সপ্তাহব্যাপী লাগাতার উত্থানে রাজধানীর পুঁজিবাজারে ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে। এক নাগাড়ে বেড়েছে সূচক, লেনদেন এবং বাজার মূলধন। তবে প্রধান সূচক বাড়লেও সপ্তাহ ভালো যায়নি এসএমই খাতে।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সাপ্তাহিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, পাঁচ কার্যদিবসে (২-৬ ফেব্রুয়ারি) প্রধান সূচক ডিএসইএক্স বেড়েছে ৬৭ পয়েন্ট। সূচকের ৫১১২ পয়েন্ট এক সপ্তাহের লেনদেনে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫১৭৯ পয়েন্টে। এতে করে এক সপ্তাহে ডিএসইক্স বেড়েছে ১ দশমিক ৩০ শতাংশ।
বেড়েছে ডিএসই'র বাকি দুই সূচকও। শরীয়াভিত্তিক সূচক ডিএসইএস বেড়েছে ১৩ পয়েন্ট, যা গত সপ্তাহের তুলনায় ১ দশমিক ২২ শতাংশ বেশি। অন্যদিকে এক সপ্তাহের লেনদেনে ব্লু-চিপ কোম্পানির সূচক ডিএস-৩০ বেড়েছে ৯ পয়েন্ট।
প্রধান এবং গুরুত্বপূর্ণ সূচক বাড়লেও এবারের সপ্তাহ ভালো যায়নি ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের শেয়ার এসএমই খাতে। সপ্তাহের ব্যবধানে ডিএসই'র এসএমই সূচক কমেছে ৪৯ দশমিক ৯ পয়েন্ট, যা আগের তুলনায় ৪ দশমিক ৬০ শতাংশ কম।
ব্যবসায়ীরা এসএমই খাতের এ বেহাল দশার জন্য দায়ী করছেন চলমান উচ্চ সুদের মুদ্রানীতিকে।
আরও পড়ুন: উত্থানের ধারা অব্যাহত পুঁজিবাজারে
নিজেদের বেহাল দশা প্রসঙ্গে কাপড় ব্যবসায়ী সাব্বির হোসেন বলেন, এসএমই খাতের এসব ব্যবসা অনেকটাই ব্যাংক ঋণের ওপর নির্ভরশীল। সুদের হার বেশি হওয়ায় ক্ষুদ্র এবং মাঝারি ব্যবসায়ীরা ঋণ নেওয়ার সাহস করছেন না। এতে করে ব্যবসার পরিধিও বাড়ছে না। একদিকে বিনিয়োগের অভাব, অন্যদিকে ঋণ গ্রহণে অনীহা এবং পরিশোধ নিয়ে অনিশ্চয়তা। সব মিলিয়ে দেশের এসএমই খাত টিকে থাকতে হিমশিম খাচ্ছে।
বাজারে এসএমই খাতের বর্তমান দুরাবস্থার প্রভাব পুঁজিবাজারে পড়ছে বলে মনে করেন বিনিয়োগকারীরা। পুঁজিবাজারের সাধারণ বিনিয়োগকারী তারেক হোসেন বলেন, কোম্পানির ভালো-মন্দের ওপরে পুঁজিবাজারে দাম ওঠানামা অনেকখানি নির্ভর করে। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের বাজার খারাপ হওয়া এ খাতের সূচকেও শনির দশা চলছে।
তবে সাপ্তাহিক বিবেচনায় সার্বিকভাবে লেনদেন বেড়েছে শেয়ারবাজারে। সপ্তাহ শেষে পাঁচ কার্যদিবসে শেয়ার এবং ইউনিট কেনাবেচার পরিমাণ ছাড়িয়েছে ২ হাজার ১৩২ কোটি টাকা, যা এর আগে ছিল ১ হাজার ৬৯৪ কোটি টাকা।
বেড়েছে প্রতিদিনের গড় লেনদেনও। প্রতিদিনের গড় লেনদেন ৩৩৮ কোটি টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৪২৬ কোটি টাকা। এতে করে সপ্তাহান্তে লেনদেন বেড়েছে ২৫ শতাংশের বেশি।
লেনদেনের পাশাপাশি বেড়েছে ডিএসই'র বাজার মূলধনও। পাঁচ দিনে ডিএসই'র বাজার মূলধন বেড়েছে ৯ হাজার ১০৫ কোটি টাকা, যা আগের সপ্তাহের তুলনায় ১ দশমিক ৩৭ শতাংশ বেশি।
পুরো সপ্তাহজুড়ে দরবৃদ্ধির তালিকায় ছিল বেশিরভাগ কোম্পানি। দাম বেড়েছে ২৬৫ কোম্পানির, কমেছে ১০৩ এবং অপরিবর্তিত আছে ২৭ কোম্পানির শেয়ারের দাম।
