছাকৃতভাবে গুলি চালাতে বলা হয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কিছু সেনার বরাত দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, অনেক সময় যারা কোনো হুমকির কারণ ছিল না, তাদেরও লক্ষ্য করে প্রাণঘাতী গুলি চালানো হয়েছে।
হাসপাতালেও হামলা
আল জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়, গাজা উপত্যকার মধ্যাঞ্চলের দেইর আল-বালাহ শহরে অবস্থিত আল-আকসা হাসপাতালের আঙিনাতেও হামলা চালিয়েছে ইসরায়েলি বাহিনী। সেখানে হাজারো পরিবার আশ্রয় নিয়েছিল।
অনলাইনে ছড়িয়ে পড়া ও আল-জাজিরার যাচাই করা ভিডিওগুলোতে দেখা গেছে, বিস্ফোরণের পর হাসপাতালজুড়ে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়, আশ্রয় নেওয়া মানুষজন নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য ছুটতে থাকে, তাঁবুগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
আল-জাজিরার সাংবাদিক তারেক আবু আজজুম হাসপাতালের কাছে থেকে বলেন, ‘এই বিশাল বিস্ফোরণের আগে কোনো ধরনের সতর্কতা দেওয়া হয়নি। হামলার স্থান আমাদের সম্প্রচার পয়েন্ট থেকে মাত্র ১০ মিটার দূরে।’
এটি প্রথমবার নয়; ইসরায়েলি বাহিনী এ হাসপাতালের আঙিনায় কমপক্ষে ১০ বার হামলা চালিয়েছে, যা চিকিৎসা ব্যবস্থার ওপর চরম চাপ সৃষ্টি করেছে বলে জানান তিনি।
গাজার সরকারি মিডিয়া অফিস এক বিবৃতিতে এই হামলাকে ‘ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার বিরুদ্ধে একটি পরিকল্পিত অপরাধ’ বলে অভিহিত করেছে। বিবৃতিতে বলা হয়, ইসরায়েলের যুদ্ধবিমান আল-আকসা শহীদ হাসপাতালের দেয়ালের ভেতরে বাস্তুচ্যুতদের একটি তাঁবুতে বোমা ফেলেছে, এতে অনেকেই আহত হয়েছেন। তাছাড়া, রোগীদের জীবন মারাত্মকভাবে হুমকির মুখে পড়েছে।
আল জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ২২ মাসে ইসরায়েল বারবার গাজার অসংখ্য হাসপাতালকে টার্গেট করেছে। ইসরায়েল গাজার স্বাস্থ্যখাতকে পদ্ধতিগতভাবে ধ্বংস করছে বলে মন্তব্য করেছেন মানবাধিকার সংস্থা ও জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা।
আবারো জমি দখল ও উচ্ছেদের আশঙ্কা
ইসরায়েলি বাহিনী খান ইউনিসে বাড়িঘর ধ্বংসের কাজ শুরু করেছে, যা নতুন করে স্থল অভিযান শুরুর শঙ্কা সৃষ্টি করেছে।
একই সঙ্গে উত্তর গাজার বড় বড় এলাকায় বসবাসরত ফিলিস্তিনিদের নতুন করে উচ্ছেদের হুমকি দিচ্ছে ইসরায়েল, যেখানে তারা এর আগেও অভিযান চালিয়ে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ ঘটিয়েছে।
গাজা শহরের বাসিন্দা, ৫ সন্তানের বাবা সালাহ (বয়স ৬০) বলেন, ‘বিস্ফোরণ থেমে নেই; ওরা স্কুল, ঘরবাড়ি সব বোমা মেরে উড়িয়ে দিয়েছে। মনে হচ্ছিল ভূমিকম্প হয়েছে। খবরের কাগজে শুনি যুদ্ধবিরতি নাকি আসছে, অথচ এখানে আমরা কেবল মৃত্যু ও বিস্ফোরণই দেখতে পাচ্ছি।’
গাজা শহরের জয়তুন এলাকার পূর্বাঞ্চলে প্রবেশ করেছে ইসরায়েলি ট্যাংক এবং উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে গোলাবর্ষণ করেছে। একই সময়ে বিমান হামলায় চারটি স্কুল ধ্বংস করা হয়েছে। এর আগে ওই স্কুলগুলোতে আশ্রয় নেওয়া পরিবারগুলোকে এলাকা ছাড়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল।
