নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের অভিন্ন দাবিতে ‘৯০ দশকের মতো’ যুগপৎ আন্দোলন করতে ডান ও বামপন্থীদের সম্পৃক্ত করে সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৃহত্তর ঐক্য গঠনের পরিকল্পনা করছে বিএনপি।

দলটি ইতোমধ্যে কয়েকটি বাম দলের সঙ্গে অনানুষ্ঠানিকভাবে বৈঠক করেছে। কিছু শর্তের ভিত্তিতে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার-এ সাধারণ ইস্যুতে কাজ করার ব্যাপারে ইতিবাচক সংকেতও পেয়েছে বলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক সদস্য ইউএনবিকে জানিয়েছেন।

তিনি বলেন, তাদের সর্বশেষ স্থায়ী কমিটির বৈঠকে বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে আলোচনা করা হয়েছে এবং আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগে তাদের দাবি আদায়ে কীভাবে কার্যকর আন্দোলন চালানো যায় সে বিষয়ে তাদের পরামর্শ ও মতামত নিতে অধিকাংশ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।

আরও পড়ুন: দুদকের মামলায় বিএনপি নেতা আসলাম চৌধুরীসহ ৪ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন

বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি ইউএনবিকে বলেন, ‘আমরা এখন আমাদের চেয়ারপার্সনের বিদেশে চিকিৎসার দাবিতে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছি। এ বিষয়ে আমাদের কর্মসূচি শেষ হলে আমরা আমাদের প্রধান দাবি নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের জন্য আন্দোলনে মনোনিবেশ করব।’

এ বিষয়ে আন্দোলন শুরু করার আগে তারা সব ডান ও বাম গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলের মধ্যে বৃহত্তর ঐক্য গড়ে তুলতে অধিকাংশ বিরোধী রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বৈঠক করবেন বলে জানান বিএনপির মহাসচিব।

মির্জা ফখরুল জানান, ইতোমধ্যে বাম গণতান্ত্রিক জোট ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের একাধিক দলের সঙ্গে তাদের অনানুষ্ঠানিক বৈঠক হয়েছে এবং আগামী দিনে তারা আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের সঙ্গে বসবেন।

তিনি বলেন, দেশে গণতন্ত্র, জনগণের ভোটাধিকার ও একটি সুস্থ নির্বাচন ব্যবস্থা পুনরুদ্ধার করতে সর্বস্তরের জনগণ ও সব রাজনৈতিক দলের শক্তিশালী ঐক্য এখন অপরিহার্য।

আরও পড়ুন: খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসা: আরও ৪০ জেলায় সমাবেশ করবে বিএনপি

 

সমঝোতা

আগামী ১২ জানুয়ারি নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠন নিয়ে চলমান সংলাপে অংশ নিতে বুধবার বঙ্গভবন থেকে চিঠি পেলেও তাতে যোগ না দিতে বদ্ধপরিকর বিএনপি।

বিএনপি ছাড়াও বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ), ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি) সহ আরও কয়েকটি রাজনৈতিক দল ইতোমধ্যেই সংলাপে অংশ না নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

বিএনপি নেতারা বলছেন, কল্যাণ পার্টি ও মুসলিম লীগসহ অন্যান্য দলও সংলাপে অংশ নাও নিতে পারে এবং সংলাপে অংশ নেয়া কয়েকটি দলের নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের প্রতি সমর্থন রয়েছে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন গঠন ও নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে বিএনপির সঙ্গে অনেক দলেরই এক ধরনের মানসিক ঘনিষ্ঠতা রয়েছে।’

আরও পড়ুন: চট্টগ্রামে পুলিশের সাথে বিএনপি সংর্ঘষ, আটক ৪৪

তিনি বলেন, বিএনপির অবস্থান স্পষ্ট তারা নির্বাচনকালীন নির্দলীয় প্রশাসনের অধীনে একটি বিশ্বাসযোগ্য জাতীয় নির্বাচনের পথ প্রশস্ত করতে চায়। ‘আমরা জনগণের হারানো অধিকার ফিরিয়ে দিতে চাই এবং খালেদা জিয়াকে কারাগার থেকে সম্পূর্ণভাবে মুক্ত করতে চাই।’

বিএনপির এই নেতা বলেন, ‘আমাদের দাবি আদায়ের জন্য আমরা রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বৃহত্তর ঐক্য গড়ে তোলার চেষ্টা করছি। আমরা ইতোমধ্যে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’

তিনি বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে বৈঠকের সময়সূচি চূড়ান্ত করার দায়িত্ব তাদের দলের মহাসচিবকে দেয়া হয়েছে।

