পবিত্র ঈদুল ফিতর উপলক্ষে ছুটি হয়েছে ক্যাম্পাস। প্রিয়জনদের সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করতে নাড়ির টানে বাড়ি ফিরেছে বেশিরভাগ শিক্ষার্থী, ঈদের আগের দিন চলছে শেষ মুহূর্তের ঘরে ফেরার তোড়জোড়। ফলে সবুজ-শ্যামল ক্যাম্পাসে নেই প্রাণচাঞ্চল্য; নেই রিকশার টুংটাং বেলের শব্দ, গাড়ির হর্ণের বিরক্তিকর আওয়াজ, চিরচেনা কোলাহল। স্থবিরতা নেমে এসেছে চারদিকে।

শহিদ মিনার চত্বরে শিক্ষার্থীদের জটলাও চোখে পড়ছে না। ক্যাফেটেরিয়া, লাইব্রেরিতেও কাউকে দেখা যাচ্ছে না। চিরযৌবনা ছাত্র শিক্ষক কেন্দ্র (টিএসসি) যেন মলিন হয়ে আছে। আবাসিক হলগুলোর ক্যান্টিন-ডাইনিংয়ে ঝুলছে তালা। বটতলার দোকানিরা তাদের দোকানের শাটার নামিয়ে কবেই বাড়ি ফিরেছে! রেইনট্রি গাছে শুধু কাকেদের ডাক শোনা যায়। খাবার না পেয়ে ক্যাম্পাসের কুকুর-বিড়ালগুলোও পাশের এলাকায় আস্তানা গেড়েছে।

সাংবাদিক সমিতির অফিসটার সামনে ধুলার আস্তরণ জমে গেছে। কলা ও সমাজবিজ্ঞান অনুষদের সামনে পায়চারি করছেন দুই-তিনজন নিরাপত্তারক্ষী। বিশ্ববিদ্যালয়ের ফটকে কয়েকটি রিকশা অপেক্ষা করছে, যদি কেউ বের হয়—এই আশায়।

বলছিলাম জাঁকজমকের রাজধানী জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) কথা। ইতিহাস, ঐতিহ্য আর সংস্কৃতিতে ভরপুর এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস সবসময় প্রাণচাঞ্চল্যে মুখর থাকলেও ঈদের ছুটিতে জনমানবহীন হয়ে পড়েছে।

ক্যাম্পাস ছুটি হয়েছে গত ২০ মার্চ। তারপর থেকেই ধীরে ধীরে ফাঁকা হতে শুরু করে ক্যাম্পাস। যারা টিউশনি করান, কোচিংয়ে ক্লাস নেন কিংবা অন্য কোনো পার্ট টাইম কাজের সঙ্গে যুক্ত, তাদের কারও কারও এখনও বাড়ি ফেরা বাকি। এদের মধ্যে যারা বাড়ি ফিরবেন, ঈদের আগমুহূর্তে তারা ব্যাগ গোছানোর তোড়জোড় শুরু করেছেন সকাল থেকেই।

আরও পড়ুন: জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে জাবিতে হামলা: ২৮৯ শিক্ষার্থী বহিষ্কার, ৯ শিক্ষক সাময়িক বরখাস্ত

চাঁদরাতে বাড়ি ফিরতে চাওয়া স্নাতক চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী রাজিব মিয়া বলেন, ‘ক্যাম্পাস কয়েকদিন আগে ছুটি হলেও বাড়ি যেতে পারিনি। আমার দুইটা টিউশন। এসএসসি পরীক্ষার্থী একজন আছে; ঈদের পর তার পরীক্ষা। তাই অভিভাবকের অনুরোধে একটু বাড়তি সময় দিতে হয়েছে। তাছাড়া এখনও টিউশন ফিও দেয়নি। তাই চাঁদরাতে বাড়ি ফিরব।’

তবে কয়েকজন আবার ক্যাম্পাসেই থেকে যাবেন। তাদের মধ্যে কেউ চাকরির পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছেন, কেউবা ব্যস্ত গবেষণায়; কারও আবার ঈদ পরই ফাইনাল পরীক্ষা। অনেকেই বিসিএসের জন্য রাতদিন এক করে নিজেকে সঁপে দিয়েছেন। তাই তারা বাড়ি ফেরার কথা ভুলে গিয়েছেন। এবারের ঈদ তাদের কাটবে ক্যাম্পাসেই।

স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থী রবিন হায়দার বলেন, ‘এবার ঈদে বাড়ি যাব না। ঈদের কয়েকদিন পরেই একটা চাকরির পরীক্ষা আছে। প্রতিবারই তো বাড়িতে ঈদ করি, জীবিকার তাগিদে এবার নাহয় ক্যাম্পাসেই করলাম।’

নতুন ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের জীবনে ভিন্ন রকমের এক অভিজ্ঞতা নিয়ে এসেছে এবারের ঈদ। দীর্ঘদিনের একাডেমিক ক্লান্তি পেরিয়ে টানা ষোলো দিনের ছুটিতে বাড়ি ফেরার সুযোগ পেয়েছেন তারা। সেটিও আবার ঈদের সময়ে। দীর্ঘদিন পর পরিবারের কাছে ফেরা এবং তাদের সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করে নেওয়ার অনুভূতি আসলে ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়।