গাজার স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, জয়তুনে কমপক্ষে ১০ জন এবং গাজার দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে আরও অন্তত ১৩ জন নিহত হয়েছেন।
জাতিসংঘের মতে, গাজার ৮০ শতাংশ এলাকা এখন ইসরায়েলি সামরিক নিয়ন্ত্রণাধীন অথবা জোরপূর্বক উচ্ছেদের হুমকির মধ্যে রয়েছে।
ওয়াশিংটনে যুদ্ধবিরতি আলোচনার প্রস্তুতি
এদিকে, এই হামলাগুলোর মধ্যেই নতুন যুদ্ধবিরতির আলোচনার জন্য ওয়াশিংটন যাচ্ছেন ইসরায়েলের কৌশলগত বিষয়ক মন্ত্রী রন ডারমারসহ অন্যান্য কর্মকর্তারা।
সম্প্রতি গাজায় নতুন করে যুদ্ধবিরতির আলোচনার উদ্যোগ নিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। এ বিষয়ে মধ্যস্থতাকারী কাতার নিশ্চিত করেছে যে, যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে আলোচনায় ফেরার ব্যাপারে ‘গভীর আগ্রহ’ রয়েছে, তবে কিছু জটিলতা রয়ে গেছে।
দোহায় কাতারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মাজেদ আল আনসারি বলেন, ‘মূল বাধা হলো, দুপক্ষই আলোচনার টেবিলে ফিরছে না। তবে ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধবিরতির ফলে যে গতি তৈরি হয়েছে, তা এখন কাজে লাগানো যেতে পারে।’
তিনি জানান, দুয়েকদিনের মধ্যেই এই আলোচনা শুরু হবে এমনটা তারা আশা করছেন না। তবে আলোচনায় ফেরার উপযোগী পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বলে আশা প্রকাশ করেন মাজেদ আল আনসারি।
হোয়াইট হাউসে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া আলোচনায় ইরান ও আঞ্চলিক কূটনৈতিক সম্ভাবনাগুলো নিয়েও আলোচনা হওয়ার কথা। এদিকে, ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর নিরাপত্তা মন্ত্রিসভা গাজা বিষয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ নির্ধারণে বৈঠক করবে বলে জানা গেছে।
শুক্রবার (২৭ জুন) ইসরায়েলি সেনাপ্রধান জানান, বর্তমান স্থল অভিযান প্রায় লক্ষ্য পূরণের কাছাকাছি পৌঁছেছে।
এরপর, রবিবার (২৯ জুন) নেতানিয়াহু বলেন, ‘হামাস ও অন্যান্য ফিলিস্তিনি সশস্ত্র গোষ্ঠীর হাতে থাকা যেসব বন্দি এখনও জীবিত বলে বিশ্বাস করা হচ্ছে—তাদের উদ্ধার করতে নতুন সুযোগ তৈরি হয়েছে।’
ফিলিস্তিনি ও মিসরীয় সূত্রে জানা গেছে, মধ্যস্থতাকারী কাতার ও মিসর উভয় পক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়িয়েছে, তবে নতুন যুদ্ধবিরতি আলোচনার জন্য এখনও কোনো নির্দিষ্ট তারিখ নির্ধারিত হয়নি।
এদিকে, হামাসের জ্যেষ্ঠ নেতা ওসামা হামদান সোমবার এক বিবৃতিতে জানান, গত চার সপ্তাহে ইসরায়েলের পক্ষ থেকে যুদ্ধবিরতির বিষয়ে কোনো খবর আসেনি। তারা একটি যুদ্ধবিরতির জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, যা গাজার জনগণকে রক্ষা করবে এবং মধ্যস্থতাকারীদের সঙ্গে সীমান্ত খুলে দেওয়ার জন্যও তারা কাজ করে যাচ্ছেন বলে উল্লেখ করেন তিনি।
১৫৬ দিন আগে