দলটির স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য বলেন, অন্যান্য দলের সম্মতি সাপেক্ষে চলতি মাসের শেষের দিকে বা ফেব্রুয়ারির শুরুতে আলোচনা শুরু করার পরিকল্পনা রয়েছে।

তিনি বলেন, ‘আমাদের দাবি আদায় করতে এবং বর্তমান সরকারের পতন নিশ্চিত করতে ১৯৯০ সালের এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের মতো ঐক্যবদ্ধ/একযোগে আন্দোলন কীভাবে করা যায়-আলোচনা করে সে বিষয়ে আমরা বিভিন্ন দলের মতামত নেব।’

আরও পড়ুন: ২০২২ সালে গণতন্ত্র ‘পুনরুদ্ধার’ হবে: বিএনপি

বড় বাধা জামায়াত

বিএনপির স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য বলেন, নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার গঠনের ব্যাপারে অনেক বিরোধী দলের অভিন্ন অবস্থান রয়েছে। তবে কিছু দল-প্রধানত বাম-বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী সঙ্গে থাকলে বিএনপির সঙ্গে একযোগে আন্দোলন শুরু করার বিষয়ে তাদের দৃঢ় আপত্তি রয়েছে।

তিনি বলেন, সিপিবিসহ বাম দলগুলো চায় বিএনপি জোট থেকে জামায়াতকে ত্যাগ করুক এবং ক্ষমতায় ফিরলে তারা ইসলামী দলগুলোকে প্রশ্রয় দেবে না এবং নির্বাচনী ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ব্যাহত করবে না।

তিনি বলেন, ‘আমরা বিষয়টি নিয়ে কাজ করছি এবং প্রয়োজনে ২০ দল ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে পরিবর্তন আনব। আশা করি, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার পর আমরা একটি উপযুক্ত সমাধান বের করতে পারব।’

আরও পড়ুন: সংলাপে গেলে বিএনপির জন্যই ভালো: আইনমন্ত্রী

সিপিবির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, গণতন্ত্র, জনগণের ভোট ও অধিকার পুনরুদ্ধারে তারা আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন।

তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগের সঙ্গে বিএনপির মৌলিক কোনো পার্থক্য নেই বলে তাদের সঙ্গে একযোগে আন্দোলন করার কোনো পরিকল্পনা নেই। বিএনপিকে আগে প্রমাণ করতে হবে যে তারা সংবিধানের চার মূলনীতিতে- জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা-পুরোপুরি বিশ্বাস করে।’

খন্দকার মোশাররফ বলেন, তারা আশা করেন যারা বর্তমান শাসন থেকে মুক্তি পেতে চান; বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন নিশ্চিত করতে চান; জনগণের ভোট, গণতন্ত্র ও অন্যান্য অধিকার পুনরুদ্ধার করতে চান তারা জাতির বৃহত্তর স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ হবে।

করোনা পরিস্থিতির অবনতি তাদের ভবিষ্যত পরিকল্পনা বাস্তবায়নে চ্যালেঞ্জ হবে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা কোভিড পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছি। যদি সংক্রমণের হার উদ্বেগজনকভাবে বৃদ্ধি পায় তাহলে আমরা আমাদের পরিকল্পনা ও কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য একটি বিকল্প কৌশল তৈরি করব।’

আন্দোলনের উপযুক্ত সময়

খন্দকার মোশাররফ বলেন, সরকারবিরোধী আন্দোলন শক্তিশালী করতে মাঠ প্রায় প্রস্তুত। কেননা আন্দোলন সফল করতে জনগণ প্রস্তুত রয়েছেন।

তিনি বলেন, ‘আমরা সারা দেশে আমাদের সাম্প্রতিক কর্মসূচিতে ব্যাপক সাড়া পাচ্ছি। খালেদা জিয়াকে চিকিৎসার জন্য বিদেশ যেতে না দেয়ায় সরকারের বিরুদ্ধে জনগণের আবেগ রয়েছে। এছাড়া বর্তমান সরকারের দুঃশাসনে জনগণও বিরক্ত। তাই মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে আমাদের কর্মসূচিতে যোগ দিচ্ছে। এটা প্রতিফলিত হয়েছে যে মানুষ ক্ষমতায় পরিবর্তন আনতে একটি বৃহত্তর আন্দোলনের জন্য প্রস্তুত।’

তবে বিএনপির আরেক জ্যৈষ্ঠ নেতা বলেছেন, চলতি বছরের সেপ্টেম্বরের আগে তারা কঠোর আন্দোলনে যাবেন না।

তিনি বলেন, ‘আমরা সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কিছু নমনীয় কর্মসূচি নিয়ে আমাদের আন্দোলন চালিয়ে যাব। কেননা আন্দোলনের গতিবেগ তৈরি হওয়ার আগে আমরা আমাদের শক্তি হারাতে চাই ন।’