এমনই কয়েকজনের সঙ্গে কথা হলে জানান, এবারের রমজানেই প্রথমবারের মতো বাড়ির বাইরে অবস্থান করেছেন তারা। রাতে সেহরির সময় সাময়িক অসুবিধা হলেও দারুণ অভিজ্ঞতা অর্জিত হয়েছে এবারের রমজানে।

স্নাতক প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী লিয়ন সরকার মুঠোফোনে বলেন, ‘ক্যাম্পাস বন্ধ হওয়ার পরদিনই বাড়ি চলে এসেছি। কী যে আনন্দ লাগছে, বলে বোঝাতে পারব না! দীর্ঘদিন ক্লাস, পরীক্ষা শেষে বাড়িতে আসার সময় মনে হচ্ছিল, জগতের সকল সুখ আমার কাছে ধরা দিয়েছে।’

ক্যাম্পাসের কোলাহলমুক্ত পরিবেশ যেমন একদিকে বলছে, নগরীতে ঈদের আমেজ স্পষ্ট হয়ে উঠছে; অন্যদিকে বিষন্নতায় ঘিরে ধরেছে ক্যাম্পাসের নিরাপত্তারক্ষীদের।

শিক্ষার্থীরা তাদের একাডেমিক ক্লান্তি শেষে একটু সজীবতার পরশ পেতে গ্রামে ফিরেছেন। কিন্তু নিরাপত্তাকর্মীদের সেই সুযোগ নেই। এই সময়ে ক্যাম্পাসের নিরাপত্তা রক্ষা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার পরিবেশ সমুন্নত রাখার তাগিদে নিজেদের ঈদের আনন্দকে বিসর্জন দিয়েছেন তারা।

ক্যাম্পাসের হাজারো শিক্ষার্থী, শত শত শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী যখন বাড়িতে গিয়ে পরিবারের সঙ্গে ঈদ করছে, তখন ফাঁকা ক্যাম্পাসে নিরাপত্তা দেওয়ার গুরুভার তাদের কাঁধেই ন্যস্ত।

আরও পড়ুন: ঈদ উপলক্ষে ১৬ দিনের ছুটিতে যাচ্ছে জাবি

নিরাপত্তারক্ষী রমজান মিয়া এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘আপনারা যেমন এই ক্যাম্পাসকে ভালোবাসেন, তেমনি আমরাও ভালোবাসি। নিজের বাড়ির মতো মনে হয় এখানে। তাই ঈদে পরিবারের কাছে যাওয়ার জন্য মন ব্যাকুল হয়ে উঠলেও আর যাওয়া হয়নি। তবুও ক্যাম্পাসের নিরাপত্তা নিশ্চিত হোক—এটাই চাওয়া।’

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় যেন শুধু একটি নামেই সীমাবদ্ধ নয়। এখানকার লাল ইটে মিশে আছে হাজারো আবেগ-অনুভূতির গল্প। প্রকৃতি যেমন নিজের অপার মহিমা মেলে ধরেছে এখানে, তেমনি এর নিরাপত্তার দিকটাও বিবেচনা করা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের বাড়তি ভাবনার বিষয়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা শাখার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা জানান, জাবি ক্যাম্পাস যেমন সুন্দর, তেমনি এর নিরাপত্তা দেওয়াও আমাদের দায়িত্ব। ঈদের দিন ক্যাম্পাসে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোতে টহল বসানো হয়। গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলোতে থাকে চেকপোস্ট।

তিনি বলেন, বহিরাগতদের প্রবেশ ঠেকাতে এবং যেকোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে সদা তৎপর থাকে আমাদের নিরাপত্তাকর্মীরা। তাই তাদের আর বাড়ি যাওয়া হয় না। রাতের বেলাতেও বাড়তি টহলের ব্যবস্থা করা হয়।

বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, ঈদের দিন বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদসহ গুরুত্বপূর্ণ তিনটি মসজিদে ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হবে। এগুলো অনুষ্ঠিত হবে সকাল ৮টা থেকে সাড়ে ৮টার মধ্যে।

ঈদের দিন ক্যাম্পাসে অবস্থানরত সবার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ খাবারের ব্যবস্থাও করবে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় একটি পরিবারের মতো। দৈনন্দিন রুটিনে চলে জাবি শিক্ষার্থীদের প্রতিটি দিন। ঘুম থেকে উঠে ক্লাসে যাওয়া, ক্লাস শেষে বিকেলে লেকের পাড়ে বসা, একটুখানি হাঁটাহাঁটি, গোধূলি লগ্নে মুরাদ চত্বরে চায়ের আড্ডা, রাতে হলে ফেরা—এভাবেই চলা প্রাণোচ্ছল ক্যাম্পাসের চিরচেনা রুপ যেন ক্ষণিকের জন্য থেমে গেছে।

আরও পড়ুন: ১৯৭১-এর সঙ্গে ২০২৪-এর কোনো দ্বন্দ্ব নেই: জাবি উপাচার্য

আগামী ৭ এপ্রিল পর্যন্ত ক্যাম্পাসের যাবতীয় কার্যক্রম বন্ধ থাকবে। এরপর একে একে শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে ফিরতে শুরু করবেন। আবারও প্রাণচাঞ্চল্যে মুখরিত হবে চারদিক; জাহাঙ্গীরনগর ফিরে পাবে তার হারানো জৌলুস।