পুঁজিবাজারের ইতিবাচক পরিবর্তন প্রসঙ্গে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) নির্বাহী পরিচালক রেজাউল করিম বলেন, নতুন কমিশন কখনোই বাজারে হস্তক্ষেপ করে না। এতে করে বাজার নিজের গতিতে চলার সুযোগ পায়। সে হিসাবে রাতারাতি পুঁজিবাজার ফুলেফেঁপে ওঠে না, আবার বিনিয়োগকারীদের ভরাডুবিও হয়না। সব মিলিয়ে কমিশনের বাজারমুখি সিদ্ধান্তের প্রতিফলন ঘটেছে গেল পাঁচ কার্যদিবসের লেনদেনে।
পাঁচ কার্যদিবসের লেনদেনে দরবৃদ্ধির শীর্ষ ১০ শেয়ারের মধ্যে এ ক্যাটাগরির কোনো কোম্পানি নেই। তালিকায় থাকা কোম্পানির মধ্যে পাঁচটি বি গ্রুপের এবং বাকি পাঁচ জেড গ্রুপের। অন্যদিকে দরপতনের শীর্ষে থাকা কোম্পানির মধ্যে এ ক্যাটাগরির কোম্পানি আছে চারটি।
সাপ্তাহিক লেনদেন বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, দাম বাড়তে থাকায় বিনিয়োগকারীদের বড় অংশের আগ্রহ তৈরি হয়েছে নিম্নমানের কোম্পানির শেয়ারের প্রতি। এতে করে ঝুঁকি নিয়েই পুঁজিবাজারে নিজেদের অর্থলগ্নি করছেন তারা।
বাজারে নিম্মমানের কোম্পানির শেয়ারের সোরগোল প্রসঙ্গে ডিএসই'র পরিচালক মিনহাজ মান্নান ইমন বলেন, এখনো বাজারে তারল্য সংকট বিদ্যমান আছে। বাজারে তারল্য সংকট চলতে থাকলে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে অস্থিরতা বাড়ে। তারা রাতারাতি মুনাফা করতে গিয়ে কিংবা পূর্বের হওয়া লোকসান সামাল দিতে নিম্নমানের কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগ করে। এসব কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগ করা বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। কেননা বেশিরভাগ কারসাজির ঘটনা ঘটে এসব কোম্পানির শেয়ার কেন্দ্র করেই।
খাতভিত্তিক শেয়ারে এতদিন ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান সুবিধা করতে না পারলেও গত পাঁচ কার্যদিবসে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে এ দুটি খাত। তালিকাভুক্ত ৩৬ ব্যাংকের মধ্যে দাম বেড়েছে ২৫, কমেছে ৫ এবং অপরিবর্তিত আছে ৬ ব্যাংকের শেয়ারের দাম। সপ্তাহ শেষে ব্যাংকের শেয়ারের সামগ্রিক দাম বেড়েছে ৬৫ শতাংশ এবং শেয়ার ক্রয়বিক্রয়ের পরিমাণ ৮০ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে।
আরও পড়ুন: পুঁজিবাজারে টানা উত্থানে শেষ হলো সপ্তাহ
অন্যদিকে আর্থিক প্রতিষ্ঠানে সর্বসাকুল্যে কোনো শেয়ারের দাম কমেনি। তালিকাভুক্ত ২৩ কোম্পানির মধ্যে দাম বেড়েছে ২২ এবং অপরিবর্তিত আছে ১ কোম্পানির শেয়ারের দাম। পাঁচদিনে এ খাতের শেয়ারের দাম বেড়েছে ৭৫ শতাংশ এবং হাতবদলে ক্রয়-বিক্রয় ছাড়িয়ে গেছে ১১৫ শতাংশ।
আগের তুলনায় পুঁজিবাজারে রিটার্ন বেড়েছে ১ শতাংশের ওপর। এরমধ্যে ৪ দশমিক ৯ শতাংশ বেশি রিটার্ন দিয়ে শীর্ষে আছে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো। ব্যাংক খাতে রিটার্ন বেড়েছে ১ দশমিক ৩৪ শতাংশ।
বাজার বিশ্লেষকদের মতে, চলতি মাসে ঘোষিত হওয়া নতুন মুদ্রানীতি নিয়ে অনেকে প্রত্যাশা করছেন নতুন করে সুদের হার না বাড়ানোর। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিভিন্ন মহল থেকে বলা হয়েছে, এবারের মুদ্রানীতি হবে সংকোচনমূলক। বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতির ওপর বিবেচনা করে এ মুদ্রানীতি ঘোষিত হবে। এর একটি ইতিবাচক প্রভাব পুঁজিবাজারে পড়তে শুরু করেছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।