উত্তরে জাতীয় পার্টির ‘ঘাঁটি’ খ্যাত রংপুরে নড়েচড়ে বসেছে দলটি। ফিরিয়ে আনা হচ্ছে দলের হেভিওয়েট নেতাদের। ক্ষমা চেয়ে আবার জাতীয় পার্টিতে (জাপা) ফিরেছেন দলের সাবেক মহাসচিব মসিউর রহমান রাঙ্গা। একই সঙ্গে রংপুর-৬ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য নূর মোহাম্মদ মন্ডলও ফিরেছেন দলে। তাদের ফিরে আসা জাতীয় পার্টির রাজনীতিতে নতুন সমীকরণ তৈরি করেছে।
সবাই একসঙ্গে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়ে জাপার ‘দুর্গ’ উদ্ধারে নামবেন বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে। এই দুই নেতা দলে ফেরায় নেতা-কর্মীদের মাঝেও প্রাণ ফিরেছে।
রবিবার (১৪ ডিসেম্বর) রাতে রংপুর মহানগর জাতীয় পার্টির (জাপা) কার্যালয়ে এক অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানে দলের কো-চেয়ারম্যান রংপুর মহানগর জাপা সভাপতি ও সাবেক মেয়র মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা এবং রংপুর জেলা জাতীয় পার্টির আহ্বায়ক মো. আজমল হোসেন লেবুর হাতে ফুল তুলে দিয়ে জাপায় ফেরেন নুর মোহাম্মদ।
অবশ্য ওই রাতেই ফেসবুক লাইভে এসে নূর মোহাম্মদ মন্ডল দাবি করেন, তিনি এমনিতেই সাবেক মেয়রের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন। তবে জাপায় যোগ দেননি।
কিন্তু তার নিবার্চনি এলাকা পীরগঞ্জে উঠেছে আলোচনার ঝড়। জাপা নেতারা বলছেন, নুর মোহাম্মদ মন্ডলের সিগন্যাল পেয়ে ইতোমধ্যেই তারা মাঠে নেমেছেন।
অন্যদিকে, সোমবার রংপুর-১ আসন থেকে জাপার তিনবারের সাবেক এমপি, দলের সাবেক মহাসচিব ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী মসিউর রহমান রাঙ্গা জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের ও মহাসচিব শামীম হায়দার পাটোয়ারীর সঙ্গে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে দেখা করে আবারও জাতীয় পার্টিতে ফিরেছেন।
সেদিন ফেসবুক লাইভে এসে জাপা চেয়ারম্যান জিএম কাদেরের কাছে ক্ষমা চেয়ে দলে ফেরার কথা জানান তিনি। এ ঘটনায় রাঙ্গার নিজ উপজেলা গংগাচড়ায়ও নড়েচড়ে বসেছে ঝিমিয়ে থাকা জাপা নেতা-কর্মীরা।
এ ব্যাপারে জানতে বুধবার দুপুরে যোগাযোগ করা হয় মসিউর রহমান রাঙ্গার সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘দলের চেয়ারম্যান আমাকে ক্ষমা করেছেন। আমি জাতীয় পার্টিতে ফিরে এসেছি। আসন্ন সংসদ নির্বাচনে রংপুর-১ আসন থেকে অবারও দলের প্রার্থী হয়ে নির্বাচন করতে চাই। দল আমাকে মনোনয়ন দিলে নির্বাচন করতে প্রস্তুত আছি। আর যদি মনোনয়ন না পাই, তারপরও দলের সিদ্ধান্তের বাইরে যাব না।’
দলের কো-চেয়ারম্যান ও রংপুর মহানগর জাপা সভাপতি মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা বলেন, ‘আমরা তাকে (রাঙ্গা) দলে আবারও সাদরে গ্রহণ করেছি। দলে তার অবদান ভোলার মতো নয়। আমরা আশা করি, শক্তিশালী জাপা মাঠে ভোটারদের মন জয় করবে।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রংপুর-১ আসনে মসিউর রহমানকে ব্যাপক ভোটে হারিয়ে বেসরকারিভাবে বিজয়ী হন আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থী আসাদুজ্জামান। মসিউর রহমানও স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে লড়েছিলেন।
২০০১ সালে জাতীয় পার্টি থেকে এ আসনে সংসদ সদস্য হন মসিউর রহমান। পরে ২০০৮ সালের নির্বাচনে ফের এই আসনে ক্ষমতায় আসে জাপা। সেবার সংসদ সদস্য হন দলটির চেয়ারম্যান জিএম কাদেরের ভাতিজা হোসেন মকবুল শাহরিয়ার। ২০১৪ সালের নির্বাচনে মসিউর রহমান আবারও এই আসন থেকে সংসদ সদস্য হয়ে পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী হন। ২০১৮ সালে জাতীয় পার্টি থেকে আরও একবার জয়ী হয়ে তিনি জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ হন।
২০১৮ সালের ৩ ডিসেম্বর থেকে ২০২০ সালের ২৬ জুলাই পর্যন্ত জাতীয় পার্টির মহাসচিবের দায়িত্ব পালন করেন মসিউর রহমান। তবে গত বছরের ১৪ সেপ্টেম্বর রওশন এরশাদের পক্ষ নেওয়ায় দলের সব পদ-পদবি থেকে তাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।
অপরদিকে, তিন বড় রাজনৈতিক দলের ছায়ায় রাজনৈতিক অভিযাত্রা, দুর্নীতি মামলা ও জেল জীবনের মধ্য দিয়ে যাওয়া রংপুর-৬ (পীরগঞ্জ) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য নূর মোহাম্মদ মন্ডল আবারও ফিরেছেন তার রাজনৈতিক প্রথম ঠিকানা জাতীয় পার্টিতে।
স্থানীয় পর্যায়ে ‘দল পরিবর্তনে সেরা’ হিসেবে পরিচিত মন্ডলের এই দল পরিবর্তন নিয়ে রাজনৈতিক মহলে মিশ্র প্রতিক্রিয়া ও জল্পনার সৃষ্টি হয়েছে।
নূর মোহাম্মদ মন্ডলের রাজনৈতিক জীবন জাতীয় পার্টির হাত ধরেই শুরু হয়। এই দল থেকেই ১৯৯৬ ও ২০০১ সালের সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে দুবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন তিনি।
নব্বইয়ের দশকের গণঅভ্যুত্থানের পর হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদের নেতৃত্বাধীন সরকারের পতন হলে তিনি বিএনপিতে যোগ দেন। বিএনপি থেকে মনোনয়ন পেয়ে উপজেলা চেয়ারম্যানও নির্বাচিত হন। পরবর্তী সময়ে বিএনপি সরকারের পতন হলে ২০১৮ সালে তিনি আওয়ামী লীগে যোগ দেন এবং দলটির টিকিটে উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ২০২৪ সালের উপজেলা নির্বাচনেও তিনি আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে জয়ী হয়েছিলেন।
জানা গেছে, নূর মোহাম্মদ মন্ডল শুধু দল পরিবর্তনের জন্যই নন, বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের জন্যও আলোচিত। আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) করা মামলায় গত ১৯ জুন তাকে কারাগারে পাঠানো হয়। আদালত তার বিরুদ্ধে পীরগঞ্জে বন বিভাগের ৩ হাজার ১৩০ একরেরও বেশি জমি দখল করে নির্মিত ‘আনন্দনগর’ নামের একটি পিকনিক স্পট ও বিনোদন কেন্দ্র, আটটি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট এবং ৯ কোটি টাকা মূল্যের স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি ক্রোকের নির্দেশ দেন।
তবে এরই মধ্যে জাতীয় পার্টিতে ফিরে সংসদ সদস্য পদে লড়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন তিনি। ইউএনবিকে নুর মোহাম্মদ মন্ডল বলেন, ‘জাপা থেকে মনোনয়ন পেলে ভোট করতে আমার কোনো আপত্তি নেই।’ মাঠে তার জনপ্রিয়তা তুঙ্গে বলে দাবি করেন এই নেতা।